শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কুরআন মাজিদ ও হাদীসে কুদসীর ব্যবধান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসা আল হাফিজ


সম্ভবত হাদীস বিভাগে পড়াশোনা করে। আমার এলাকার ছেলে। প্রায়ই হাদীস সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন ম্যাসেজ করে। গতকালের প্রশ্ন ছিলো, আল কুরআন আল্লাহর বাণী। সেটা যদি কাদীম বা অনাদী হয়, হাদীসে কুদসীও তো আল্লাহর বাণী। তা কেন অনাদী হবে না?

ছেলেটির আগ্রহে আল্লাহ তায়ালা বারাকাত দিন। আ মী ন। মনে হলো বিষয়টি নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। অতএব উন্মুক্ত আলোচনা করা যাক।

কুরআন মজিদের বাণী ওহী, হাদীসে কুদসীও ওহী । কিন্তু পার্থক্য হলো, কুরআন মজিদের শব্দ ও মর্ম সরাসরি ওহীরূপে প্রিয় নবীর সা. কাছে নাযিল হয়েছে। কিন্তু হাদীসে কুদসীর বিষয়টি ভিন্ন । এখানে শব্দ ও বাক্য প্রিয় নবীর সা., কিন্তু মর্মটি তিনি লাভ করেছেন জিবরাঈলের আ. মাধ্যমে কিংবা ইলহামে অথবা স্বপ্নযোগে, আল্লাহ পাকের তরফ হতে। হাদীসে কুদসীর সংজ্ঞায় এটা স্পষ্ট করা হয়েছে।

‘‘এ হচ্ছে সেই সব হাদীস, যা বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের দিকে সম্বন্ধিত হয়েছে। প্রিয় নবী সা. হাদীস বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক বলেন’ অথবা ‘জিব্রাইল আ. বলে গেছেন’ অথবা ‘জিব্রাইলের আ. মাধ্যমে আমার প্রভু বলেছেন’।

এ সব হাদীসকে হাদীসে ইলাহী, হাদীসে রব্বানী বা হাদীসে কুদসী বলা হয়। তবে কুদসী নামেই এসব হাদীস বিখ্যাত। কুদসী শব্দটা কুদস থেকে উত্পত্ত। অর্থ পূত-পবিত্রতা, মহিমাময়তা, পবিত্রতা। আল্লাহ পাকের একটি গুণবাচক নাম কুদ্দুস বা পবিত্র-মহিমান্বিত। পবিত্র কুদ্দুস নামের দিকে সম্বন্ধিত হয়ে হাদীসগুলো কুদসী নামে খ্যাত হয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আল কুরআনের বাণীর সাথে হাদীসে কুদসীর ব্যবধান পরিষ্কার। আল কুরআনে যে সব হরফ, শব্দ, বাক্য আমরা তেলাওয়াত করি, তার সবটুকুই আল্লাহর তরফ থেকে। এটা সেই কালাম, যা মাখলুক বা সৃজিত নয়, লৌহে মাহফুজে যা সংরক্ষিত,যার তেলাওয়াতকারী মহান আল্লাহ, যা আরশে লিখিত, যা ইস্রাফিলের আ, কপালে সুরক্ষিত, যা আল্লাহর কালাম সিফাতের বহিপ্রকাশ, যার শুরু নেই, সমাপ্তি নেই, যখন পৃথিবী ছিলো না-তখন এসব শব্দ-বাক্য ছিলো, যখন কোনো পাঠক ছিলো না, তখন এ পাঠ ছিলো, যখন পৃথিবী থাকবে না, তখনও এসব শব্দ, বাক্য থাকবে, পাঠ থাকবে।

কিন্তু হাদীসে কুদসীর শব্দ, বাক্যগঠন করেছেন প্রিয়নবীর । শব্দে যে অলঙ্কার, তা প্রিয়নবীর নির্মাণ, বাক্যে যে শিল্প ও সৌন্দর্য, তা প্রিয় নবীর সা. নির্মাণ। কথনের যে রূপ ও ধরণ, তা প্রিয় নবীর সা. নিজস্ব। মর্মটা কেবল এসেছে আল্লাহর তরফ থেকে। তাহলে উত্সগত দিক থেকে হাদীসে কুদসী ও কুরআনের আয়াতের ব্যবধানের দিকটা পরিষ্কার।এটাই তাকে আলাদা করেছে সেই কালাম থেকে, যা কদীম-অনাদী।

কিন্তু ব্যবধান এখানেই শেষ নয়। বহু পার্থক্য আছে, যা স্পষ্ট করে দেবে- হাদীসে কুদসী আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত হয়েও কীভাবে আল কুরআনের সমান নয়।

# আল কুরআন প্রিয় নবীর সা. মু‘জিযা। এর প্রতিটি শব্দে-বাক্যে আছে এ’জায বা এমন সামর্থ্য, যার মোকাবেলায় জগত অক্ষম। কুরআনের প্রতিটি আয়াত নিখিলের সবাইকে চ্যালেঞ্জ করছে প্রতিনিয়ত- যদি পারো, আমাকে মোকাবিলা করো! প্রমাণ করো আমি আল্লাহর কালাম নই! আমার অনুরূপ বাণী তৈরী করো।
কিন্তু হাদীসে কুদসী এমন নয়। তার মধ্যে সেই চ্যালেঞ্জ নেই, সেই এ’জায নেই।

# পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতে আছে তাওয়াতুর বা অকাট্য-সুনিশ্চয় ধারাসূত্র। সবকয়টি বাক্য ও আয়াত মুতাওয়াতির। এর ধারাবাহিক বর্ণনায় কোনো ছেদ নেই, নেই কোনো দুর্বল দিক। বর্ণনাসূত্রে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে সন্দেহের ইশারা জাগে। সব কিছুই অকাট্য, সব জায়গা সত্যতায় অবধারিত। কিন্তু হাদীসে কুদসীর অধিকাংশই খবরে ওয়াহিদ!

# কুরআন মজিদকে কেউ যদি আল্লাহর বাণী বলে না মানে, এর একটি শব্দকে কেউ যদি অস্বীকার করে, একটি আয়াতকে কেউ যদি প্রত্যাখান করে, সে মুসলিম থাকবে না। কিন্তু হাদীসে কুদসীকে কেউ না মানলে কাফির হবে না। তাকে বলা যাবে ফাসেক।

# কুরআন মজিদের শব্দে ও মর্মে রয়েছে আশ্চর্য অলৌকিকত্ব। এমন মোহন সাযুজ্য, যা সরাসরি বিশ্বস্রষ্টার মহিমা ও প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্ব করে। যা আল্লাহর জ্ঞান,প্রভুত্ব, শক্তি ও মহিমার অন্তহীনতার পক্ষে সরাসরি স্মারক। অতএব প্রতিটি আয়াতকে বলা হয় আয়াত বা নিদর্শন। আল্লাহর মহামহিম পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব কুরআনের প্রতিটি শব্দ বাক্যে বিদ্যমান। অর্থে ও তাত্পর্যেও বিদ্যমান। কিন্তু হাদীসে কুদসীকে সেই অর্থে আয়াত বলা হয় না!

# কুরআন মজিদের সুরক্ষা আল্লাহর দায়িত্বে। তিনি এর হেফাজত করবেন কিয়ামত অবধি। অতএব কুরআনে এমন কোনো কিছুর জায়গা হতে দেবেন না, যা কুরআন নয়। কুরআনের মর্মের নামে, ব্যাখ্যার নামে এমন কোনো কিছু প্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী হতে দেবেন না, যা আয়াতের উদ্দেশ্য নয়, ব্যাখ্যা নয়। এই সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু হাদীসে কুদসীর বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। এর সুরক্ষা হয়েছে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়, মানুষের বর্ণনার ভিত্তিতে।

# কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করা ইবাদত। প্রতিটি হরফে আছে দশটি নেকি। কুরআন হিফজকারীর জন্য আছে পরকালীন সুনিদিৃষ্ট পুরুষ্কার ও মর্যাদা। হাদীসে কুদসীর ক্ষেত্রে না হরফপ্রতি দশ নেকির প্রতিশ্রুতি, না এর হাফেজের জন্য আছে কুরআনের হাফেজসম প্রতিদান।

# কুরআন মজিদ তেলাওয়াত না করলে নামাজ হবে না। কিন্তু হাদীসে কুদসী এমন নয়। ওযুবিহীন অবস্থায় কুরআন মজিদ স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু হাদীসে কুদসী এমন নয়। জুনুবী বা অপবিত্র অবস্থায় কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করা যায় না, কিন্তু হাদীসে কুদসীর বিষয়টি ভিন্ন।

এতো সব পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে, আল কুরআন ও হাদীসে কুদসীর ব্যবধানগত দিক। আসলে এর মূলে নিহিত আছে কুরআনের এ‘জায। আল কুরআন যেমন আল্লাহর বাণী, তেমনি আল্লাহর মর্ম। অতএব শব্দ ও মর্মের সমষ্টিকেই বলা হয় কুরআন। যার মনোহরতা ও অলৌকিকত্ব আমরা পাঠকালে অনুভব করি, অর্থ ও মর্ম অনুধাবনে অনুভব করি। কিন্তু কেমন হতো সেই বাণী,যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্ম পেয়েও শব্দ-বাক্য বিন্যাস করেছেন বান্দা? তার ধরণ -অবয়ব কেমন হতো? কুরআনের সাথে তার সাদৃশ্য কতটা হতো? কতোটা থাকতো বৈষাদৃশ্য? এর নমুনা থাকা জরুরী ছিলো। হাদীসে কুদসী সেই নমুনা।

একদল অস্বীকৃতিবাদী বরাবরই বলে আসছে, হেরাগুহায় ধ্যানস্থ মুহাম্মদ সা. স্বর্গীয় অনুভূতি ও উপলব্ধি লাভ করে আল কুরআন রচনা করেন। হাদীসে কুদসী তাদের জবাব । হাদীসে কুদসী বলছে, দেখো, স্বর্গীয় অনুভূতি বা আসমানী উপলব্ধি সরাসরি লাভ করেও মুহাম্মদ সা. যখন নিজে বাক্যবিন্যাস করেন, তখন তার রূপ দাঁড়ায় হাদীসে কুদসীর মতো, কুরআনের মতো নয়। মুহাম্মদ সা. আসমানী অনুভব ও মর্ম লাভ করেও বাক্যবিন্যাসে কুরআনের অনুরূপ হতে পারেন না। কারণ কুরআনের অনুরূপ কিছু নেই। কুরআন কেবল তাই, যা নাযিল করেন মহান আল্লাহ পাক।

লেখক: কবি ও গবেষক

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ