বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ইসলামী ঐক্যজোটের ২৯ বছর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহা. আবদুল লতিফ নেজামী।।

ইসলামী ঐক্যজোটের ২৯ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ২২ ডিসেম্বর। ২৯ বছর আগে ৬টি সমমনা ইসলামী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ১৯৯০ সনের ২২ ডিসেম্বর মীরপুরস্থ আরজাবাদ মাদরাসায় ইসলামী ঐক্যজোট গঠনের মাধ্যমে ইসলামী ঐক্যের চিরন্তন চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

যেসব দেশবরেণ্য ইসলামী রাজনীতিক ও উলামায়ে-কেরাম ইসলামী ঐক্যজোট গঠনে অবদান রেখে গেছেন, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মরহুম মাওলানা আশরাফ আলী ধরমণ্ডলী, খেলাফত মজলিশের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ., জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির মাওলানা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রহ., ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (ইসলামী আন্দোলন) মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম রহ., ফারায়েজী আন্দোলনের আমির পীর মোহসেন উদ্দিন দুদু মিঞা রহ. ও শাহ আহমদ উল্লাহ আশরাফ রহ. আমির, খেলাফত আন্দোলন।

মরহুম খতীব মাওলানা উবায়দুল হক সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৭ সালে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. ইসলামী ঐক্যজোটে যোগদান করেন।

মুফতি আমিনী রহ. যোগ দেয়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট বিশেষভাবে বিকশিত ও প্রাণবন্ত হয়। এর আগে আমিনী রহ. কে ইসলামী ঐক্যজোটের নির্বাহী চেয়ারম্যানও করা হয়েছিল। উপরোক্ত দেশবরেণ্য ও প্রথিতযশা উলামায়ে কেরাম ইসলামী ঐক্যজোটের প্রথমে সমন্বয়কারী ও পরে চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করে গেছেন।

তাছাড়া অধ্যক্ষ মাসুদ খান, মাওলানা শামসুদ্দিন কাছেমী রহ., জনাব এআরএম আবদুল মতিন, মাওলানা আবদুল লতিফ চৌধুরী, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান ও মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মাওলানা জহিরুল হক ভূইয়া, আজম খান প্রমূথ ইসলামী ঐক্য জোটের প্রথমে সদস্য-সচিব ও পরে মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি ও মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ইসলামী ঐক্যজোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনিও এই জোটের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে কাজ করে গেছেন।

ইসলামী ঐক্যজোটকে তদারক করার জন্যে চট্রগ্রামের আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ. ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল মান্নান কাশিয়ানী রহ.’র সমন্বয়ে একটি সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল।

তাছাড়া মাওলানা আবদুল হাফিজ মক্কী রহ.’র প্রচেষ্টায় ইসলামী ঐক্যজোটের একক প্রতীক ‘মিনার’ নির্ধারিত হয়। কেননা ১৯৯১ সনের নির্বাচনে জোটের শরীক দলগুলোর প্রার্থীরা নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেন।

ইসলামের শাশ্বত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের চেতনা সঞ্জীবিত করা, দেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও শাসন কায়েম, সকলকে ইসলাম নির্দেশিত সার্বজনীন একাত্মবোধে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালানো এবং ইসলামী চেতনার বিকাশ ও পুনর্জাগরণের চেতনাকে সঞ্জীবিত করা এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের চিরন্তনী সংগ্রামের ধারা অব্যাহত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল।

তাছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটের আরো লক্ষ্য হচ্ছে সুষ্পষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সকল ইসলামী দল, সংগঠন ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য নির্বিশেষে সকলকে একটি ঝান্ডার নিচে একত্রিত করা এবং ইসলামী রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাওয়া। স্বীয় আদর্শ ও নীতিবোধে নিয়ত নিষ্ঠাবান এবং চিরকাল আপসহীন থাকতে অঙ্গীকারাবদ্ধ ইসলামী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠিত হয় অনলস কর্মের প্রেরণা নিয়ে। ইসলামী ঐক্যজোটের আরো লক্ষ্য হচ্ছে নবী প্রেমে উচ্ছলিত আত্ম-প্রত্যয় সিদ্ধ চিত্তে তরঙ্গ সৃষ্টি করা। সেই সাথে তৌহিদী জনতার চিত্তকে ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করা।

এব্যাপারে প্রত্যেকের মধ্যে আন্তরিকতা গড়ে তোলা এবং এক সাথে কাজ করার একটি কর্মপদ্ধতি, ঐক্য বা সমঝোতা সৃষ্টি করা, ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে অহেতুক বিভক্তির অবসান, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রক্রিয়া হিসেবে ইসলামী ঐক্যজোটের উত্থানকে অনিবার্য করে তোলে।

ইসলামী ঐক্যজোট মনে করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলামী আন্দোলনকে প্রাণবন্ত করার অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। এসব লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী ঐক্যজোট নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ইসলামী ঐক্যজোট যেকোন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যূর আন্দোলনে স্বক্রিয় থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোট সকল বাধা বিপত্তির জাল ছিন্ন করে রাজনীতির মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রেরণা সৃষ্টি, জনগণের মাঝে ইসলামী জাগরণের বিপুল আবেগ-উদ্দীপনা ও নব জাগরণের চেতনা জাগ্রত এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি জনগণের মধ্যে নব সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে।

তাই ইসলামী ঐক্যজোট ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার একটি দৃঢ় প্রত্যয়। এর প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের মধ্যে রয়েছে মহানবী সা. এর মর্যাদার পতাকাকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃঢ়সঙ্কল্পতা। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকে বেষ্টন করে নেতাকর্মীদের মনন বিশেষ তাৎপর্য চেতনায় সমৃদ্ধ করতে ইসলামের নিশান-বরদার ইসলামী ঐক্যজোট শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগ্রামের প্রতি বিশ্বস্ত ও অবিচল থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীরা ভীত-সন্ত্রস্ত নয়, আন্দোলন থেকে পিছপা হচ্ছে না, হবেও না।

এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইসলামী ঐক্যজোটের তৎপরতা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। একথা অনস্বীকার্য, পবিত্র কুরআনের ধারক-বাহক এবং ইসলামের পক্ষে অনড় অবস্থানের কারণেই ইসলামের নিশান-বরদার ইসলামী ঐকজোটকে শেষ করে দেয়ার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। কারণ সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে পবিত্র কুরআন নির্দেশিত পথে জোট শক্তি ও সাহস যোগাচ্ছে।

ইসলামী ঐক্যজোট নিছক একটি রাজনৈতিক জোটের নাম নয়, বরং ইসলামী জাগরণের একটি প্রক্রিয়া। এর আবির্ভাব ইসলামী রাজনীতির দিশারী হওয়া। এর প্রধান কারণ, এই জোট রাজনীতির মধ্য দিয়ে ইসলামী প্রেরণা সৃষ্টি করতে চায় এবং ইসলামী আদর্শের আলোকে জীবন চেতনার গতিবান, সবল ও সাহসী প্রকাশ ঘটাবার প্রয়াস পায়। এই জোটের রাজনীতিতে ধ্বনীত হয় ইসলাম প্রতিষ্ঠার শ্লোগান শৃংখল ভাঙ্গা বজ্র-নির্ঘোষ আর অত্যাচার নির্যাতন ও জীবনের দুর্বিসহ লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সবল ও সাহসী প্রতিবাদ।

ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. দীর্ঘ ২২ মাস গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে মুফতি আমিনী রহ. জাতি ও জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল থেকে নিঃসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে নির্জলা সত্যকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন।

ইসলামী ঐক্যজোটের অতীত ও প্রতিশ্রুতিশীল বর্তমানের ভিত্তিভূমে গড়ে উঠেছে এর পরিচিতি। এই জোটের রয়েছে বিবর্তনের ধারাকে বুকে ধারণ করে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলার মানসিকতা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বহু ঘাত-প্রতিঘাত, বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে ইসলামী ঐক্যজোট। ক্ষণিকের জন্যেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সযত্নে লালিত আদর্শ ও স্বপ্ন থেকে সরে যায়নি। আজো রয়েছে তেমনি অবিচল আদর্শ, স্বপ্ন ও লক্ষ্যে। শত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে জোটের কার্যক্রম অম্লান রাখতে বদ্ধপরিকর।

স্পষ্টভাবে জনগণের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক-স্বাতন্ত্র্য এবং ঐতিহ্যকে উর্ধ্বে তুলে ধরে এদেশের জনগণের চেতনায় ও ঐতিহ্যে ইসলামের অবদানকে সামনে আনা এবং আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকারকে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ রূপ দেয়া । তাছাড়া সকল প্রকার ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা রোধ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী ও উপনিবেশবাদীতার বিরোধীতা এবং বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামী চেতনার আগুনকে প্রজ্জলিত করার লক্ষ্যে ইসলামী ঐক্যজোট কাজ করে যাচ্ছে।

অতি সংক্ষেপে ইসলামী ঐক্যজোটের কর্মসূচীর সাধারণ নীতিগত দিক হচ্ছে, দেশের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং উপমহাদেশীয় আগ্রাসন মোকাবেলায় সময়োপযোগী কর্মপন্থা গ্রহণ প্রভৃতি।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজাটের সমন্বয়ে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক চার দলীয় জোট গঠনে ইসলামী ঐক্যজোটের ছিল স্বক্রিয় তৎপরতা। ইসলামী ঐক্যজোট ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক মিনারে নির্বাচন করে সিলেটের জকীগঞ্জ-কানাইঘাট আসন থেকে মাওলানা উবায়দুল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৯৬ সনের নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন (পাবনা -পাথরঘাটা) থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী গোলাম সরওয়ার হিরু সংসদ সদস্য নিবাচিত হন। তাছাড়া ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের মনোনীত ও চার দলীয় প্রার্থী হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল) আসন থেকে মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী, যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে থেকে মুফতি মুহাম্মাদ ওয়াক্কাছ, নড়াইল-২ আসন থেকে মুফতি শহিদুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জ থেকে মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেষোক্ত দু’জন উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

যেসব উলামা-মাশায়েখ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীরা ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে এদেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে গেছেন, ইসলামী ঐক্যজাটের ২৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলামী ঐক্যজোট।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ