অনুবাদ: মুহাম্মদ উমর ফারুক ইবরাহীমী
[জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।
এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানকিভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।
আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি প্রতি রোববার ও বুধবার প্রকাশ হবে ইনশাল্লাহ। আজ ছাপা হলো ২৫ তম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ উমর ফারুক ইবরাহীমী।]
পূর্ব প্রকাশের পর: আমি ইতোপূর্বে বলে এসেছি, দেওবন্দে হযরত আব্বাজান মুফতি মুহাম্মদ শফি সাহেব রহ. ব্যবসার উদ্দেশ্যে "দারুল ইশা'আত" নামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তান হিজরতের সময় অগত্যা সেটি দেওবন্দেই ছেড়ে আসতে হয়েছিলো। আমার ভাইজান জনাব মুহাম্মদ জাকি কাইফি রহ. লাইব্রেরিটি দেখাশোনা করতেন।
প্রথমত লাইব্রেরির আয়-উপার্জন ছিলো খুবই সীমিত, দ্বিতীয়ত সেটিকে পাকিস্তান স্থানান্তরের কোন উপায়ন্তু ছিলোনা। পাকিস্তান আসার পর হযরত আব্বাজান রহ. কিভাবে যেনো ছোটো-খাটো কয়েকটি পুস্তিকা ছেপে ছিলেন।
কিন্তু তখনকার সময়ে যারা পাকিস্তান এসেছিলেন তাদের মধ্যে উর্দু জানেন এমন লোকের সংখ্যা ছিলো হাতেগোনা কয়েকজনমাত্র। এবং তাদের জন্য নিজের অন্ন-বাসস্থান যোগার করাই ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে উর্দু কিতাবের চাহিদাও এতোটা ছিলনা যে মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যয় উঠানোর পর কিছু আয়-রোজগার হবে।
এহেন আর্থিক দৈন্যতার পাশাপাশি আব্বাজান রহ.কে আরো একটি দুশ্চিন্তা সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতো। সেটি হচ্ছে তাঁর কমযোর, রোগাক্রান্ত বৃদ্ধা মা, যাকে তিনি হিজরতকালে হিন্দুস্তানে রেখে এসেছিলেন এখন কিভাবে তাকে পাকিস্তানে আনবেন?
মরহুমা দাদীজান হযরত গাংগুহি রহ. এর কাছে বায়'আত ছিলেন। আমরা গোটা জীবনে কখনও তাকে আল্লাহর জিকিরবিহীন পাইনি। এমনকি তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে "আল্লাহ্,আল্লাহ্"র মধুর গুঞ্জরন আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পেতাম। আব্বাজান কালবিলম্ব না করে দ্রুত তাকে পাকিস্তান নিয়ে আসার ব্যবস্থাপনা করতে চাচ্ছিলেন। অপরদিকে দাদীজান রেলভ্রমণেও সক্ষম ছিলেননা।
ওদিকে ভাইজানও আমাদের দেওবন্দের বাড়ীতে একাকী হয়ে পড়েছিলেন। ভাইজানের বয়স তখন বড়জোর বাইশ বা চব্বিশ বছর হবে। দেওবন্দে আব্বাজানের লাইব্রেরি দারুল ইশায়াতের যাবতীয় কাজকর্ম তিনিই দেখভাল করতেন।
বাবা-মা,ভাইবোন থেকে দূরে থাকাবস্থায় তার অনুভূতিইবা আর কেমন থাকবে! তখন তিনি মানুষিকভাবে কতোটা বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত ছিলেন নিন্মোক্ত শ্লোক থেকে তা কিছুটা আঁচ করা যায়।
ঈদ ঘনিয়ে এলে তিনি দেওবন্দ থেকে আমাদের ভাইবোনদের নামে একটি বিরহকাতর কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে ভাইজান কবিতার মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। কবিতার কয়েকটি পংক্তি আজও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে-
مانا کہ میں دل درد کا خوگر ہی بنا لوں
لیکن جو خلش چھپ نہ سکے، کیسے چھپا لوں
تم عید کی خوشیوں سے کرو گھر میں چراغاں
میں اپنا ہی دل اپنے ہی داغوں سے سجا لوں
ماں.باپ جدا،بھائ بہن پاس نہیں ہیں
ایسے میں بتاؤ کہ میں کیا عید منالوں؟
হৃদয়কে না-হয় বেদনার আঁতুড়ঘর বানিয়ে নেবো!
কিন্তু, অনিরুদ্ধ যাতোনা বলো কীভাবে লুকাবো!?
ঈদের আনন্দে তোমাদের গৃহে জ্বলে শামাদান।
আমি না-হয় হৃদয়খানা ছাই-ভস্মেই সাজালাম!
মা,বাবা কাছে নেই,ভাইবোনও চোখের আড়ালে।
বলো, তবে আমি ঈদ মানাবো আর কাকে নিয়ে!?
আব্বাজান রহ. এর জন্য দুশ্চিন্তার তৃতীয় বিষয় ছিলো আমাদের শিক্ষাদীক্ষা। আমরা চার ভাই যারা আব্বাজানের সাথে পাকিস্তান চলে এসেছিলাম সবার শিক্ষাদীক্ষার প্রয়োজন ছিলো।
আর তখন পুরো করাচিতে "মহল্লা খাড্ডা"য় মাজহারুল উলূম নামে একটিমাত্র মাদরাসা ছিলো। তাও আবার সেটি ছিলো আমাদের বাসা থেকে যথেষ্ট দূরে। ফলে সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করা আমাদের জন্য সহজবোধ্য ব্যপার ছিলোনা।
ওদিকে আব্বাজানের জন্য সবচে বেশী কষ্টের কারণ ছিলো, দেওবন্দ থেকে হিজরত করে আমরা যে এলাকায় এসে উঠেছি, সেখানে বেশিরভাগ ইংরেজ এবং পার্সিদের বসবাস ছিলো। অল্পসংখ্যক মুসলমান থাকতেন। সে বেচারারাও 'ইল্লা মাশাল্লাহ' দ্বীন সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখতেন না। সে এলাকায় দূর বহুদূর পর্যন্ত কোন মসজিদের দেখা মিলতোনা।
প্রথমে আব্বাজান রহ. জামা'আতে শামিল হবার জন্য দূরবর্তী মসজিদে তাশরিফ নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর উদ্যোগে একটি ছাপড়া বানিয়েছিলেন।
সেখানে পাঁচওয়াক্ত নামায জামা'আতের সাথে শুরু হয়ে গেলো। এরপর ধীরেধীরে মসজিদের জন্য ছাপড়া বরাবর গলিতে একটি জায়গারও ব্যবস্থা হয়ে গেলো। সেখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এবং আজ অবধি মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলহামদুলিল্লাহ।
আরেকটি সমস্যা এটিও ছিলো, রোজ হিন্দুস্তান থেকে মুহাজিরদের কাফেলা করাচি এসে পৌছতো। তাদের মধ্যে আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজনও ছিলেন। এবং আব্বাজান ছাড়া তাদের এখানে কোন আশ্রয়স্থলও ছিলোনা।
ফলে তারা প্রায় স্থায়ীভাবে আমাদের ঘরের মেহমান হয়ে থাকতেন। তাদের চাকরিবাকরিসহ যাবতীয় দায়দায়িত্বও আব্বাজানের কাঁধে ছিলো। এছাড়াও আব্বাজান বিচ্ছিন্নভাবে আসা মুহাজিরদের পাশে থাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন।
মোটকথা, আব্বাজান রহ. নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে সয়ে কালাতিপাত করছিলেন। তিনি কিভাবে সে দুঃখসময়ের মুকাবিলা করেছেন আজ তার কল্পনাও আমাদের জন্য দুরুহ ব্যাপার।
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক আমাদের জন্য একজন স্নেহপ্রবণ পিতা। ঘরের লোকেরা হামেশাই তাকে প্রফুল্লচিত্ত, সহাস্যমুখ দেখতেন। বরং আমাদের মনোতুষ্টির জন্য কখনো আমাদেরকে আনন্দভ্রমণেও নিয়ে যেতেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ....
১-থেকে ২৪ পর্যন্ত সবগুলো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
-ওআই/আবদুল্লাহ তামিম