মোস্তফা ওয়াদুদ::
নিউজরুম এডিটর
দীন না জানা মানুষকে দীন শেখানোর অনেক মাধ্যম আছে। বয়ান বক্তৃতা বা ওয়াজ-মাহফিল তার অন্যতম। বিশ্বের নাতিশীতোঞ্চ দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে শীত মৌসুমে অনেক ওয়াজ-মাহফিল হয়ে থাকে। মাঠে-ময়দানে আয়োজিত হয় এসব মাহফিল। দলে দলে মানুষ আসেন সেসব মাহফিলে। এগুলোতে বয়ান করেন দেশের প্রখ্যাত বক্তাগণ। তারা আলোচনা করেন কুরআন-হাদিস বিষয়ে। তুলে ধরেন ইসলামের চিরন্তন সত্যের কথা। প্রচার করেন রাসূলের বাণী। জনগণের সঙ্গে শেয়ার করেন রাব্বুল আলামিনের বড়ত্ত্বের কথা। সাধারণ মানুষ সেসব শুনেন মনোযোগ দিয়ে। আমল করেন নাজাতের জরিয়া মনে করে।
দেশে করোনার কারণে গতবছর ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ থাকলেও এবছর পুরোদমে চলছে দীন শেখার এ মজমা। সেখানে দেশের নামকরা বক্তাগণ কুরআন-হাদিসের আলোকে বয়ান করছেন। তবে বর্তমানে আমলদার ও ইলমী আলেমদের পাশাপাশি কমেডিয়ান কিছু বক্তাও নেমেছেন ওয়াজের এ ময়দানে। মাহফিলের আয়োজকগণও শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে দাওয়াত দিচ্ছেন তাদের। এতে করে দীন শেখার এ বিশাল ময়দান এখন সমালোচনার পাত্রে পরিণত হতে চলছে। এমতাবস্থায় মাঠে-ময়দানে ওয়াজ-মাহফিলের জন্য কেমন বক্তা প্রয়োজন। বক্তাদের মানদণ্ড কেমন হওয়া উচিত। ওয়াজের মানদন্ডই বা হতে পারে কেমন? এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে দেশের প্রখ্যাত কয়েকজন আলেমের সঙ্গে। তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে নম্র ভাষায় বয়ানের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি ইলমী এস্তেদাদ সম্পন্ন আলেমদের ওয়াজের ময়দানে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।
ওয়াজ হতে হবে নম্র ভাষায়: আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি
ওয়াজ হতে হবে নম্র ভাষায়। নম্র ভাষায় দাওয়াত দিয়ে তাবলিগ জামাত সফলতা পেয়েছে। সুতরাং এভাবেই দীন প্রচার করা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামের মহাপরিচালক আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি।
তিনি বলেন, ওয়াজের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসা। এটাও দাওয়াতের অংশ। তবে এটা প্রচারের দুটি ধারা আছে। এক. মহব্বতের সঙ্গে নম্র ভাষায় মানুষকে সত্য পথে আহ্বান করা; দুই. রাজনৈতিক ভাষায় কঠোরতার সঙ্গে মানুষকে দাওয়াত দেওয়া।
দ্বিতীয় পন্থা আমি পছন্দ করি না। দেখুন, তাবলিগ জামাত নম্রভাবে কথা বলে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। আমি মনে করি, সেভাবেই ওয়াজ করা উচিত। বর্তমানে যেভাবে ওয়াজ করা হয়, আমি আমাদের মুরব্বিদের সেভাবে কখনো ওয়াজ করতে দেখিনি। আর ওয়াজের মূলনীতি কোরআনেই আছে। খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে যখন মুসা ও হারুন আ. কে পাঠানো হয়, তখন এই বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ‘তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে। (এতে) হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সুরা: ত্ব-হা, আয়াত : ৪৪)
ইলমী ও আমলদার ওয়ায়েজদের কদর করা উচিত: শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ
ওয়াজ-মাহফিল যেহেতু একটি দীনি বিষয়, তাই দীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহীনের অনুকরণ করা জরুরি। মানুষের ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি ও আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধনের ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াজ-মাহফিল নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে তা নিজস্ব গতি ও নিয়মে চলে আসছে।
ওয়াজের উদ্যেশ্য কি হবে, ওয়াজ কি ও কেন এটা অনেকেরই অজানা। ওয়াজের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা।
তিনি বলেন, ইমাম গাজালী রহ. তার লিখিত গ্রন্থ ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া হতে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রোতাদের পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ।
তিনি বলেন, বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্য : সেগুলো হলো : ১. ইলম, কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম। ইলমী ও আমলদার ওয়ায়েজদের কদর করা উচিত।
২. আল্লাহর সন্তুষ্ট ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য।
৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা।
৪.বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা।
৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)
কিছু ওয়াজের মাধ্যমে শ্রোতাদের মনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে: মাওলানা হাসান জামিল
রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব ও দারুল উলুম রহমানিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা হাসান জামিল বলেছেন, ওয়ায়েজ বা বক্তা দাওয়াত ও তাবলিগের নিয়তে ওয়াজ করবে। মানুষের হৃদয়ে ঈমানজাগানিয়া আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার নিয়ত থাকতে হবে। ওয়াজের মাধ্যমে যেন শ্রোতা আখেরাতমুখী হয় এমন মাননসিকতা নিয়ে কুরআন-হাদিসের আলোকে বয়ান করতে হবে। অবশ্যই বাড়তি কোন কথা ওয়াজ থেকে পরিহার করতে হবে।
আর শ্রোতাদের মধ্যে এমন মানসিকতা থাকবে যে আমি এমন ওয়াজ শুনব যে ওয়াজে আমার মধ্যে ঈমানী চেতনা জাগবে, আমার দিল আখিরাতমুখী হবে। ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে আমি খুব কাছ থেকে অনেকের পরিবর্তন দেখেছি। অনেকে এসে, ওয়াদা করেছেন যে তারা ঠিকমতো নামাজ আদায় করবে, দাড়ি রাখবে।
তবে কিছু ওয়াজের মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো নিয়ে ইউটিউবে ট্রল হচ্ছে। মজমা জমানোর জন্য অনেকে অশালীন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। যার মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে একটা বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্ত ওয়াজ আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
এমডব্লিউ/