মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন।।
বুদ্ধিজীবীদের কাছে সর্বশেষ যে কথাটি নিবেদন করতে চাই তা হল- আপনারা নিজেদের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করুন, মেনে নিতে চেষ্টা করুন যে, মানুষের জীবনের প্রকৃত সফলতা সূচিত হয় ঈমান ও আমলের দ্বারা। ঈমান ও আমলের দ্বারা দুনিয়াতেও সফলতা আসে, আখেরাতেও সফলতা আসবে। আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের ভাষ্য এমনই। কুরআনে কারীমের প্রথম সূরার (সূরা বাকারার) প্রথম দিকে যাদের মধ্যে ঈমান ও আমল আছে তাদের বর্ণনা প্রদানের পর তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ.
অর্থাৎ, তারাই তাদের প্রতিপালকের হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। (সূরা বাকারা: ৫)
এ আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের সফলতা (ইহকালেরও সফলতা পরকালেরও সফলতা) ঈমান ও আমলের মধ্যে। ঈমান ও আমল বর্জন করলে দুনিয়াতেও সফলতা আসবে না, পরকালেও সফলতা আসবে না।
ঈমান ও আমলের বিপরীতে পার্থিব বিদ্যা বুদ্ধি, পার্থিব ধন-সম্পদ, পার্থিব ভোগ-বিলাস, পার্থিব ক্ষমতা দাপট, রূপ-লাবণ্য কোন কিছুই জীবনের সফলতা বয়ে আনতে পারবে না। পার্থিব বিদ্যা বুদ্ধি, পার্থিব ধন-সম্পদ, পার্থিব ভোগ-বিলাস, পার্থিব ক্ষমতা দাপট ও রূপ-লাবণ্য দ্বারা যে সফলতা আসে না তার প্রমাণ তো আমরা নিত্যদিন খোলা চোখেই দেখতে পাই। যখন দেখতে পাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা হেন অপরাধ নেই যা না করছে, হেন অমানবিকতা, নৃশংসতা ও নির্দয়তা নেই যা না করছে, এমনকি পৃথিবীতে মায়া-মমতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক পিতা মাতাকে পর্যন্ত তাদের বৃদ্ধ বয়সে ওল্ড হোমে রেখে আসছে, কিংবা ঘর-বাড়ি থেকে তাড়িয়ে বের করে দিচ্ছে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, পার্থিব বিদ্যা-বুদ্ধি মানুষকে সঠিক মানুষ বানাতে পারে না।
অতএব যে বিদ্যা-বুদ্ধি মানুষকে মানুষই বানাতে পারে না, সে বিদ্যা-বুদ্ধি আদৌ সফলতার চাবিকাঠি হতে পারে না। যখন দেখতে পাই প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক ও শিল্পপতিরা বিত্ত-বৈভবের জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করছে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, পার্থিব ধন-সম্পদ ও পার্থিব ভোগ-বিলাস আদৌ সফলতার চাবিকাঠি নয়। যখন দেখতে পাই নমরূদ ফেরআউনের মত প্রচণ্ড ক্ষমতা ও দাপটের অধিকারীরা করুণ পরিণতি বরণ করছে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, পার্থিব ক্ষমতা ও দাপট সফলতার চাবিকাঠি নয়। যখন দেখতে পাই চোখ ধাঁধানো ও মন মাতানো রূপ লাবণ্যের অধিকারিণীরা রূপ যৌবন হারানোর পর বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে, তাদের দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, রূপ লাবণ্য আদৌ সফলতার চাবিকাঠি নয়।
فَاعْتَبِرُوْا يَا أُولِى الْاَبْصَارِ.
অতএব হে চক্ষুষ্মানরা! (বুদ্ধিমানরা) তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। (সূরা হাশর: ২)
সবশেষে কুরআনের আর দু'টো কথা উল্লেখ করে 'মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন' শীর্ষক লেখাটির সমাপ্তি টানছি।
এক. কুরআন আমাদেরকে বলেছে, এখনই সময় থাকতে যদি আমরা কুরআনের কথা না শুনি, কুরআনের কথা হৃদয়ঙ্গম না করি, তাহলে এক সময় এর জন্য আমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে। কিন্তু তখনকার অনুতাপ কোন ফায়দা বয়ে আনবে না। কুরআনে কারীমে এসেছে-
وَقَالُواْ لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِىٓ أَصْحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ. (سورة الملك: ١٠)
অর্থাৎ, তারা বলবে, (হায় আফসোস) যদি আমরা শুনতাম এবং হৃদয়ঙ্গম করতাম, তাহলে আমাদেরকে এই জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হতে হত না! (সূরা মুলক: ১০)
দুই. এখন কুরআনের কথা শোনা ও মানার গুরুত্ব না বুঝলেও পরকাল সামনে আসার পর শোনা ও মানার গুরুত্ব ঠিকই বুঝে আসবে। তখন প্রতিকারের জন্য আল্লাহর কাছে আবার দুনিয়ায় আসার সুযোগও চাওয়া হবে। কিন্তু প্রতিকারের জন্য কাউকে পুনর্বার দুনিয়ায় আসার সুযোগ দেয়া হবে না। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَوْ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلْمُجْرِمُونَ نَاكِسُواْ رُءُوسِهِمْ عِندَ رَبِّهِمْ رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَٱرْجِعْنَا نَعْمَلْ صَٰلِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ. (السجدة : ١٢)
অর্থাৎ, যদি তুমি অপরাধীদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে মাথা নত অবস্থায় দেখতে। (যখন) তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম শুনলাম। এখন আমাদেরকে আবার (দুনিয়ায়) প্রেরণ করুন, আমরা নেক আমল করে আসব। আমাদের তো বিশ্বাস এসেই গেছে। (সূরা সাজদা: ১২)
আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত গ্রহণ ও হেদায়েতের উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!
এনটি