মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন।।
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল আপনারা ভেবে দেখবেন-
সত্যের সামনে মাথা নত করা কি পরাজয়?
'মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন' নামক এই ধারাবাহিক লেখাটির প্রথম পর্ব থেকে দ্বাদশ পর্ব পর্যন্ত ইসলামী আদর্শ, আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদের যেসব অভিযোগ বা ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে, সেগুলো নিরসন কল্পে কিছু কথা পেশ করেছি। এসব কথা বলে তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছি। বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন- একথাগুলো আপনারা অনুকূল মন নিয়ে বুঝার চেষ্টা করুন, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আন্তরিকভাবে গ্রহণ করুন। ইসলামী আদর্শে পূর্ণ প্রবেশ করুন।
কেউ যেন একথা মনে না করেন যে, আমি অন্যের কথা সঠিক হলেও তা মানতে পারি না। তাতে আমার পরাজয় স্বীকার করে নেয়া হয়। তাতে আমার উপর অন্যরা বিজয়ী হয়ে যায়। বস্তুত যে সত্যকে গ্রহণ করে সে-ই বিজয়ী। যে ঈমান গ্রহণ করে সে-ই বিজয়ী। ঈমান ও সত্যকে গ্রহণ করলে কেউ নিচু হয় না, বরং উঁচু হয়।
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَأَنتُمُ ٱلْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.
অর্থাৎ, তোমরা যদি মুমিন হও তবে তোমরাই উপরে আছো। (সূরা আলে ইমরান: ১৩৯)
বস্তুত সত্যকে মেনে নেয়া পরাজয় নয়। বরং সত্যকে না মেনে নেয়াই পরাজয়। আমি সত্যকে মেনে নিলাম না অর্থ আমি প্রবৃত্তির কাছে পরাজিত হলাম, শয়তান ও শয়তানের দোসরদের কাছে পরাজিত হলাম। কেননা প্রবৃত্তি, শয়তান ও শয়তানের দোসররাই সত্য না মানার জন্য বলে, যে কথা কুরআন হাদীছের বহু ভাষ্যে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে। তাই সত্যকে না মেনে নিলে আমি বিজয়ী হলাম না, বিজয়ী হল প্রবৃত্তি, শয়তান ও শয়তানের দোসররা।
সত্য ও সঠিক বিষয় তথা দ্বীনের বিষয় সামনে আসার পরও তা গ্রহণ করতে না পারার পেছনে তথা হেদায়েত গ্রহণ না করতে পারার পেছনে মনের মধ্যে একটা এরূপ চিন্তাও কাজ করতে পারে যে, আমি আমার মত পথ ছেড়ে দিয়ে হেদায়েত গ্রহণ করলে আমার মত পথের লোকজন, আমার আপনজন বন্ধুবান্ধব সব অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে, তারা পর হয়ে যাবে, তারা কেউ পক্ষে থাকবে না। এরূপ চিন্তার প্রতিকার হল এই ভাবনা মাথায় আনা যে, হেদায়েত গ্রহণ করলে কেউ সন্তুষ্ট না থাকুক আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি সকলের সন্তুষ্টির চেয়ে বড়। তিনি আমার ইহকাল পরকালের প্রকৃত সহায়। ভাবতে হবে- আল্লাহর সন্তুষ্টিকে উপেক্ষা করে যেসব বন্ধুবান্ধব ও আপনজনের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিব, আমার আসল বিপদের সময় তথা পরকালের মহা বিপদের সময় তারা কেউ আমার পাশে থাকবে না। কেউ আমার সহায় হবে না। তখন আমার সহায় হতে পারবেন একমাত্র আল্লাহ।
এ মর্মেই কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَإِن تَشْكُرُوا يَرْضَهُ لَكُمْ ۗ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ.
অর্থাৎ, তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও (তথা আল্লাহর বিধানের অনুগত হও), তিনি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। আর (মনে রেখো) কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না। (সূরা যুমার: ৭)
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۚ وَإِن تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلَىٰ حِمْلِهَا لَا يُحْمَلْ مِنْهُ شَىْءٌ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰٓ.
অর্থাৎ, (কেয়ামতের দিন) কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। যদি বোঝাভারে আক্রান্ত কোন ব্যক্তিকে কারও বোঝা বহন করার আহ্বান জানানো হয়, তার বোঝার কিছুই বহন করা হবে না, যদিও সে হয় নিকটতর আপনজন। (সূরা ফাতির: ১৮)
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
ياأيها الناس اتقوا رَبَّكُمْ واخشوا يَوْماً لاَّ يَجْزِي وَالِدٌ عَن وَلَدِهِ وَلاَ مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَن وَالِدِهِ شَيْئاً.
অর্থাৎ, হে লোকসকল! তোমরা আপন পালনকর্তাকে ভয় করো। এবং ভয় করো সেদিনকে যেদিন না কোন পিতা তার সন্তানের উপকারে আসবে, আর না কোন সন্তান তার পিতার কিছুমাত্র উপকারে আসবে। (সূরা লুকমান: ৩৩)
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيْهِ وَأُمِّهِ وَأَبِيْهِ وَصَاحِبَتِه وَبَنِيهِ لِكُلِّ امْرِىءٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيْهِ.
অর্থাৎ, সেদিন মানুষ ভেগে যাবে তার ভাই থেকে। তার মাতা ও পিতা থেকে। এবং তার সংগিনী ও সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের অবস্থা এমন হবে যা তাকে (অন্যের থেকে) বিমুখ করে দিবে। (সূরা আবাসা: ৩৪-৩৭)
আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েত-এর জন্য কবূল করুন। তিনি আমাদের সকলের সহায় হোন। আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি-
يَا مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ! صَرِّفْ قَلْبِيْ عَلَى طَاعَتِكَ.
অর্থাৎ, হে অন্তরের চিন্তা-চেতনা ফেরানোর মালিক! তুমি আমার অন্তরকে তোমার আনুগত্যে ফিরিয়ে আনো। আমীন!
এনটি