শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


মায়ের চাদর বিক্রির টাকায় ইমাম শাফেয়ির ইয়েমেনে গমন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইসমাঈল আযহার: ইমাম শাফেয়ি রহ, মুসলিমদের তৃতীয় ইমাম। তিনি আসকালন প্রদেশের গাজা নামক স্থানে ১৫০ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালে পিতার ইন্তেকালের পর শাফেয়ি রহ. এর মা তাকে নিয়ে মক্কা চলে যান এবং সেখানে তিনি বড় হয়ে ওঠেন।

ইমাম শাফেয়ি রহ. এর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি তথ্য উল্লেখ করা গেল।

১. যেভাবে ইসলামের ধারাবাহিকতা শাফেয়ি রহ. এর বংশে

ইমাম শাফেয়ি রহ. পূর্বপুরুষ সায়েব বিন উবাইদুল্লাহ বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার হাতে ছিল বনি হাশেমের ঝাণ্ডা। রক্তপণ আদায় করার পর তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন লোকেরা বিস্ময় প্রকাশ করে। তিনি বললেন, আমি মুসলমানদেরকে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। এক বর্ণনা মতে শাফেয়ি রহ.-এর এই পূর্বপুরুষের বাহ্যিক আকার-আকৃতি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

২.ইমাম শাফেয়ি রহ. কে নিয়ে মায়ের শঙ্কা

ইমাম সাহেবের মায়ের আশঙ্কা ছিল, ইয়েমেনে তার নতুন বংশ নষ্ট হয়ে যাবে (এক বর্ণনা মতে আসকালানে তার জন্মগ্রহণ)। এ কারণে তিনি দশ বছর বয়সে শাফেয়ি রহ.কে নিয়ে মক্কায় চলে যান। শাফেয়ি রহ.- এর মা বর্নণা করেন, শাফেয়ি রহ. মাতৃগর্ভে থাকাকালীন আমি স্বপ্নে দেখি, মুশতারী (মঙ্গল নামক তারা) তারাটি আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মিশরে পতিত হয় এবং তার আলো প্রতিটি শহরে গিয়ে পৌঁছে। স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারীগণ বললেন , গর্ভ থেকে এমন একজন আলেম জন্ম নিবে, যার ইলম মিশর থেকে প্রতিটি শহরে ছড়িয়ে পড়বে।

ইমাম সাহেব পিতৃহীন ছিলেন। তার জন্মের পূর্বেই অথবা তার জন্মের পরপরই তার পিতা মারা যান। তার মাতা তাকে দু' বছর বয়সে মক্কায় নিয়ে আসেন।

৩. বাল্যকালে দুটি জিনিসের প্রতি ঝোঁক, 

বাল্যকালে দুটি জিনিসের দিকে ইমাম শাফেয়ি রহ. এর সমস্ত মনােযােগ ছিল, তীর নিক্ষেপ এবং জ্ঞান অর্জন। তীর নিক্ষেপে তিনি এমন পারদর্শি ছিলেন যে, দশটার মধ্যে দশটাই সঠিক লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছত। ওই সময় ঘােড়ায় আরােহণের আগ্রহও ছিল ইমাম শাফেয়ির।  তীর নিক্ষেপ এবং ঘােড়সওয়ারী সম্বন্ধে কিতাবুসবক ওয়াররমী’ নাকম গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এ বিষয়ে এটাই ছিল সর্বপ্রথম কিতাব। সঙ্গে সঙ্গে পড়ালেখার দিকে পুরাে মনােযােগ ছিল। পিতৃহীনতা এবং দরিদ্রতা সত্ত্বেও সম্পদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে রাত দিন পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতেন।

৪. কাগজ কেনার পয়সা না থাকায় হাড়, মাটির ভাঙ্গা পাত্র এবং খেজুরের পাতায় হাদিস সংরক্ষণ

মকতবের শিক্ষা শেষ করার পর বনী হুযাইল গোত্রে চলে যান ইমাম শাফেয়ি রহ.। হুযাইল গোত্রের লোকেরা ভাষা-অলঙ্কার শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ছিল। সতের বছর পর্যন্ত শাফেয়ি রহ. তাদের সঙ্গে ছিলেন । মক্কা ফেরৎ এসে তাদেরকে কবিতা শুনাতে আরম্ব করেন। ওই সময় আরবি ভাষা সাহিত্য এবং কবিতার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ছিল ইমামের। তিনি তখন আপন চাচা এবং মুসলিম বিন খালেদ যঞ্জী প্রমুখ থেকে হাদিস বর্নণা করতেন। উলামাদের শিক্ষা মজলিসে বসে হাদিস এবং মাসয়ালা শুনে শুনে মুখস্থ করে নিতেন।

শাফেয়ি রহ. মায়ের নিকট কাগজ কেনার পয়সা না থাকায় এদিক ওদিক থেকে হাড়, মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা এবং খেজুরের পাতা কুড়িয়ে সেগুলোতেই হাদিস লিখে নিতেন।

সাত বছর বয়সে কোরআন শরীফ এমনভাবে মুখস্থ করেছিলেন যে, তার সব অর্থ এবং মর্ম  স্পষ্ট ছিল এ ইমামের নিকট। শাফেয়ি রহ. বলেন, আমি কুরআনের মাত্র দুটি জায়গা বুঝিনি। আর দশ বছর বয়সে মুয়াত্বায়ে ইমাম মালেক মুখস্থ করেছিলাম।

৫. মায়ের চাদর বিক্রির টাকা দিয়ে ইয়েমেনে গমন

মদিনায় ইমাম মালেক রহ. এর দরসগাহ থেকে ইমাম শাফেয়ি রহ. ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করেন। সেখান থেকে মক্কা ফিরে আসলে তার ইলমি এবং দ্বীনি যোগ্যতার প্রসিদ্ধি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় মক্কায় আগমন করেন ইয়েমেনের আমীর। কোরাইশের নেতৃবর্গ ইয়েমেনের আমীরের সঙ্গে আলোচনা করেন, ইমাম শাফেয়ি রহ. নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ইমাম শাফেয়ি রহ. মায়ের কাছে এই পরিমাণ অর্থ ছিল না যে, কাপড়-চোপড় কিনে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবেন। বাধ্য হয়ে মায়ের একটি চাদর ষোল দীনারে বিক্রি করে সমস্ত সামানের ব্যবস্থা করেন তিনি।

 এ ইমামকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন তৎকালের যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ। কিছু মন্তব্য তুলে ধরা হল।

কাজী ইয়াহয়া বিন আকসাম বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. এর চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান আমি আর কাউকে দেখি নাই।

ইমাম মুয়ানী বলেন, অর্ধজগতের লোকের বুদ্ধি এক পাল্লায় রেখে অপর পাল্লায় ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বুদ্ধি রাখা হলে তার বুদ্ধির পাল্লাই ভারি হবে।

আবু উবাইদ বলেন, আমি ইমাম মালেক রহ. ইমাম শাফেয়ীর তেজস্বিতা স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ ছিলাম।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, আমি যদি এমন বুদ্ধিমান লোকের মজলিসে না বসি তবে কিয়ামত পর্যন্ত এমন সুযোগে আর আসবে না। কোরায়েশি এ যুবকের চেয়ে কিতাবুল্লাহ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা আমি আর কারো দেখি নি।

ইমাম মালেক রহ. বলেন, আমার নিকট যত ছাত্র শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছে তন্মধ্যে শাফেয়ীর চেয়ে অধিক মেধাবী এবং বুঝমান আর কাউকে পাইনি।

ইমাম শাফেয়ি রহ.নিজের সম্বন্ধে বলেন, ইমাম মালেক বড় স্নেহ এবং আগ্রহ সহকারে আমাকে তার সম্মুখে কিতাব পাঠ করতে দিতেন। তিনি আমাকে কিতাব পাঠ করে যেতে আদেশ করতেন। আমি পড়ে চুপ করলে তিনি বলতেন, তোমাকে আরো পড়তে হবে। আমার  পাঠ-পদ্ধতি এবং বুঝবার ও বুঝাবার পন্থাকে ইমাম মালেক রহ. অত্যন্ত পছন্দ করতেন।

আইএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ