নুরুদ্দীন তাসলিম।।
শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা সম্পন্ন করে তুলতে গাইড নির্ভরতা বন্ধের বিকল্প নেই। শিক্ষাবিদরা বরাবরই এ দাবি জানিয়ে এসেছেন। বছরের শুরুতেও এ নিয়ে সচেতন করা হয় মাদ্রাসাগুলোতে। এরপরও শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অনেকটা গাইড নির্ভর পড়াশুনায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মূল যোগ্যতায় যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়টি আবারও আলোচনা তৈরি করেছে বেফাকের ৪৫তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অনুযোগের পর। এবার গাইড নিষিদ্ধের দাবিও প্রকট হয়েছে শিক্ষক-ছাত্র সর্ব-মহলে।
এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস, শিক্ষাবিদ ও ধোলাইখাল বাইতুল ইজ্জত জামে মসজিদের খতিব মাওলানা জিকরুল্লাহ খান।
তিনি বলেছেন, ‘গাইড পড়ে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তাহল, এখানে তারা রেডিমেট কিছু জিনিস পাচ্ছে এর উপরেই নির্ভর করছে, এর বাইরে যাচ্ছে না। অথচ উচিত ছিল একটা বিষয় হল করতে বিভিন্ন কিতাব মুতালা করা এবং সেখান থেকে এর সার-নির্যাস বের করা। তা না করে শিক্ষার্থীরা যখন গাইড নির্ভরতার দিকে ঝুঁকছে তখন বলা যায় এর মাধ্যমে অযোগ্য প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে’।
এই শিক্ষাবিদের মতে শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের এলেম অর্জন-এর সঠিক পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়া, প্রত্যেক কিতাবের মূল উৎস সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের জায়গা থেকে আরও সচেতনতার পরিচয় দেয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও মূল উৎস থেকে হয়তোবা কিছুটা দূরে থাকেন। তাই তারা নিজেরাও শিক্ষার্থীদের মূল উৎস সম্পর্কে বলেন না।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. বলেছেন, পড়াশুনা শেষে আমি ১২ বছর লেখালেখির কাজে যুক্ত ছিলাম। এ সময় অন্যদের সাথে আমার খুব একটা কথা, দেখা-সাক্ষাৎ হতো না।
এরপর আমি নিজেকে শিক্ষকতায় নিযুক্ত করলাম। শিক্ষকতা পেশায় এসে প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যান, যে আমি যে কিতাবগুলো পড়াবো তা যে ওস্তাদের কাছে পড়েছি তার দরসের নোট তো আমার কাছে নেই। এখন আমি কিভাবে পড়াবো! এ বিষয়টি নিয়ে অনেকেই পেরেশানিতে ভোগেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি।
এর কারণ হিসেবে আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার ওস্তাদের উপর রহম নাজিল করুন। তারা যখন আমাদের ক্লাসের তাকরির করতেন তখন তাকরিরে রেডিমেড আলোচনার বাইরে তারা এবিষয়ের উৎস এবং কিতাবগুলোর কথা আমাদের জানিয়ে দিতেন। বলে দিতেন এ বিষয়টি অমুক কিতাবের অমুক জায়গায় আছে।
কোন হাদিস নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে বলে দিতেন এর সমাধান অমুক কিতাবে রয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের চোখ খুলে গিয়েছিল।
আল্লামা নোমানী রহ.বলেছিলেন , শিক্ষকরা আমাদের এভাবে কিতাবের মূল উৎস বলে দেয়ার কারণে আমাদের ভিতরে এতটা সাহস ছিল যে কোন বিষয় সম্পর্কে পড়াতে গেলে আমাদের তখন শুধু সময় এবং মুতালার প্রয়োজন হতো। কারণ এর উৎস সম্পর্কে আমাদের আগে থেকেই জানার রয়েছে। শিক্ষকের তাকরির হারিয়ে যাওয়ার কোন ভয় ছিল না আমাদের। অথচ অনেকের ক্ষেত্রে এমনটা শুনতে পাওয়া যায় যে উস্তাদের তাকরির তার কাছে না থাকলে তিনি পড়াতে গিয়ে ঘাবড়ে যান।
মাওলানা জিকরুল্লাহ খান বলেন, আল্লামা নোমানী রহ.বলেছিলেন, অনেকের কাছে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. ও আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.- এর তাকরির নোট করা থাকত, তারা এর উপর নির্ভর করে স্বগর্বে পড়াতেন। অথচ আমার কাছে ‘আনোয়ার শাহী ও হোসাইনী’ (তিনি এমন শব্দ উল্লেখ করে বলেছেন) এই দুই লাইনের কোনটির গাইড অথবা নোট ছিল না। কারন আমার জানা ছিল কোন কিতাবের উপর কোন কোন শরাহ লেখা হয়েছে এবং কোথা থেকে আমি এ বিষয়টি সমাধান করতে পারব।
মাওলানা জিকরুল্লাহ খান বলেন, শিক্ষার্থীদের তাকরির বলার সাথে সাথে কিতাবের উৎস সম্পর্কে জানানো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের এভাবে এলেম অর্জনের উৎস জানিয়ে দিতে পারি তাহলে তারা গাইড নির্ভরতার প্রতি ঝুঁকবে না। বরং সে নিজেই শিক্ষার্থীদের এমন গাইড তৈরি করে দিতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা বন্ধে শিক্ষকদের দায়িত্ববোধের দিকেও কিছুটা জোর দিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন, নিজেরাও কিতাবের মূল উৎসের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সেই উৎস সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া উচিত।
আরো পড়ুন: ‘গাইড নির্ভর পড়াশোনা বন্ধে শিক্ষাবোর্ডের কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই’
এইচ, এ/ এটি