আতাউর রহমান খসরু।।
ইসলাম মুসলিম উম্মাহকে খাদ্যে স্বনির্ভর হতে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। ইসলাম তা করেছে কৃষিকাজে উৎসাহ দান, কৃষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, কোরআনে কৃষিপণ্যের বিবরণ, চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ ইত্যাদির মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মহামূল্যবান ঈমানকে সুফলা বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করে কৃষিকে অনন্য মর্যাদা দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সত্বাক্যের তুলনা (ঈমান) উত্কৃষ্ট গাছ।
যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত, যা প্রত্যেক মৌসুমে তার ফলদান করে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। ’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ২৪-২৫)
খাদ্যব্যবস্থা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে : পৃথিবীতে যে ‘ফুড চেইন’ বা খাদ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর হাতে। তিনিই মৃত ভূমিতে প্রাণসঞ্চার করেন এবং উর্বর ভূমিকে বিরান করে দেন। তাই মানুষ আল্লাহর নির্দেশিত পথেই খাদ্য সংরক্ষণ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত ভূমি। যাকে আমি সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, যা তারা আহার করে। তাতে আমি সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙুরের উদ্যান এবং তাতে উৎসারিত করি প্রস্রবণ, যাতে তারা আহার করতে পারে তার ফলমূল থেকে, অথচ তাদের হাত তা সৃষ্টি করেনি। তবু কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৩৩-৩৫)
বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভার আল্লাহর দান : আল্লাহ পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় খাদ্য সৃষ্টি করেছেন। বিপুল-বিস্তৃত এই খাদ্যসম্ভার আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বা দান। আল্লাহর প্রতিটি দানই সংরক্ষণ ও মূল্যায়নের যোগ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ-উদ্যানগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুরগাছ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জয়তুন ও ডালিম সৃষ্টি করেছেন—এগুলো একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৪১)
খাদ্য নিয়ে গবেষণার নির্দেশ : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ খাদ্য, খাদ্যের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া, ভূমি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন মানুষ তাঁর স্রষ্টাকে চিনতে পারে এবং খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক! আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। অতঃপর আমি ভূমি প্রকৃষ্টরূপে বিদারিত করি এবং তাতে উৎপন্ন করি শস্য; আঙুর, শাক-সবজি, জয়তুন, খেজুর; বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল ও গবাদি খাদ্য—এটা তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ পশুর ভোগের জন্য। ’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ২৪-৩২)
খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ : ইসলাম মানুষকে খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করে। আল্লাহ চাষযোগ্য ভূমিকে তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা তার দিক-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে আহার্য গ্রহণ করো; পুনরুত্থান তাঁরই কাছে। ’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কিয়ামত এসে যায় এবং তখন তোমাদের কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তবে কিয়ামত হওয়ার আগেই তার পক্ষে সম্ভব হলে যেন চারাটি রোপন করে। ’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৮১)
ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করা : ইসলাম চাষযোগ্য ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তা হলো—ক. মালিককে চাষাবাদের নির্দেশ দিয়েছে। প্রয়োজনে বর্গাচাষের পরামর্শ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যার কাছে জমি আছে সে যেন তা নিজে চাষ করে অথবা তার ভাইকে দিয়ে দেয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩৪১)
খ. চাষাবাদের ভিত্তিতে মালিকানা প্রদান। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো ভূমি আবাদ করে যা কারো মালিকানাধীন নয়, সে-ই (ভূমির মালিক হওয়ার) অধিক হকদার। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩৩৫)
গ. ভূমি ফেলে রাখলে তা কেড়ে নেওয়া। সরকারি খাসজমি লাভের পর কোনো ব্যক্তি যদি তা তিন বছরের বেশি সময় অনাবাদি অবস্থায় ফেলে রাখে তবে তা রাষ্ট্র কেড়ে নিতে পারবে। (ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ণ, পৃষ্ঠা ১৮০)
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার নির্দেশ : ইসলাম খাদ্য উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। যেন দুর্যোগ ও সংকটের কারণে দেশে খাদ্য বিপর্যয়ের সৃষ্টি না হয়। যেমন—পবিত্র কোরআনে মিসরের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বিবরণ তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ বলল, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষ করবে, অতঃপর তোমরা যে শস্য কাটবে তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে, তা ছাড়া সব শীষসহ রেখে দেবে। এরপর আসবে সাতটি কঠিন বছর। এই সাত বছর যা আগে সঞ্চয় করে রাখবে, লোকে তা খাবে; কেবল সামান্য কিছু যা তোমরা সংরক্ষণ করবে, তা ছাড়া। অতঃপর আসবে এক বছর, সেই বছর মানুষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং সেই বছর মানুষ প্রচুর ফলের রস নিংড়াবে। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৯)
খাদ্য উৎপাদকের বিশেষ মর্যাদা : ইসলাম খাদ্য উৎপাদনে অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। বিশেষত খাদ্য উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি কৃষককে। মহানবী (সা.) বলেন, কোনো মুসলিম ফলবান গাছ রোপণ করে কিংবা কোনো ফসল ফলায় আর তা থেকে পাখি কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু খায়, তবে তা তার পক্ষ থেকে সদকা বলে গণ্য হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩২০)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়া (নেকির চলমান উৎস) হিসেবে ঘোষণা করেছেন। (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস : ৭২৮৯)
নিষ্ফল চেষ্টাও মূল্যহীন : খাদ্য উৎপাদক কৃষক যদি খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তবু সে আল্লাহর কাছে প্রতিদান লাভ করবে। মহানবী (সা.) বলেন, তোমাদের কারো ফসল যদি বিপদ, চতুষ্পদ জন্তু ও পাখি কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তবে তার জন্য তা সদকাস্বরূপ। (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৯০৭১)
চতুষ্পদ জন্তুর উপযোগ ঘোষণা : মানুষের খাদ্যের অন্যতম জোগান আসে চতুষ্পদ জন্তু থেকে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে চতুষ্পদ জন্তুর উপযোগ ঘোষণা করে তাকে সম্পদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহই তোমাদের আরোহণ ও আহারের জন্য বহু পশু সৃষ্টি করেছেন। তোমরা তা আহার করে থাকো এবং এগুলোর ওপর মালামাল বহন করে থাকো। (সুরা : মুমিন, আয়াত : ৭৯)
গবাদি পশু সংরক্ষণের তাগিদ : হানাশ ইবনে হারিস (রহ.) বলেন, আমাদের মধ্যে কারো ঘোটকীর বাচ্চা হলে সে তা জবাই করে ফেলত আর বলত, তা বাহনের উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত কি আমি বেঁচে থাকব? অতএব আমাদের কাছে ওমর (রা.)-এর একখানা চিঠি এলো—আল্লাহ তোমাদের যে জীবিকা দান করেছেন তার রক্ষণাবেক্ষণ কোরো। কেননা তোমাদের এই আচরণ অত্যন্ত স্বার্থপরসুলভ। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৮০)
মত্স্যসম্পদের উপযোগ ঘোষণা : কোরআনে গবাদি পশুর মতো মাছেরও উপযোগ ঘোষণা করা হয়েছে। যেন মানুষ তাকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করে এবং তা সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সচেষ্ট হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মাছ আহার করতে পারো। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১৪)
ইসলামের এই নির্দেশনা সামনে রেখে মুসলিম শাসকরা যুগে যুগে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে মনোযোগী হন। তারই অংশ হিসেবে তাঁরা কৃষির সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়ন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, সেচ ব্যবস্থা ও কৃষি সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, বীজ সংরক্ষণ ও বীজের জাতোন্নয়নে মনোযোগী হন। ঐতিহাসিকদের সাক্ষ্য—‘তদানীন্তন মুসলিম বিশ্ব বাহির থেকে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করেছিল—এই তথ্য আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। ’ (আহমদ আমিন, জহরুল ইসলাম : ২/২৪৬)
সূত্র: ইসলামী জীবন।
এনটি