বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা মহামারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম নীতি মেনে চলছে পৃথিবী। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। ধাপে ধাপে লকডাউনে যাচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের এ ছোট দেশ। এদিকে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হয়ে এখন চলছে তৃতীয় ঢেউ। বাংলাদেশে করোনা শুরুর পর সরকার গতবছরের ১৭ মার্চ বন্ধ করে দেয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর সে বছরের ১২ জুন দেশের কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দিলেও চলতি বছরের ৮ এপ্রিল আবার বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে সীমিত পরিসরে জারী করা চলমান লকডাউন থাকবে আগামী ১৬ জুলাই পর্যন্ত। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত।
এ দীর্ঘ সময় সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন জারী থাকলেও বন্ধ রয়েছে দেশের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার ও প্রায় ৪০ হাজার কওমি মাদরাসায় খেদমাত করা শিক্ষকদের বেতন। শিক্ষকদের বেতন দিতে না পেরে চরম উৎকণ্ঠার মাঝে সময় পার করছেন মাদরাসার মুহতামিমরা। করোনাকালের এ বেদনার কথাই আওয়ার ইসলাম তুলে ধরবে নিয়মিত। আজ থাকছে দেশের দুইজন মুহতামিমের সাক্ষাতকার। তাদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেনআওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদ।
এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম রাজধানীর মাদরাসাতুল কাসিম আল ইসলামিয়া ও গোলাপবাগ মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ফয়জুল্লাহ এর সঙ্গে। উজানী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ক্বারী ইব্রাহিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এর বংশধর মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আমার মাদ্রাসা ভাড়ায় পরিচালিত। প্রতি মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা ভাড়া গুণতে হয়। দীর্ঘদিন মাদ্রাসাগুলো বন্ধ থাকায় ভাড়া পরিশোধ করতেই হিমশিত খাচ্ছি। এতে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গিয়েছে। আঁটকে আছে শিক্ষকদের বেতন। এ মাদরাসায় মোট ৪০ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের বেতন দিতে পারছেন না তিনি। এ নিয়ে চরম বিপাকে আছেন এ মাদরাসার মুহতামিম।
সারাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মুহতামিমদের উদ্দেশ করে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করতে হবে। কিছুদিন আগে আমরা একটি পোস্টার ছাপিয়েছি। সেখানে এ বিষয়টা আমরা তুলে এনেছি। এছাড়া মাদরাসার মুহতামিমগণ যেন সবাই মিলে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান এর কাছে একটি আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। এবং এর সাথে আরও যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন, বিশেষত ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদসহ গত পর্বে মাদ্রাসাগুলো খোলার বিষয়ে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তারাও এই বিষয়ে সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে সরকারের কাছে দাবি করে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া নিজেদের জন্যই জরুরী। দেশের মাটি ও মানুষ সবার সুবিধার জন্যই মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া আবশ্যক। কেননা কওমি মাদ্রাসায় পবিত্র কোরআনুল কারীমের পাঠদান করানো হয়। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকতের স্রোতধারা এদেশে পুনরায় প্রবাহিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
কথা বলেছিলাম চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার জামিয়া ইসলামিয়া কচুয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবু হানিফ এর সাথে।
তিনি বলেন, করোনাকালে আল্লাহ আমাদের যেমনি রেখেছেন, কিন্তু আামাদের ছাত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের পড়াশোনায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়টা আমাকে চরমভাবে পীড়া দিচ্ছে। কত কষ্ট-মেহনত করে ছাত্রদের গড়েছি। দীর্ঘদিন মাদ্রাসা বন্ধ। এতে ছাত্ররা পড়াশোনার সাথে ততটা সম্পৃক্ত না থাকায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা তাদের পড়াশোনায় ,গ্ন রাখার জন্য আমাদের শিক্ষকদের জামাতভিত্তিক একটি নেজাম বানিয়ে দিয়েছি।
আর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি বলি তাহলে, মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন আগেও বকেয়া থাকত। তবে এবারের বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। মাওলানা আবু হানিফ পরিচালিত এ মাদরাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে ১০০০ জন (এক হাজার) জন। শিক্ষকসহ স্টাফ রয়েছেন ৫০ জন। শিক্ষার্থীদের থেকে সামান্য বেতন ও এলাকার বিত্তবানদের থেকে কালেকশনের মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও খোরাকির ব্যবস্থা করানো হতো। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘদিন মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় কমে গেছে এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দান। আর শিক্ষার্থীদের বেতন তো নেইই। এ নিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখেই আছেন কচুয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আবু হানিফ।
সারাদেশের মাদরাসা মুহতামিমদের পরামর্শ দিয়ে এ মুহতামিম বলেন, মাদরাসার মুহতামিমগণ যেন হতাশ না হন। বরং দিলকে বড় রেখে আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া জারী রাখেন। আল্লাহ তায়ালা যেন অতিশীঘ্রই মাদ্রাসাগুলো খোলার ব্যবস্থা করে দেন এবং করোনা মহামারী দূর করে দেন। আর দ্বিতীয় পরামর্শ হলো, থানাভিত্তিক যেসকল মাদ্রাসাগুলো রয়েছে, সকল মুহতামিমগণ নিজেদের ভেতরে পরামর্শ সাপেক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করে যেনো চলেন। তাহলে একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসতে পারবেন।
সবশেষ সরকারের কাছে দাবী করে কচুয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আবু হানিফ বলেন, সরকার যেনো দ্রুত মাদ্রাসাগুলো খুলে দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি একটাই। মাদরাসাগুলো বন্ধ নয়; খোলা চাই।’
এমডব্লিউ/