জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দীর্ঘ ১৩ বছরের খতিব মাওলানা সালাহউদ্দিনের ইন্তেকালের পর বায়তুল মোকাররমের পরবর্তী খতিব কে হবেন এ নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা ছিল সব মহলে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল গত বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ছড়িয়ে পড়া একটি খবরে। খবরে জানা গেল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মুহতামিম, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের আমির ও কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশের সভাপতি, মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী (ছদর ছাহেব রহ.) এর ছেলে মুফতি রুহুল আমীনকে।
দীর্ঘ দিন পরে দেশের জাতীয় মসজিদের খতিবের মিম্বারে বিশুদ্ধ ইলম -দ্বীন চর্চাকারী একজন আলেমের ফিরে আসায় রবের শুকরিয়া আদায় ও আনন্দ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ। প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় এই মিম্বার থেকে দেশের জন্য কল্যাণকর বার্তা আসবে এমন কামনা করেছেন সবাই।
জাতীয় মসজিদের নতুন খতিবের কাছে দেশের তরুণ ও আলেমদের প্রত্যাশ্য কী?- জানার চেষ্টা করেছে আওয়ার ইসলাম। প্রায় ১০জন আলেমের সঙ্গে কথার চেষ্টা করে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
খতিব হিসেবে আমাদের আদর্শ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী
[caption id="" align="alignright" width="390"] মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।[/caption]
রাজধানীর মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও আরবি ভাষার শিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী বলেছেন, ‘সর্ব শ্রেণীর মানুষের পক্ষ থেকে জাতীয় মসজিদের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন মুফতি রুহুল আমীন। একজন আলেম, উপমহাদেশের মনীষী ব্যক্তির সন্তান ও ব্যক্তিগত যোগ্যতায় কোন অংশে তিনি কম নন’।
‘জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে তার নিয়োগপ্রাপ্তির বিষয়টি সকলের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করছি’- বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
‘জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে তার কাছে প্রত্যাশা থাকবে তিনি ইসলামের সঠিক ও বিশুদ্ধ বিষয়গুলো জাতির সামনে উপস্থাপন করবেন। বয়ানের আগে তিনি সার্বিক বিষয়ে বিবেচনা করে কথা বলবেন। বয়ান যেন একান্ত একপেশে বক্তব্য না হয়ে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে হয়’।
‘তিনি যেন ইসলাম বিরোধী মিথ্যা-প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন এই প্রত্যাশাও থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা খতিব মাওলানা উবাইদুল হক রহ.-এর কথা স্মরণ করতে পারি’ বলেন আরবি ভাষার এই শিক্ষক।
‘সর্বোপুরি খতিব হিসেবে আমাদের আদর্শ হলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বর্তমান খতিব তার আদর্শকে সামনে রেখে মুসল্লিদের সামনে বয়ান উপস্থান করবেন এই প্রত্যাশা রাখি’ বলেন মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।
মানুষ যেন আবারো ভরসার জায়গাটি ফিরে পায়: মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ
জামিয়া ইউসুফ বানুরীর মুহতামিম ও মাহমুদ নগর জামে মসজিদের খতিব মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ বলেছেন, ‘একজন ইমামের সঙ্গে জনগণের কয়েকটি বিষয়ে সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম হল, জনগণের আকিদা ঠিক রাখা। দ্বিতীয় হলো, জনগণের আমল ঠিক রাখা। একজন ইমামকে আল্লাহ তায়ালার সামনে জবাব দিতে হবে তিনি জনগণের আকিদা ও আমল ঠিক রাখছেন কিনা। আরেকটি বিষয় হল, জনগণের অন্তরে আখেরাতের ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া।- জাতীয় মসজিদের ইমামের কাছে প্রত্যাশা থাকবে তিনি যেন জাতিকে এই বিষয়গুলোতে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন’।
[caption id="" align="alignnone" width="289"] মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ।[/caption]
মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ বলেছেন, ‘খতিব মুফতী মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান, মুফতি আব্দুল মুইজ ও মাওলানা মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের সময় বায়তুল মোকাররমের খতিবের পদটি এ দেশের মানুষের কাছে খুব আকর্ষণীয় ও দিক-নির্দেশনা মূলক ছিল না। কিন্তু যখন খতিব মাওলানা উবাইদুল হক রহ.-এই দায়িত্ব পেলেন, তখন তিনি জাতীয় মসজিদের মিম্বারকে এমন একটি স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন যে জাতি সর্ব প্রথম বায়তুল মোকারেরমের দিকে তাকিয়ে থাকতো; ওখান থেকে কী ধরনের দিক-নির্দেশনা আসে তা জানার জন্য’।
আরো পড়ুন: প্রথম জু*মায় মু*সল্লিদের উদ্দেশে যা বললেন জাতীয় ম*সজিদের খতিব মুফতি রুহুল আমিন
তিনি বলেন, ‘আরবিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, মানুষ মর্যাদার উপর ভিত্তি করেই পদের মর্যাদা। খতিব মাওলানা উবাইদুল হক রহ.- সেটিই করিয়ে দেখিয়েছেন’।
তিনি বলেন, ‘পদে যদি কোন অযোগ্য মানুষকে বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই পদের মর্যাদা রক্ষা হয় না। খতিব উবাইদুল হক রহ. জাতীয় মসজিদের খতিবের পদকে মানুষের আশা-ভরসারস্থলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান খতিবের কাছে আমাদের সব থেকে বড় আশা হল তিনিও জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে পদটির প্রতি আবারো জনগণের আশা-ভরসা ফিরিয়ে আনবেন’।
তিনি পূর্বসুরীদের অনুসরণ করতে পারলে জাতির একটা শূন্যতা পূরণ হবে: মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব
সংকীর্ণমনা কোন ঘরনার বাইরে সহীহ ও বিশুদ্ধ দ্বীনচর্চাকারীদের একজনকে খতিব নিযুক্ত করায় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৈনিক নয়া শতাব্দীর ইসলাম বিভাগীয় সম্পাদক, আন নূর জামে মসজিদের খতিব ও মাদরাসা আবু রাফে (রা.)-এর পরিচালক মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেছেন, জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি রুহুল আমীনের কাছ থেকে জাতীয় কিছুই প্রত্যাশা করে জাতি।
[caption id="" align="alignnone" width="260"] মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব।[/caption]
‘অনেক বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশের বিষয়টি আমার কাছে হিকমাহ পরিপন্থী মনে হয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, তার কাছের বা দূরের যারাই আছেন তারা মুফতি রুহুল আমীনকে জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে থাকতে দেবেন এটেই আমার অনুরোধ।
তিনি বলেন, ‘কাজের মূল্যায়ন করা যাবে সামনের দিনগুলোতে তার ভূমিকার উপর ভিত্তি করে’।
‘খতিব উবাইদুল হক রহ.- চলে যাওয়ার পর জাতীয় মসজিদের খতিব পদের মান-মর্যাদা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই নতুন খতিবের কাছে কাছে প্রত্যাশা থাকবে তিনি তার কাজের মাধ্যমে আবারো সেই গৌরব ফিরিয়ে আনবেন। ব্যক্তিত্ব,কাজ-কর্ম সবকিছুতে তিনি পূর্বসুরীকে অনুসরণ করতে পারলে জাতির একটা শূন্যতা পূরণ হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব।
সবশ্রেণী মানুষের জন্য তিনি আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য হবেন বলে প্রত্যাশা রাখি: মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী আলোচক মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় মসজিদের খতিব পদটিতে একটি শূন্যতা ছিল, এবার তা পূরণ হয়েছে। জাতীয় মসজিদ আবারো তার খতিব ফিরে পেয়েছে। এটা একটা আনন্দের বিষয়। সর্বোচ্চ ধর্মীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব আমরা তার কাছ থেকে তা প্রত্যাশা করি। সব ধরনের মানুষের জন্য তিনি আশ্রয় হিসেবে গণ্য হবেন বলে আমরা আশা করি।
[caption id="" align="alignnone" width="379"] মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী।[/caption]
‘খতিব উবাইদুল হক রহ. চলে যাওয়ার পর বায়তুল মোকাররম থেকে ধর্মীয় ও জাতীয় নেতৃত্ব আর কেউ দিতে পারেননি। আবারো তা ফিরে আসবে আমরা এটাই প্রত্যাশা করছি’।
‘বর্তমান খতিবের পারিবারিক যেই অবস্থান ও ঐতিহ্য সব বিবেচনায় তিনি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা’ বলেন মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী।
সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে বিশুদ্ধ দ্বীন প্রচারে ভূমিকা রাখবেন তিনি: মুফতি সামসুদ্দোহা কাসেমী
[caption id="" align="alignnone" width="225"] মুফতি সামসুদ্দোহা কাসেমী।[/caption]
জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে মুফতি রুহুল আমিনের নিয়োগের বিষয়টি ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন রাজধানীর বিসিএসআইআর (সাইন্স ল্যাবরেটরী) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি সামসুদ্দোহা কাসেমী।
তিনি বলেছেন, জাতীয় মসজিদের খতিবের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে তিনি দলমতের উর্ধ্বে গিয়ে সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে বিশুদ্ধ দ্বীন প্রচারে ভূমিকা রাখবেন এবং মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিম দেখাবেন।
পূর্বসুরীদের অনুসরণ করতে পারলে তিনি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবেন: মুফতি মনোয়ার হোসাইন
মাদরাসাতুল মদিনা, বগুড়ার প্রিন্সিপাল মুফতি মনোয়ার হোসাইন বলেছেন, ‘জাতীয় মসজিদের খতিব হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন খতিব মাওলানা উবাইদুল হক রহ.। বর্তমান খতিব মুফতি রুহুল আমিন যদি তার পথ অনুসরণ করতে পারেন তাহলে তিনি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবেন। তার কাছে মানুষের বর্তমান প্রত্যাশাও এটি’।
[caption id="" align="alignnone" width="297"] মুফতি মনোয়ার হোসাইন।[/caption]
‘৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে জাতীয় মসজিদের খতিবের পদটি আমাদের জন্য অভিভাবকত্বের ভূমিকা রাখে। সুতরাং মানুষের প্রত্যাশা বুঝে তিনি যদি নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য ঠিকমত পালন করতে পারেন এবং অভিভাবক সূলভ ভূমিকা পালন করতে পারেন তবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে’।
মুফতি মনোয়ার হোসাইন বলেছেন, আরেকটি বিষয় হল, ইসলামের মৌলিক বিষয়ে বিভিন্ন সময় অনেকেই অযৌক্তিক দাবি তুলেন এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে তিনি মানুষকে সচেতন করে সঠিক বার্তা দিতে পারেন’।
‘সর্বশেষ তার কাছ থেকে আরেকটি প্রত্যাশা হল, তিনি যেহেতু জাতীয় পর্যায়ে অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বপালনের সুযোগ পেয়েছেন একে কাজে লাগিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে কাজ করতে পারেন। যেমন, দেশে অনেক কওমি মাদরাসা রয়েছে, এতে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন তাদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষার জন্য বাহিরের দেশগুলোতে যেতে জটিলতার মুখোমুখি হন, বর্তমানে যে শিক্ষা সনদ দেওয়া হয়েছে, একে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার পথ সুগম করতেও তিনি ভূমিকা রাখতে পারেন, তাহলে এটি হবে তার কাছ থেকে একটি বাড়তি পাওনা হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন মুফতি মনোয়ার হোসাইন।
আরো পড়ুন: জাতীয় মসজিদের খতিব পদে আলোচনায় যারা