শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


তাকফির: একজন ভীতু মানুষের কথন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসা আল হাফিজ ।।

একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘কাতারে অবস্থানরত অমুক স্কলারকে আপনি কি মুসলিম মনে করেন?’

মানুষ নিজের ঈমান-ইসলামের দিকে যখন কম মনোযোগী হয়, তখন অন্যকে কোন ছিদ্র দিয়ে ইসলামের বাইরে ফেলে দেয়া যায়, সেই দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে!

বললাম, ভাই, ‘‘আমি তো ভীত থাকি, নিজের ঈমান কমতে কমতে কোন তলানিতে ঠেকছে, সেটা নিয়ে। যেখানে হজরত আবু বকর রা. হযরত হানজালা রা. নিজের মধ্যে নেফাক থাকার শঙ্কায় হন ভীত, ওমর রা. লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, হুযাইফা রা. এর কাছে রক্ষিত মুনাফিকদের তালিকায় তাঁর নাম আছে কিনা, সেখানে আমি কোন নচ্ছার? কীভাবে আমি ঈমান-ইসলামে নিজের যথার্থতা নিয়ে নিশ্চিত হবো?

যেখানে নিজের দী নের কমতি একেবারে চরমে, খোদাভীতি কালমা’দুম পর্যায়ে, আমল একেবারে মৃতপ্রায়-সেখানে আমি নিজেকে নিয়ে না ভেবে কীভাবে অমুক-তমুককে সার্টিফিকেট দেবো?’’

যেখানে প্রায় দশজন সাহাবী থেকে সহী সনদে এ ব্যাপারে হুশিয়ারী বর্ণিত আছে, স্পষ্ট বলা হয়েছে, কাফের হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে কাফির বলা অবৈধ, নিজের ঈমানের জন্য বিপজ্জনক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়াসাল্লাম হতে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেছেন, কোনো ব্যক্তি তার অপর ভাইকে কাফির বলে সম্বোধন করলে এ উক্তি তাকেসহ দুইজনের একজনের দিকে ফিরে আসবে।’’ (বুখারী-মুসলিম)

অন্য হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে- ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি তার সাথীকে বলে, এ কাফির, তাহলে কথাটি উভয়ের কোনো একজনের জন্য অপরিহার্য হয়ে যাবে। যাকে বলা হচ্ছে, সে যদি সত্যিই কাফির হয়, তাহলে সে কাফির। না হয় কাফির বলে সম্বোধনকারী কাফির হয়ে যাবে।’’ (মুসনাদে আহমদ)

প্রিয় নবীর সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়াসাল্লাম ঘোষণা - ‘‘কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে কাফির বলে আখ্যা দিলে তাদের দু’জনের যে কোন একজন কাফির বলে গণ্য হবে।’’ (মুসনাদে আহমাদ)

যেখানে নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়াসাল্লাম থেকে সাবিত ইবনে দাহ্হাক রা. বর্ণনা করেন- যদি কেউ কোনো মুমীনকে কুফুরীতে অভিযুক্ত করে, তবে তা তাকে হত্যা করার মতোই অপরাধ হবে। ( বুখারী) সেখানে আমি কোন সাহসে কাউকে কাফির বলবো?

তবুও সে নাছোড়। বললো, ‘‘তাকফিরের ব্যাপারটি কি দ্বীনের অংশ নয়?’’

বললাম - ‘‘অংশ বটে! এবং দ্বীননির্দেশিত বিষয় সেটা। একারণেই এ ব্যাপারে সলফে সালেহীন-অবলম্বিত অবস্থানেই আমি থাকতে চাই।’’

জানতে চাইলো- ‘‘ তাদের কোন অবস্থান সেটা ?কার অবস্থান?’’

বললাম, ’’ সেটা ভারসাম্যের অবস্থান। প্রধান মুজতাহিদদের অবস্থান।

তাকফিরপ্রশ্নে ইমাম মালিক রহ. এর বক্তব্য অনন্য। তিনি বলেছেন- নিরান্নব্বই দিক থেকে যদি কোনো মুসলিমকে কাফির বলে দেয়ার সুযোগ থাকে আর একটি দিকে ঈমানদার বলার সুযোগ থাকে,তাহলে আমি মুসলমান সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণের লক্ষ্যে তাকে ঈমানদার বলবো।’’

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর অবস্থান লক্ষ্যণীয়।জাহমিয়্যা নামক বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের আলেম ও বিচারকদের তিনি বলেছিলেন-‘‘তোমরা যে সব কথা বলো, তা যদি আমি বলি, কাফির হয়ে যাবো।কিন্তু তোমরা বলছো, তবুও
তোমাদের আমি কাফির বলবো না। কারণ আমার বিচারে তোমরা অজ্ঞ, (দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত)।’’

ইমাম আবু হানিফার রহ. অবস্থান লক্ষ্যণীয়।আল ফিকহুল আকবরে তার ভাষ্য - ঈমানের দাবিতে যে অটল, সে জেনে-বুঝে কুফুরি করবে না, এটাই ধরে নিতে হবে।কারো বক্তব্য বা কাজ যদি বাহ্যিক বিচারে কুফুরি মনে হয়, তাহলে তার ইসলামসম্মত কোনো ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হলে, ব্যাখ্যা দূরবর্তী হলেও একে অবলম্বন করে তাকে মুমীন বলে ধরে নিতে হবে।’’

অতএব কাউকে কাফির আখ্যাদান গুরুতর একটি বিষয়। বরং কুফুরির পর্যায়ে পড়ে, এমন কিছু কোনো মুসলিম থেকে ঘটে গেলে আমি কাজটিকে কুফুরি বলতে পারি। কিন্তু লোকটিকে কাফির বলার আগে আমার কানে বেজে উঠে ইবনে তাইমিয়ার রহ. সতর্কবার্তা।

তিনি বলেছেন- মৌখিক বক্তব্য কখনো কুফুরির পর্যায়ে চলে যায়। এমন বক্তাকে কুফুরি আখ্যাদান হতে পারে এভাবে - যে ব্যক্তি এমন বলবে, সে কাফির! কিন্তু কোনো মুসলিম যদি কুফুরি কথা বলে, নির্দৃষ্টভাবে তাকে কাফির বলা যাবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত তার বিপক্ষে এমন দলীল প্রতিষ্ঠিত না হবে,যা তাকে কাফির বলে প্রমাণ করে।’’

ইমাম আবু হানিফার রহ. পরামর্শ আমার কানে বাজে।আল ফিকহুল আকবরে তিনি লিখেছেন- ‘‘ঈমানের দাবিদার যদি কুফুরি বা শেরেকি কাজে জড়িয়ে পড়ে, তার কাজকে কুফুরী বলা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে কাফির বলার আগে এ বিষয়ে তার ওজর আছে কিনা, জানতে হবে। অজ্ঞতা, ভয় বা অন্য কোনো কারণে এমনটি করলে সে ওজর গ্রহণযোগ্য। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কাছে এটা ইসলামের অন্যতম মূলনীতি।’’

ইমাম আবু হানিফা রহ. যাকে বলেছেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্যতম মূলনীতি’, তাকে অবজ্ঞা করে কে হতে পারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধারক? ইমাম নাবাভী রহ. সহী মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে একে বলেছেন ‘‘হকপন্থীদের মাযহাব’’। নাবাভী লিখেন- জেনে রাখুন, হকপন্থীদের মাযহাব এই যে, গুনাহের কারণে কিবলাপন্থী কোনো ব্যক্তিকে কাফির আখ্যা দেয়া যায় না।’’

কোনো মুমীনকে কাফির বলতে আমি এ কারণে ভীত থাকি। আমি একজন ভয়কাতর মানুষ। কোন মুসলিম স্কলার কাফির হয়ে গেলেন, এমন দু:সাহসী প্রশ্নের জবাব ভীতু মানুষ থেকে আশা করে লাভ হবে না।’’

লোকটি নাখোশ হলেন এবং আমাকে মনে মনে এই সেই ... ভাবতে ভাবতে বিদায় নিলেন।

লেখক : কবি ও গবেষক

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ