বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


বক্তা দাওয়াত, হেলিকপ্টার ও পরিকল্পিত জনরোষ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মাহমুদ হাসান সিরাজী
আলেম ও লেখক

তিনি চুক্তি করেন। চুক্তি করা ছাড়া কোনো মাহফিলে যান না। তিনি টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না। এমন অনেক কথা সময়ের আলোচিত বক্তা প্রিয় হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবকে নিয়ে মাঠে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।

সময়টা ২০১৩ সাল। সম্ভবত জানুয়ারি মাস। আমাদের দেশের মাদরাসায় মাহফিল হবে। আমাদের উস্তাদ হাফেজ অহিদুর রহমান হুজুর যথারীতি আমাকেই বক্তা দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। সাথে মাওলানা হাফিজুর রহমান সাহেবকেই দাওয়াত দিতে হবে শর্ত যুক্ত করে দিলেন।

একদিন ক্লাস করে জালালাইন জামায়াতের এক ছাত্রকে নিয়ে মাওলানা হাফিজুর রহমান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই। যতটুকু মনে পরে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমাদেরকে অনেক মেহমানদারী করেন। অনেক সময় দেন। প্রায় ৩ ঘন্টা।

অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওনাকে আমার কাছে বিনয়ী মনে হল। ওলামায়ে কেরামকে যথাযথ সম্মান দিতেও দেখলাম। মনে হল ইলমের ভালো মর্যাদা দিতে জানেন। আর বড়দেরও যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেন।

তারিখটা ছিল ৫ এপ্রিল ২০১৩ সাল। ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ছিল। তৎকালের সরকার হেফাজতের লংমার্চ উপলক্ষে সব কিছু বন্ধ করে দেয়। রোড ঘাটে কোনো গাড়ি ছিল না। ওই সময় প্রশাসনও ইসলামবান্ধব ছিল না। ২০১৩ সালটা এ দেশের ধার্মিকদের কেমন সাল ছিল সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

শুক্রবার আমি ওনার বাসার পাশের মসজিদে জুমা পড়ে ওনাকে নেয়ার অপেক্ষা করছিলাম। আবার হেফাজতে ইসলামের ১০ নাম্বার জুনেও বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল। পাশাপাশি হাফিজুর রহমান সাহেবের আশপাশের লোকজনও ওনাকে যেতে না করতেছেন।

অথচ তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রওয়ানা দিলেন। যথাসময়ের আগেই আমরা মাহফিলে পৌঁছলাম। মাহফিল শেষ করে তড়িৎ গতিতে তিনি গাড়িতে উঠে পরলেন। আমার উস্তাদ মুঠিবদ্ধ করে তাকে হাদিয়া দিলেন। তিনিও আদবের সাথে চোখ বন্ধ করে তা গ্রহণ করলেন।

রাস্তার মাঝে তাকে হাদিয়ার পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সাথে বল্লেন, ভাই! আমি আসলে কারো সাথে চুক্তি করি না। তাছাড়া মাদরাসাগুলোর সাথে তো প্রশ্নই আসে না।

তবে কিছু কিছু আয়োজকরা যা আচরণ করে তা বলার ভাষা রাখে না। আপনার সুযোগ থাকলে আপনি এসে একদিন দেখবেন এরা আমার একটা তারিখের জন্য কি করেন। অন্য জায়গায় প্রোগ্রাম থাকলেও সেটাও কেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে আমি নিজেও তার অফিসে বসে পরিস্থিতি দেখেছিলাম।

এরপর আরো কয়েকবার তাকে দাওয়াত করেছি। কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা হল, তিনি আমার সাথে কখনো চুক্তি করেননি। যখন যা দিয়েছি মুঠিবদ্ধ করে তাই গ্রহণ করেছেন।

আমার মাদরাসায় মাহফিল করে তো টাকাও নেন নাই। বরং তার নামে একটা রশিদ কেটে ফেলতে বলে দিলেন। অনেক জবরদস্তিও করেছি।

কিন্তু গতকাল পাবনার ঘটনাটা শুনে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। ওনার মত একজন মানুষকে নিয়ে এভাবে অপমান অপদস্থ করা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমি তো মনে করি যারা আয়োজক তারা প্লান প্রোগ্রাম করেই তাকে নিয়ে এমন অপদস্থ করেছেন।

তাছাড়া হেলিকপ্টারের ব্যাপারে তো তার একটা নিজস্ব নীতিমালাও রয়েছে। গত বছর তার অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে স্পষ্ট করে বড় অক্ষরে লেখা দেখলাম, কেউ হেলিকপ্টারের আবেদন করবেন না। এরপরও যদি দীনের সার্থে সময় বাঁচাতে কেউ করেন তাহলে প্রতিষ্ঠান বা জনগণের চাঁদার টাকায় তার ব্যয়ভার বহন করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে করলে তা করতে গ্রহণ করা যেতে পারে।

আর আয়োজকরাও মনে করে হেলিকপ্টার দিয়ে বক্তা নিলে তাদের ইনকাম ভালো হবে। হেলিকপ্টার দিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বক্তার চেয়ে আয়োজকরাই লাভবান হন বেশি। তারা হেলিকপ্টারের কথা বলে টাকা ওঠাতে পারেন বেশি। শ্রোতাও আসে ভালো। এখন সব দোষ যেন বক্তারই হয়ে গেল।

এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি, হেলিকপ্টারের প্রচলন কিন্তু মাওলানা হাফিজুর রহমান সাহেব করেননি। এ প্রথা চালু করেছেন আমাদের দেশের একজন বেদাআতি ওয়ায়েজ। তার নাম সবাই জানি।

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, পাবনার ঘটনায় আহলে হাদীসপন্থীদের সাথে ওই বেদাআতি গোষ্ঠীরও গভীর সম্পৃত্ততা থাকতে পারে। নতুবা সময় কম দেওয়ার অজুহাতে কেন একজন বড়মাপের বক্তাকে এভাবে অপমান অপদস্থ করা হবে?

ওয়াজ নসিহত তো নিছক কোনো বিনোদন অনুষ্ঠান নয় যে, আপনাকে হেদায়েত করতে হলে ঠিক এতটা পর্যন্ত বয়ান করতে হবে? হেদায়েত হয়তো ১০ মিনিটের বয়ানেও হতে পারে। আবার দশ দিনের লাগাতার বয়ানেও না হতে পারে।

আপনারা প্রোগ্রাম নেয়ার সময় হাতে পায়ে ধরে, অনুনয় বিনয় করে প্রোগ্রাম নিবেন। আবার নিজেরাই হেলিকপ্টারের প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে যাবেন। পরবর্তীতে সময় একটু কম দিলে বক্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পরবেন? এটা কেমন?

আজকের হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী তো আপনারা চাইলেও হতে পারবেন না। হাফিজুর রহমান হাফিজুর রহমানই। যদি এমন অপমানই করতে হয় তাহলে কেন আসেন তাকে নিতে?

আপনাদের উচিত বিবৃতি দিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। একজন আলেম হিসাবে এগুলো মেনে নিতে কষ্ট হয়। কোনো আলেমকে অপদস্থ করা মানে গোটা আলেম সমাজের অপদস্থ করা।

আলেমরা ভুল করেন না বা হাফিজুর রহমান সাহেব ভুল করেন না সেটা বলছি না। আল্লাহ তায়ালা নিজেও আলেমদের বিচার করবেন পর্দার আড়ালে।

বর্তমান সময়ে আমার অনেক প্রিয় দুই উস্তাদও এ বয়ানের ময়দানের রাজপুত্র বলা চলে। ওনারা এলম, আমল ও তাকওয়ায় অনন্য। তাই একজন বক্তার অপমানকে মেনে নিতে পারছি না।

লেখক: প্রিন্সিপাল, জামিয়া ওসমান ইবনে আফফান রা. ঢাকা

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ