শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সম্পর্কে আসলাফের দৃষ্টিভঙ্গি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইমাম গাযালি রহ.
বিশ্ববিখ্যাত ইমাম ও দার্শনিক

হযরত আবু দারদা রা. বলেন, তােমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ-এর দায়িত্ব পালন করতে থাক। অন্যথায় আল্লাহ পাক তােমাদের উপর এমন জালেম শাসক চাপিয়ে দেবেন, তােমরা বড়দের সম্মান করবে না এবং ছােটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করবে না। তােমাদের পরহেজগার লােকেরা জালেম শাসকের জন্য বদদোয়া করবে কিন্তু সেই বদদোয়া কবুল হবে না। তােমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে কিন্তু তােমাদের সাহায্য করা হবে না। তােমরা ক্ষমা প্রার্থনা করবে কিন্তু তােমাদের ক্ষমা করা হবে না।

একবার হযরত হােজাইফাকে কেউ জিজ্ঞেস করল, কোনো ব্যক্তি জীবিত হয়েও মৃতদের মধ্যে গণ্য? জবাবে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনো মন্দ কাজ থেকে দেখে তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে না। কিংবা মুখে তাকে খারাপ বলে না বা অন্তরেও ঘৃণা করে না।

হযরত মালেক ইবনে আহবার বলেন, বনী ইসরাঈলের এক আলেমের খেদমতে সর্বদা নারী-পুরুষের ভীড় লেগে থাকত। আর তিনি সমবেত লোকদের দ্বীনের কথা শোনাতেন এবং অতীতের জাতিসমূহের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দিতেন। এক দিন সেই আলেম দেখতে পেলেন, তার ছেলে উপস্থিত এক নারীর দিকে তাকিয়ে আছে এবং তাকে চোখে ইশারা করছে। ছেলের এ আচরণটি ছিল অত্যন্ত গর্হিত।

কিন্তু আলেম তার ছেলেকে কেবল বললেন, “এমনটি করো না” আর কিছুই বললেন না। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সে আলেম নিজের আসন থেকে নীচে পড়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙে গেল। ঐ একই সময় তার স্ত্রীর গর্ভ নষ্ট হয়ে গেল এবং তার ছেলে যুদ্ধে নিহত হলো।

আল্লাহ পাক সে যুগের পয়গম্বরের কাছে এই মর্মে ওহী প্রেরণ করলেন, অমুক আলেমকে বলে দিন, আমি তার ভবিষ্যৎ বংশধরের মধ্যেও কোনো নেককার পয়দা করব না। কেননা, তার সব কার্যক্রম যদি আমার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য হতো, তবে তার ছেলের সেই অন্যায় আচরণের জন্য কেবল এতটুকুই বলত না, এমনটি করো না। বরং তার জন্য তাকে কঠোর শাস্তি দিত। | হযরত হােজাইফা রা. বলেন, এমন একটি সময় আসবে যখন লােকেরা সৎ কাজের আদেশ দানকারী এবং 'অসৎকাজে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিদের তুলনায় মৃত গাধাকে উত্তম মনে করবে।

আল্লাহ পাক হযরত ইউশা ইবনে নূন আঃ-এর কাছে ওহী প্রেরণ করলেন, আমি আপনার কওমের চল্লিশ হাজার ভালো লােককে এবং ষাট হাজার মন্দ লােককে ধ্বংস করে দিব। এই বাণী শুনে হযরত ইউশা আ. আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ করলেন, পরওয়ারদিগার! মন্দ লােকেরা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ তাে স্পষ্ট, কিন্তু ভালো লােকেরাও কি কারণে মন্দ লােকদের পরিণতি বরণ করবে তা বােধগম্য নয়।

আগে নিজের খবর নিন : মুফতি তকী উসমানী

আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে জবাব এলো- তার কারণ, ভালো লােকেরা মন্দ লােকদের পাপকর্ম দেখবার পরও তাদের উপর অসন্তুষ্ট হইত না এবং (স্বাভাবিকভাবেই) তাদের সঙ্গে খানাপিনা (ও চলাফিরা) করত। আমার সঙ্গে যদি ভালো লােকদের সামান্য সম্পর্কও থাকত, তবে নিশ্চয়ই তারা মন্দ লােকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করত।
হযরত বিলাল ইবনে সা'দ বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন গােপনে নাফরমানী করে, তখন তা দিয়ে কেবল সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু এই নাফরমানী যখন প্রকাশ্যে করা হয় আর তাতে কেউ বাধা না দেয়, তখন তা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং যারা এই নাফরমানী দেখে নীরবতা অবলম্বন করে, তারাও তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একদা হযরত কা'বুল আহবার আবু মুসলিম খাওলানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কওমে আপনার অবস্থান কেমন? তিনি বললেন, আমার কওম আমাকে অত্যন্ত সম্মান করে। হযরত কা'ব বললেন, তাওরাত কিতাবে কিন্তু এই বিষয়ে ভিন্ন রকম মন্তব্য লেখা আছে।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তাওরাতে কি লেখা আছে? হযরত কা'ব বললেন, তাতে লেখা আছে, যে ব্যক্তি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ-এর আমলে নিযুক্ত থাকবে কওমের মধ্যে তার কোন মর্যাদা থাকবে না এবং লােকেরা তাকে ভালো নজরে দেখবে না। বরং তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হবে। এইবার হযরত আবু মুসলিম খাওলানী বললেন, তাওরাত কিতাবে সত্য লেখা আছে এবং আবু মুসলিম মিথ্যাবাদী।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. দাওয়াত ও নসীহতের উদ্দেশ্যে হুকুমতের আমলাদের কাছে তাশরিফ নিতেন। কিছুদিন পর হঠাৎ তিনি এ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন। লােকেরা তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমার এই আমলের কারণে লােকেরা হয়ত মনে করবে, আমার কথা ও কাজে বৈপরীত্য আছে। আর আমি যদি তাদের কিছুই না বলি, তবে আমি “সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ” বলিয়া সাব্যস্ত হব। ফলে আমি গােনাহগার হব।

বোঝা গেল, যে ব্যক্তি “আমর বিল মা'রূফ ও নেহী আনিল মুনকার” করতে অক্ষম, তার পক্ষে এমন স্থানে অবস্থান করা ঠিক নয়; যেখানে এর উপর আমল করা জরুরি হয়ে ওঠে। | হযরত আলী ইবনে আবু তালেব রা. বলেন, তােমাদের কাছে প্রথম যে জেহাদের কথা জিজ্ঞাসা করা হবে তা হইল হাতের জেহাদ। অতঃপর মুখের জেহাদ এবং সবশেষে অন্তরের জেহাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। মানুষের অন্তর যদি ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ মনে করে, তবে তাকে উপুড় করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ তার থেকে সত্যের আলাে ছিনিয়ে তাহাকে কঠিন অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হয়।

হযরত সহল ইবনে তশতরী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অপরকে কিছু বলার ক্ষমতা রাখে না, সে যদি নিজের ব্যক্তিজীবনে আল্লাহ পাকের আদেশ-নিষেধ পাবন্দির সঙ্গে পালন করে এবং অপরকে পাপকর্ম করতে দেখে অন্তরে তা ঘৃণা করে, তবে মনে করা হবে- সে যেন অপরাপর মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করল। |

হযরত ফোজায়েল ইবনে আয়াজ রহ.-কে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করেন না কেন? জবাবে তিনি বললেন, অনেকে এ কাজ করতে গিয়ে কাফের হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ-এর উপর আমল করার কারণে তাদের উপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, তাতে তারা ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি।

প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত সুফিয়ান ছাওরীকে এ একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, সমুদ্র যখন তার রােখ পরিবর্তন করে ধাবিত হয়, তখন তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার গতি রােধ করা কারাে পক্ষেই সম্ভব হয় না। 

উপস্থাপিত আলােচনা দ্বারা এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল যে, মুসলমানদের পক্ষে আমরে বিল মা'রূফ ও নেহী আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা ওয়াজিব। শক্তি ও ক্ষমতা থাকা অবস্থায় এ দায়িত্ব এড়াবার কোনো উপায় নাই। তবে এ আমল সম্পাদন করতে যার শক্তি ও ক্ষমতা নেই; সে ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই অক্ষম মনে করা হবে।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সফলতার সোনার কাঠি

এসএস


সম্পর্কিত খবর