বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


অনুসরণ: সত্যের না ব্যক্তির?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আশরাফ উদ্দীন খান
আলেম, গবেষক

‘ব্যক্তি দ্বারা সত্য নির্ণয় করো না, বরং সত্য চিনো, যাতে সত্যের অনুসারীদের চিনতে পারো’।

হযরত আলী রা. এর দিকে নিসবত করে নীতিবাক্যটি বর্ণনা করা হয়ে থাকে। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠা চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে নীতিবাক্যটি অতি জরুরি হলেও, আমাদের আশেপাশের অনেকের আচরণ দ্বারা বুঝা যায় যে, সত্যকে ব্যক্তির মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

কোনো ব্যক্তির প্রতি বিশেষ কোনো কারণে ভক্তি, মুহাব্বত ও বিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ার কারণে, তাকে সত্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ করে থাকি। ফলে তার সকল আচরণ-উচ্চারণ, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিকে দলীল বা প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করে থাকি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক কোনো ভ্রান্তির মধ্যেও তাকে হক মনে করা হয়ে থাকে।

এখানে ভ্রান্তির কারণ এটাই যে ব্যক্তিকে মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরিবর্তে যদি সত্যের মাপকাঠি দ্বারা ব্যক্তির ভর ও অবস্থান নির্ধারণ করার অভ্যাস থাকে তাহলে সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

ব্যক্তি, পরিস্থিতি, ঘটনা, সময়, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে আমাদের প্রতি মুহুর্তে সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। সেই সম্পর্ক কোনো সময় সুচিন্তা ও সঠিক সিদ্ধন্তের ভিত্তিতে হয়ে থাকে, আবার কখনো শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দ বা প্রবৃত্তির ভিত্তিতে হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ অধিকাংশ সময় সত্য-বিচ্যুত হয়ে থাকে। বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা ও সিদ্ধান্ত একজন মানুষের একটি অতি মূল্যবান একটি গুণ, এবং এই গুণ থেকে মানুষ বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত হয়ে থাকে।

সেই কারণ হতে পারে অন্ধ অনুকরণ, অতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, পুর্ব-সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা যায় যে, কোন একটি বিষয়ে আমাদের চিন্তায় আগে থেকেই এক ধরনের সিদ্ধান্ত বদ্ধমূল হয়ে থাকে, যার পেছনে নির্ধারিত কোনো যুক্তি, প্রমাণ থাকে না বরং থাকে শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এই অবস্থায় যদি কোনো সময় আমাদের সামনে তার বিপরীত কোনো যুক্তি বা প্রমাণ আসে, তখন আমাদের নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন না করে, বিপরীতে সেই প্রমাণ বা যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্ঠা করে থাকি। এর মাধ্যমে সত্য ও হক থেকে আমাদের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মুসলিম উম্মার ঐতিহ্য থেকে এটা পাওয়া যায় যে, ন্যায়-পরায়ণ শাসকগণ তাদের প্রজাদের সামনে নিজেদের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন বা জানতে চেয়েছেন যে, তিনি যদি শাসন কাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ থেকে সরে যান বা শরিয়াতের আইন থেকে তার দূরত্ব ঘটে তাহলে তারা কি করবেন?

তারা কি তার অনুসরণ করবেন না তাকে সংশোধন করবেন? শাসকদের পাশাপাশি মুজতাহিদ ও ফকিহগণ তাদের অনুসারী ও শাগরেদদের সামনে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, যদি তার মাজহাব বা সিদ্ধান্তের বিপরীত কুরআন-হাদীসের কোন নস বা ভাষ্য পায় তাহলে তারা যেন তার মাজহাবকে বর্জন করে কুরআন-হাদীসের নসকে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত থাকে।

‘সত্য মুমিনের হারানো সম্পদ, সেটা যেখানেই পাওয়া যাক তা গ্রহণ করতে কোন আপত্তি নেই’ -এটা হচ্ছে সত্যিকারের মুসলমানের গুণ।

ইতিবাচক হিসাবে ‘একতাই শক্তি’ আর নেতিবাচক হিসাবে ‘বিভক্ত করে শাসন করো’ প্রবাদ বাক্য দুটি নিয়ে চিন্তা করা যায়। একটি পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী, উম্মত যদি একত্রিত থাকতে পারে তাহলে সেই অবস্থায় তাদের অবস্থান আর বিভক্ত অবস্থায় তাদের অবস্থানের মাঝে আসমান-জমিন পার্থক্য, অন্যদিকে যদি কোন সমাজ ও কওমের কর্ম তৎপরতা ও শক্তি দুর্বল করে দেওয়ার চিন্তা থাকে তাহলে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেওয়ার মত মোক্ষম কোন উপাদান আর নেই।

এগুলো অতি সাধারণ নীতিমালা যা প্রত্যেকেরই জানা। তবে জানা থাকলেও, উম্মতের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ধর্মীয় ও সাধারণ নীতিমালাকে সাধারণ ভাবে বাস্তাবায়ন করার কৌশল রপ্ত না করা। ঐক্য উম্মতের জন্যে জরুরি ও উপকারী এটা সকলের জানা, তবে এই সিফাত নিজেদের মধ্যে জারি রাখার জন্যে যে কৌশল, পদ্ধতি ও প্রয়োজনের সময়ে ছাড় দেওয়ার মানসিকতার দরকার পরে সেই শর্তগুলো অর্জন করার সময়েই বিচ্যুতি ঘটে থাকে।

৫০০ মাইলের একটি গন্তব্যে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ যদি কোনো কাফেলার হাতে থাকে, এবং দূরত্ব অতিক্রম করার পথ সহজ ও নিরাপদ হয় তাহলে এখানে গন্তব্যে উপনীত হওয়া সময়ের ব্যবধান মাত্র, আর যদি কোনো ক্ষেত্রে এই দূরত্ব অতিক্রম করার পথ ও পাথেয় হাতে না থাকে, দূরত্ব অতিক্রম করার জন্যে যদি পথ তৈরির কাজ থেকে শুরু করতে হয়, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে 'লড়াই' করতে হয়, তাহলে মাঞ্জিলে-মাকসুদে পৌঁছবে কবে?

হে ঈমানদারগণ ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো৷ মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়৷ তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না৷

আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো৷ তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র ৷ তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন৷ ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো৷

তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে৷ আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন ৷এভাবেই আল্লাহ তাঁর নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন ৷ হয়তো এই নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে৷

তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যি থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে৷ যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে ৷ (সুরা আলে-ইমরানঃ ১০২-১০৪)

মাওলানা সাদ কান্ধলভীর প্রতি কয়েকটি নিবেদন!

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ