মাওলানা আমীর ইবনে আহমদ। লেখালেখি সাহিত্যচর্চার সাথে তার পরিচয় শিক্ষা জীবন থেকে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য অঙ্গনে রয়েছে অবাধ বিচরণ। মৌলিক রচনা, অনুবাদ মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। ময়মনসিংহের আলেমদের বৃহত্তর সংগঠন ইত্তেফাকুল উলামার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সীরাত চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র-এর মাধ্যমে সীরাতের প্রচার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেেন।
তরুণদের সাহিত্যচর্চা, একুশে বইমেলা ও নিজের লেখালেখিতে আসার বেশ কিছু স্মৃতি নিয়ে ভাষার মাসে তিনি কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম-এর সঙ্গে। একান্ত আলাপচারিতায় তার সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
লেখালেখিতে কীভাবে আসলেন? আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিলো?
আমীর ইবনে আহমদ: ছাত্রজীবনে একটি সিরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে লেখালেখিতে পদচারণা।
আরও একটি বিষয় আমাকে লেখালেখিতে আসার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে তাহল, শিক্ষকতা, বয়ান বক্তৃতার থেকেও লেখালেখির প্রভাব বেশি। মানুষের অন্তরে বেশি রেখাপাত করে লেখার আবেদন, এ বিষয়টিও আমাকে লেখালেখিতে আসার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে।
লেখালেখিতে আমার স্বপ্ন পুরুষ ও অনুপ্রেরণা ছিলেন মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ.। সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, মাসিক মদিনা এসব পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বেশ উৎসাহ পেয়েছি।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে লেখালেখির হাতে খড়ি হয়েছে স্বপ্নচারী লেখক মাওলানা যাইনুল আবিদীনের হাত ধরে।
মূলত ছাত্রজীবনে সিরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে লেখালেখিতে আসা। এখন পর্যন্ত সাধনা এবং অধ্যাবসায় চালিয়ে যাচ্ছি।
কয়টা বই বেরিয়েছে আপনার ? কী বই- অনুবাদ না মৌলিক?
আমীর ইবনে আহমদ: আমার মোট ৭ টি বই প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে অনুবাদ, সংকলন রয়েছে। মৌলিক বই আছে একটি।
আমার বইগুলো হল, ‘দাওয়াত ও ইসলাহের নববী পদ্ধতী, সফল দাম্পত্য জীবনের রূপরেখা, মানুষ ও শয়তানের লড়াই, সিরাতে মুস্তাকিম, যিকরুল্লাহ ও দোয়া, প্রিয় নবীজির প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের সীমানা, সিরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি, এই সাতটির মধ্যে ‘সিরাত অধ্যায়ন’ বইটি আমার মৌলিক গ্রন্থ।এছাড়াও আমার সম্পাদিত ১২টি বই বাজারে আছে।
তরুণ আলেমদের সাহিত্য চর্চা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন বা ভাবনাটা কী? এ সময়ে কেমন হচ্ছে তরুণদের সাহিত্যচর্চা?
আমীর ইবনে আহমদ: তরুণ আলেমদের সাহিত্যচর্চা বর্তমানে অনেকটাই আশাজাগানিয়া পর্যায়ে আলহামদুলিল্লাহ। তরুণদের লেখায় এখন ফুটে উঠছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং লেখাগুলোও সাহিত্যমান সমৃদ্ধ।
তবে একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের আলেম লেখকদের অনেকের লেখাই বর্তমানে অনুবাদ সাহিত্য নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ থেকে বের হয়ে মৌলিক রচনায় মনোযোগী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের ভাষা ধারণ করে আরো বেশি সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসা উচিত তরুণদের।
বর্তমান তরুণদের মধ্যে ভাষা-সাহিত্য চর্চার যে ধারা তৈরি হয়েছে, এটা অব্যাহত থাকলে খুব অল্প দিনেই বাংলা ভাষায় আলেমদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হবে বলে আশা করি।
সবশেষ বলবো, বিগত দুই দশকে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই, অনুবাদ মিলিয়ে লেখালেখিতে আলেমদের যে অংশগ্রহণ বেড়েছে এটা সত্যিই আশা জাগানিয়া।
সাহিত্যের ময়দানে ইসলামি ঘরানার অনেক তরুণ ইদানিং কাজ করছেন। কেউ কবিতা লেখছেন, কেউ গল্প-প্রবন্ধ, কেউ উপন্যাস। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় ইসলামি ঘরানার তরুণদের কোন শাখায় অগ্রসর হওয়া অধিক কল্যাণকর মনে করেন?
আমীর ইবনে আহমদ: সাহিত্য অঙ্গনের বিভিন্ন দিক সামনে রেখে আমাদের তরুণরা কাজ করছে। তবে আমি মনে করি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাহিত্যচর্চাকে জীবনমুখী পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার।
কবিতা-অনুবাদ, গল্প-প্রবন্ধ, উপন্যাস যার যে বিষয়ে আগ্রহ সে সেই দিকটা নিয়ে কাজ করবে, তবে একে জীবনমুখী করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কওমি তরুণদের যারাই সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে সবাই নিজের জায়গা থেকে দ্বীনের খেদমত ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করবেন।
বাংলা ভাষার মূলধারার সাহিত্য পড়তে পড়তে অনেক তরুণ তো আবার চিন্তায়-রুচিতে একটু ছিটকে পড়তে থাকে বলে অভিযোগ-অনুযোগ আছে। আপনার কী মনে হয়?
আমীর ইবনে আহমদ: একটা সময় ছিল যখন অন্যদের লেখা পড়া ছাড়া সাহিত্য চর্চা সম্ভব ছিল না। বর্তমানে সেই দুরাবস্থা দূর হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
আলেম লেখক ও তরুণদের অনেক সাহিত্য সমৃদ্ধ বই বের হচ্ছে, এসব থেকে সাহিত্য চর্চা করলে ঝুঁকি থাকে না।
এরপরও অন্যদের সাহিত্য পড়ার প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে আশঙ্কা হল তরুণদের নিয়ে। বয়সের কারণে অন্যের লেখায় ( ভিন্ন ঘরনার) তাদের প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। তাই এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কারো তত্ত্বাবধায়ন প্রয়োজন।
সর্বোপুরি কথা হল, অন্যদের লেখা পড়তে গিয়ে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে আমরা তাদের লেখা থেকে সাহিত্যমান, কলাকৌশল, উপস্থাপনা শেখার চেষ্টা করব, তাদের আদর্শ গ্রহণ কখনই আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
ফেব্রুয়ারির বইমেলাতে আলেম লেখকের বই ও ইসলামী প্রকাশনীগুলোর স্টল পাওয়া নিয়ে টানাপোড়েন চলতেই থাকে- বিষয়টি সুরহার কোন আশা দেখেন কি না অথবা এ নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোন মতামত ?
আমীর ইবনে আহমদ: ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক বইমেলা নিয়ে আমার তিনটি মতামত রয়েছে। প্রথম হলো, এই বইমেলায় আলেম লেখকদের অংশগ্রহণ খুব বেশিদিনের নয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা বাধা, প্রতিকূলতা মাড়াতে হবে। পরিস্থিতির বাস্তবতায় একে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হল, যারা ইসলামী প্রকাশনী ও ইসলামী ধারার বইগুলো মেলা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কাজটি করতে চাইছেন। এটাই তাদের জন্য একসময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। কারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি এড়িয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টায় তারা কখনো সফল হবেন না ইনশাল্লাহ।
একটি অংশের বাঁধা-বিপত্তি কারণে সাময়িকভাবে আমরা হয়তো আহত হচ্ছি; কিন্তু একসময় তাদের এই বাঁধা-বিপত্তি আমাদের শক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।
তৃতীয় বিষয় হল, যারা ইসলামী বই নিয়ে অস্বস্তিতে থাকেন, তারা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামী প্রকাশনীগুলোর জন্য আলাদা স্টলের ব্যবস্থা করতে পারেন। যেখানে একুশে বইমেলায় ইসলামি স্টলগুলোর জন্য আলাদা একটা কর্ণার থাকবে, এখানে ইসলামী প্রকাশনীর বই, আলেম লেখকদের উপস্থিতি থাকবে।
তবে সামগ্রিক ভাবে আমি বলব, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতিকে আঘাত করে ইসলামী প্রকাশনী গুলোকে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী এবং সফল হবে না।
ভাষা-সাহিত্য চর্চা নিয়ে তরুণদের প্রতি বিশেষ কোন বার্তা দিতে চান কী?
আমীর ইবনে আহমদ: শুধুমাত্র নাম কামানো ও সস্তা খ্যাতি নয় সাহিত্যচর্চাকে একটি মিশন হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এই অঙ্গনকে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য কাজে লাগানো উচিত। এ জন্য গভীর ও নিবিড় সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসতে হবে বলে আমি মনে করি।
সময় দেওয়ার জন্য শুকরিয়া
আমীর ইবনে আহমদ: ইসলামী অঙ্গন ও ওলামায়ে কেরামের শিল্প সাহিত্য চর্চাকে জাতির সামনে উপস্থাপন করা সময়ের দাবি। এটি অত্যন্ত সফল এবং সুফল একটি আয়োজন।এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী।
আওয়ার ইসলাম পরিবারসহ যারাই এ আয়োজন গ্রহণ করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
এটি / এনটি