সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ঈদে মিলাদুন নবী পালনের নববী পদ্ধতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যুবায়ের বিন আখতারুজ্জামান।।

একবিংশ শতাব্দীর নব্য জাহিলিয়াতের উত্থানে 'ঈদে মিলাদুন নবী' একটি ভয়াবহ ফিতনা। দিন যত গড়াচ্ছে এই ফিতনা ততই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। একদিকে এটা যেমন বিদাত অন্যদিকে এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ তাআলার বিধানের বিরুদ্ধাচারণ।

জন্মদিন পালনের ইতিকথা

লিখিতভাবে জন্মদিনের কথা প্রথম জানা যায় বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায় থেকে। মিশরের ফারাওদের জন্মদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ছিল মিশরে। বাইবেলে জন্মদিনের কথা বলা থাকলেও সেটি জন্মের দিন নাকি সিংহাসনে বসার দিন সেটি নিয়ে ইজিপ্টোলজিস্টদের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। প্রাচীন মিশরে ফারাওদেরকে ঈশ্বর মনে করা হতো আর সিংহাসনে বসার দিনটিকে মনে করা হতো তাদের মানুষ থেকে ঈশ্বরে রূপান্তরের দিন। তাই ঠিক কোন দিনটির কথা বলা হচ্ছে সেটি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও ফারাও এর জন্মের দিন কিংবা ‘ঈশ্বরে রূপান্তরের দিনটিকে’ বেশ ধুমধামের সাথেই পালন করা হতো। বাইবেলে বর্ণিত এই ফারাও ছিলেন ইউসুফ (আ) এর সময়ের ফারাও, যে সময় ইউসুফকে (আ) যৌন নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণনা থেকে জানা যায়,

“তৃতীয় দিনটি ছিল ফারাউনের জন্মদিন। ফেরাউন তার সব কর্মকর্তাদের জন্য ভোজের আয়োজন করেন। ফেরাউন তার মদ-পরিবেশক ও রুটি প্রস্তুতকারককে ক্ষমা করে দিলেন”। [ওল্ড টেস্টামেন্ট, জেনেসিসঃ ৪০-২০]
সে সময়ে সাধারণ মানুষদের জন্মদিন পালনের কোনো তথ্য ধর্মীয় কিংবা সাধারণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ইউরোপেও জন্মদিন পালন শুরু হয় গ্রীক দেবি আর্টেমিসের জন্মদিনে চাঁদ আকৃতির কেক উৎসর্গ করে। ঠিক কীভাবে জন্মদিনের প্রথা গ্রীসে গিয়েছে সেটা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মিশরীয়দের ফারাওয়ের জন্মদিন পালন করার রীতি অনুসরণ করে গ্রীকরা তাদের দেব-দেবীদের জন্মদিন পালন করা শুরু করে। চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের জন্মদিনের কেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে কেকটিকে উজ্জ্বল করার বুদ্ধিও গ্রীকদের মাথা থেকেই এসেছিল।

ভূমধ্যসাগরের বাইরে পারস্যে সাধারণ জনগনের জন্মদিনের কথা হেরোডোটাসের লেখা থেকে জানা যায়। ধনীরা তাদের জন্মদিনে বেশ বড়সড় ভুড়িভোজের আয়োজন করতো পারস্যে। প্রাচীন ভারত কিংবা চীনে সাধারণ জনগনের জন্মদিনে পালনের তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষ্যে জন্মাষ্টমী বেশ অনেক বছর ধরেই ভারতবর্ষে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে জন্মদিন সেসময় দেব-দেবী কিংবা রাজা-বাদশাহদের জন্মদিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মূলত।

ধর্মীয় বেড়াজালের বাইরে প্রথম জন্মদিনের কথা জানা যায় রোমে। রোমে সাধারণ জনগণ পরিবার ও বন্ধুদের জন্য জন্মদিনের পার্টি শুরু করে। এমনকি বিশেষ ক্ষমতাশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্মদিনে সরকারিভাবে ছুটিও চালু হয়। তবে জন্মদিন পালন শুধুমাত্র পুরুষদের জন্যই ছিল। নারীদের জন্মদিন পালনের কোনো রীতি তখনো চালু হয়নি। ৫০তম জন্মদিন পালনের জন্য ময়দা, মধু, জলপাই তেল ও বিশেষ পনির দিয়ে বিশেষ কেক বানানো হতো।
প্যাগান সমাজে জন্মদিন পালনের রীতি থাকলেও সেমেটিক সমাজে জন্মদিন মোটেও স্বাভাবিক নিয়ম ছিল না। বরং প্যাগানদের থেকে উৎপত্তি হবার কারণে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা প্রথমদিকে জন্মদিন পালনকে শয়তানের রীতি হিসেবে মনে করতো। তবে খ্রিস্টানদের ধ্যানধারণা পাল্টাতে থাকে চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে। প্রথমদিকে কোনো নিয়ম না থাকলেও চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে ঈসা (আ) এর জন্মদিন পালন শুরু করে খ্রিস্টানরা। এর ফলে খ্রিস্টান চার্চগুলো জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। প্রথমদিকে ধর্মীয় চরিত্রগুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষেরাও কেউ কেউ জন্মদিন পালন শুরু করে। বর্তমানে ক্রিসমাস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

ইউরোপীয়ানদের হাত ধরে তাদের মতো জন্মদিন পালন ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো পৃথিবীতে। যেসব সমাজে জন্মদিন পালনে কোনো প্রথা ছিল না তারাও শুরু করে জন্মদিন পালন। তবে জন্মদিন দীর্ঘদিন শুধু ধনীরাই পালন করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মানিতে কেক ও মোমবাতি দিয়ে বাচ্চাদের জন্মদিন পালন শুরু হয়। বাচ্চাদের মোমবাতি দেয়া হতো তাদের যততম জন্মদিন ততোটির থেকে একটি বেশি। এই বেশি মোমবাতিটি দিয়ে তাদের আরো এক বছর আয়ুর আশা করা হতো। মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালনের রীতিও সেসময় থেকেই চালু হয়। সাধারণ মানুষের মাঝে কেক কেটে জন্মদিন পালনের প্রথা শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের ফলে কেক তৈরির উপকরণগুলো সহজলভ্য হওয়াতে। আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্প সময়ে অনেকগুলো কেক বানানো সম্ভব হতো, দামও তুলনামূলক কম থাকতো। ফলে ধনীদের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষেরাও তাদের জন্মদিন পালন শুরু করে।

জন্মদিনের বিখ্যাত গান “হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ” আসলে প্যাটি হিল ও ম্যাড্রেড হিলের সুর করা “গুড মর্নিং টু অল” গানের সুর। ১৮৯৩ সালে সুর করার পর সুরটি আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় হয়। অনেক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এ সুরের সাথে “হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ” কথা জুড়ে দেন প্যাটি হিল। আর এভাবেই ভিন্ন একটি গানের সুর পুরো পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত হয়ে যায় জন্মদিনের গানের সাথে। মজার ব্যাপার, ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত “হ্যাপি বার্থ ডে টি ইউ” গানটি ছিল কপিরাইট করা! অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে এ গানটি ব্যবহার করতে হলে আপনাকে অর্থ দিতে হতো! এ গানটি থেকে মিলিয়ন ডলার ব্যবসাও হয়ে গেছে। তবে ২০১৫ সালে আমেরিকার একজন বিচারক এ কপিরাইটটিকে অবৈধ ঘোষণা করলে কপিরাইটেড অধিকার উঠে যায় গানটি থেকে।
একসময় যে জন্মদিন ছিল শুধুমাত্র দেব-দেবীদের জন্য, সেই জন্মদিন আজ ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই পালন করে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে। আজকাল মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্মদিনও বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়ে থাকে। জন্মদিন উপলক্ষ্যে শুধুমাত্র আমেরিকাতে গিফট কার্ড বিক্রি হয় প্রায় বিশ লক্ষ। বিভিন্ন দিবস কিংবা অন্যান্য কার্ডের থেকেও বেশি বিক্রি হয় জন্মদিনের কার্ড। জন্মদিনের কার্ড ব্যবসার বেশ ভালো একটি মাধ্যম হয় উঠেছে, কেননা সব কার্ডের মধ্যে ৫৮% কার্ডই হয় জন্মদিনের কার্ড।

প্রচলিত ঈদে মিলাদুন নবী

প্রচলিত ঈদে মিলাদুন নবী কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থিত নয়। নবী করিম (স.)-এর জীবদ্দশায় এমন কোনো অনুষ্ঠানে বা দিবসের নযির নেই। শুধু প্রিয়নবী (স.)-এর সময়েই নয় সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও সালফে-সালেহীনদের সময়েও এ-ধরনের কোনো দিবস পালনের কথা পাওয়া যায়নি। তবে জন্মদিন পালনের ইতিহাসকে কুরআন-হাদিসের মানদণ্ডে রেখে 'ঈদে মিলাদুন নবী' নামক দিবসের দিকে তাকালে একথা স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, ঈদে মিলাদুন নবী কেবল বিদাত নয় বরং এটা চরমভাবে ইসলামের অবমাননা।

হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাতের সমপরিমাণ। এমনকি তারা যদি সাপের গর্তে প্রবেশ করে, তা হলে তোমরাও তাদের পেছন পেছন যাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইহুদি ও নাসারাদের অনুকরণ করার কথা বলছেন?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তবে আর কার?’ (বুখারি : ২৬৬৯)

অন্য একটি হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির নমুনা অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই দলভুক্ত।’ (সহিহুল জামে : ৬০২৫)

নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছেড়ে অন্য কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর না, খ্রিস্টানদেরও সাদৃশ্য অবলম্বন কর না।’ (সিলসিলাহ সহিহা : ২১৯৪)

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারও অনুসরণ কর না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সূরা আরাফ : ৩)
জন্মদিন বা ঈদে মিলাদুন নবী দুটোই ইসলাম বহির্ভূত কাজ।

তবে কী সেই নববী পদ্ধতি?

হ্যাঁ, ঈদে মিলাদুন নবী পালনের একটা নববী পদ্ধতি রাসূল (স.) বাতলে গেছেন। তবে সেটা বাৎসরিক নয়; বরং সাপ্তাহিক। হাদিস থেকে সোমবার রোজা রাখার সম্পর্কে অনেক ফজিলত জানা যায়।

হাদিসে এসেছে, আবূ ক্বাতাদাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসুল স-এর কাছে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ঐদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং ঐদিন আমার উপর (কুরআন) নাযিল হয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৪০)

অপরদিকে এই সোমবারে রাসুল (স.)-এর মৃত্যু দিবস।

আনাস ইব্‌নু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

মুসলিমগণ সোমবার (রাসুল (স.)-এর ওফাতের দিন) ফজরের সালাতে ছিলেন, আবূ বকর (রাঃ) তাঁদের নিয়ে সালাত আদায় করছিলেন। নবী স. ‘আয়িশা (রাঃ) -এর হুজরার পর্দা সরিয়ে তাঁদের দিকে তাকালেন। তখন তাঁরা সারিবদ্ধ ছিলেন। তা দেখে তিনি মৃদু হাসলেন। তখন আবূ বকর (রাঃ) তাঁর গোড়ালির উপর ভর দিয়ে পিছে সরে আসলেন। তিনি ধারণা করলেন যে, আল্লাহর রাসুল (স.) সালাতের জন্য আসার ইচ্ছা করছেন। নবী (স.)-কে দেখার আনন্দে মুসলিমগণের সালাত ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন তিনি সালাত সুসম্পন্ন করার জন্য তাদের দিকে হাতে ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর তিনি হুজরায় প্রবেশ করেন এবং পর্দা ছেড়ে দেন আর সে দিনই তাঁর মৃত্যু হয়। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১২০৫)

আপনি প্রিয়নবী (স.)-এর উপর ভালোবাসা প্রেরন করবেন তাতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রাসুল (স.)-এর প্রতি ভালোবাসা কেন বছরে একবার?! রাসুল (স.)-এর জন্মের খুশিতে কিংবা মৃত্যুর শোকে প্রতি সোমবার আপনি রোজা রাখুন এতে আপনারই লাভ। প্রথমত, আপনার পাপ মোচন হবে আর দ্বিতীয়ত, এটা হবে আপনার রাসুল (স.)-এর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ঈদে মিলাদুন নবী পালন করা কতটা যৌক্তিক তা সিরিয়া, লিবিয়া, মিয়ানমার, চীন,ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরসহ বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিমদের ক্ষুদার্ত চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যায়।
আল্লাহ সকলকে বোঝার তাওফিক দান করুন।

এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ