নুরুদ্দীন তাসলিম ।।
সাম্প্রতিক সময়ে বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনানের ৩ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে কোরআন শরীফ অর্থ না বুঝে মুখস্থ করলে কুরআনের হক আদায় না হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। সেই আলোচনার শেষের দিকে ইংরেজি ভাষা শেখাকে আলেমদের হারাম ফতোয়া দেওয়ার বিষয়টি সামনে এনে তিনি প্রশ্ন করেছেন, এই ফতোয়ার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষিতদের পিছনে ফেলে রাখার দায়ে কাঁধে নেবে কে?
ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে উঠে আসা বক্তা আবু তহা আদনান-এর বক্তব্য অনলাইন অফলাইনে বেশ সমালোচনা তৈরি করেছে। এমন বক্তব্য সাধারণ শিক্ষিত মানুষের সন্তানদের কুরআন শরীফ হেফজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে বলেও মন্তব্য বিশ্লেষকদের। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সরব হয়েছেন তরুণ আলেম থেকে শুরু করে সচেতন মানুষজন ।
‘অনেক সাহাবিই কোরআন বুঝতে নবীজির শরণাপন্ন হয়েছেন’
সাম্প্রতিক সময়ে না বুঝে কোরআন পড়া বিষয়ে আবু তহা মুহাম্মদ আদনানের বক্তব্যটি ভাইরাল হলেও একই বিষয়ে বাংলাদেশে আরও ১০/১২ বছর আগে প্রচারণা শুরু করেছিল কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের এক দায়িত্বশীল-এর পক্ষ থেকে একটি বইও লেখা হয়েছিল যেখানে; ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন না বুঝে পড়াকে কুফুরির গুনাহ বলে’ উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে ব্যাপক লেখালেখি ও প্রতিবাদ করেছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আল-কুরআন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এবিএম হিজবুল্লাহ। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই এমন মন্তব্যকারীদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করেন।
তিনি বলেন, খোদ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যখন সরাসরি কুরআন নাযিল হতো তখনো সাহাবীরাও শতভাগ কুরআন বুঝতেন না। অনেক সাহাবিই কোরআন বোঝার ক্ষেত্রে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরর শরণাপন্ন হয়েছেন, সে যুগের বিজ্ঞ মুফাসসির সাহাবীদের কাছে গিয়েছেন।
তিনি বলেন, রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু নিজেও কিছু কিছু বিষয় বুঝতেন না বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, যখন কুরআনে
وفاكهة وأبا
শব্দটি নাজিল হয়েছিল তখন তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তা বুঝেননি। তিনি এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বেও পড়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, এই শব্দের অর্থ কি তা আমার বুঝে আসুক না আসুক এতে কী যায় আসে, আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন এর উপরে কোন কথা নেই।
'সাহাবীরা যেখানে নিজেরাই অনেক বিষয় বুঝেননি বলে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে না বুঝে পড়াটাই স্বাভাবিক'বলেন তিনি।
‘এখনই সচেতনতা তৈরি করতে হবে’
কোরআন না বুঝে হেফজ করার মাধ্যমে হক আদায় না হওয়ার বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক উল্লেখ করে এই গবেষক আলেম বলছেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনই সরব হতে হবে এবং সচেতনতা তৈরি করতে হবে অন্যথায় পরবর্তীতে বড় ধরনের ফেতনা হওয়ার আশংকা করেছেন তিনি।
‘ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ কুরআনকে غير مخلوق বলার কারণে তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। এ সময় একদিন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন তখন আল্লাহ তাআলা সাথে স্বপ্নে তার সাক্ষাৎ হয়, সে সময় তিনি আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; কোন আমলে আপনি সবথেকে বেশি খুশি হন? উত্তরে বলা হয়েছিল, কুরআন তেলাওয়াতে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ ই প্রশ্ন করেছিলেন অর্থ বুঝে নাকি না বুঝে, উত্তরে বলা হয়েছিল, বুঝে না বুঝে যেকোনোভাবে তেলাওয়াত করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন'। প্রতিবেদক-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঘটনার উদ্ধৃতি টেনেছেন অধ্যাপক মাওলানা এবিএম হিজবুল্লাহ।
আলেমরা কি সত্যিই ইংরেজি ভাষার বিরোধীতা করেছিলেন?
‘আলেমদের ইংরেজি ভাষায় বিরোধিতা বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু কিছু আলেমের বিষয়ে ইংরেজি ভাষাকে নিষিদ্ধ ফতোয়া দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে এ ফতোয়া মূলত কার থেকে এসেছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই’।
‘তবে যাই হোক, এখানে ইংরেজি ভাষা নিয়ে আলেমদের কোন বিদ্বেষ কিংবা বক্তব্য ছিল না, মূলত উপনিবেশ আমলে ইংরেজরা এই অঞ্চলের প্রধান ভাষা ফার্সি কে বিলুপ্ত করেছিল এবং আরবি ভাষাকেও নিষিদ্ধের চেষ্টা চালিয়েছিল তাদের এই অপতৎপরতা রুখতেই তৎকালীন আলেমরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখানে কোন ভাষা বিদ্বেষ কাজ করেনি, সাধারণ মুসলমানরা যেন ইংরেজদের শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে নিজেদের মিশিয়ে না ফেলে এটাই ছিল এই সিদ্ধান্তের মূলে’- আওয়ার ইসলামকে বলেন তিনি।
‘তৎকালীন বাস্তবতা এবং প্রেক্ষাপট না বোঝার কারণে বর্তমানে ইংরেজি ভাষা বিদ্বেষ ও আলেমদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা’ বলেও মনে করেন তিনি।
‘তরুণদের চাহিদা বুঝতে হবে’
বর্তমানে ইউটিউব ফেসবুকের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান না রেখেও অনেকেই বক্তা ও ইসলামিক স্কলার হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন এবং তাদের প্রতি সমাজের একটা শ্রেণী ঝুঁকেও পড়ছে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তরুণদের একটা বিশেষ অংশ এবং জেনারেল শিক্ষিতরা এমন বক্তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন; তবে বিষয়টিকে সরাসরি নেতিবাচকভাবে না নিয়ে পজেটিভলি ভাবতে হবে এবং তরুণরা আসলে কি চাইছে সে বিষয়টি চিহ্নিত করে সেভাবে কাজ করতে হবে। ঢালাওভাবে বিষয়টির বিরোধিতা করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল’ বলে মন্তব্য করেছেন এই গবেষক আলেম।
‘জাতিকে বারবার বিভ্রান্তিতে ফেলেন সাধারণ শিক্ষিত বক্তারা’
একই বিষয়ে জামিয়া আশরাফিয়া দারুল উলুম কুমিল্লার মুহতামিম ও মসজিদে কুবা কান্দির পাড়ের খতিব মুফতি জিলানী বলেছেন, ‘যারা স্বশিক্ষিত হয়ে মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান ছড়াতে চায়, তারা যে জাতিকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেন- এ বিষয়টি বারবার প্রমাণিত হয়েছে এবং বর্তমান ঘটনা প্রবাহও এরই প্রমাণ বহন করছে’।
তিনি বলেছেন, ‘শুধু বর্তমানে নয় অনেক আগে থেকেই একটি গ্রুপ তোতাপাখির মতো এ বিষয়টি মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করছে, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি হরফে দশ নেকী, আলিফ-লাম-মীম এর প্রত্যেকটি শব্দেই আলাদা আলাদা নেকী পাবে পাঠকারী’।
তিনি আরো যুক্ত করেন,‘হুরুফে মুকাত্তায়াত-এর অর্থ কেউ জানে না অথচ প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সওয়াবের কথা বলেছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।এতেই তো তো সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায় যে তরজমা ছাড়াও কোরআন শরীফ পড়লে সওয়াব হবে।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ...
‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে নবী পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ (2)
কুরআনের তেলাওয়াত, মানুষের আত্মশুদ্ধি... জন্য আল্লাহ তারা নবীদের পাঠিয়েছেন, যদি তরজমাসহ কোরআন পড়া উদ্দেশ্য হত তাহলে এখানে তরজমার কথাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হতো -আওয়ার ইসলামকে বলেছেন মুফতি জিলানী।
তিনি আরো বলেছেন, এজাতীয় বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক ক্ষতির প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোমলমতি শিশুদের ছোটবেলা থেকেই হেফজ করানোর যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে বাংলাদেশ -এর কারণে দেখা যাবে হয়তোবা অনেকেই শিশুদের হেফজ করতে চাইবেন না; যেহেতু তারা অর্থ বুঝছে না, আবার অনেক সাধারন শিক্ষিত মানুষও কুরআন পড়া বাদ দিবে যেহেতু তারা কুরআন অর্থ জানেন না। এর মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যাচ্ছে’ বলেন তিনি।
আলেমদের থেকেই শরয়ী বিষয়ের সমাধান খোঁজার আহ্বান
এছাড়া তিনি আরো যুক্ত করেছেন, ‘ধর্মীয় বিষয়ে মানুষকে বোঝানোর জন্য দেশে এখানো পর্যাপ্ত আলেম-ওলামা রয়েছেন যারা শরীয়তের বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখেন। দেশ এখনো এতটা আলম শুন্য হয়ে পড়েনি যে আলেমদের জেনারেল শিক্ষিতদের কাছ থেকে ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে’।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব সময় সর্বোচ্চ ডিগ্রীপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, হাতুড়ে অথবা অল্প শিক্ষিতদের শরনাপন্ন তখনই হয় যখন ভালো ডাক্তার পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই দেশ এখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে এখানে শরীয়তের সঠিক সমাধান নিতে সাধারণ শিক্ষিতদের কাছে যেতে হবে’। তাই সাধারণ মানুষদেরও তিনি এ বিষয়গুলোতে সতর্ক থাকার আহ্বান।
আলেমদের ইংরেজি ভাষা বিরোধিতার বক্তব্য কেন?
আলেমদের ইংরেজি বিরোধিতার নিয়ে যে আলোচনা তৈরি হয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে এই বক্তাদের দুটি বিষয় কাজ করে প্রথমত ওলামায়ে দেওবন্দকে বিতর্কিত করা, অপরটি হলো সমাজে নিজেদের এক ধরনের অবস্থান তৈরি করা’।
‘আলেমদের থেকে জনসাধারণকে দূরে রাখা এবং বুঝানোর চেষ্টা করা যে আলেমদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই ,এই দুই প্রবণতা থেকেই এ ধরনের আলোচনা তৈরি করছেন এই বক্তারা বলেন’ মুফতি জিলানীর।
এ বিষয়ে বক্তা আবু ত্বহা আদনানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বারবার তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
এটি