জহির উদ্দিন বাবর
আলেম ও সাংবাদিক
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো।
এতদিন যাদের সরকারি হিসাবে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নও মনে করা হতো না তাদের এবার সর্বোচ্চ ডিগ্রি মাস্টার্সের মান দেয়া হলো। যদিও শুধু এরাবিক ও আরবি সাহিত্যে মাস্টার্সের মান দেয়া হয়েছে; তবুও এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
২০ থেকে ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বীকৃতির আওতায় আনা চাট্টিখানি কথা নয়। অতীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারও উদ্যোগ নিয়েছিল স্বীকৃতির। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এবার কওমিপড়ুয়াদের স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এর পেছনে রাজনীতি আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেহেতু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় তাদের সব কাজের পেছনেই রাজনীতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে এই স্বীকৃতির পেছনে রাজনীতি আর যাই থাকুক এটা যে ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত তাতে কারও সন্দেহ নেই। কওমি সনদের স্বীকৃতি বিলটি সংসদে পাস হওয়া পর্যন্ত ধাপগুলো পার হতে কর্তৃপক্ষকে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
আরও ছয় বছর আগেই স্বীকৃতি হতে পারত। ২০১২ সালেই সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ কেউ স্বীকৃতি হলে ‘ঘরে ঘরে লাশ পড়বে’ এমন হুমকি আসছিল কওমি অঙ্গন থেকে। যে কারণে সরকার পিছিয়ে যায়।
আসলে শেখ হাসিনার পক্ষে কওমি সনদের স্বীকৃতি যত সহজে দেয়া সম্ভব হয়েছে তা সম্ভব ছিল না খালেদা জিয়ার পক্ষে। এর কারণ হলো খালেদা জিয়া এমন একটি দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ যারা কওমিপড়ুয়াদের উন্নতি কোনোকালে চায়নি।
২০০৬ সালে কওমি স্বীকৃতির মৌখিক ঘোষণা বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ওই দলটিকেই প্রধানত দায়ী করা হয়। যদিও বিএনপিনেত্রীর আন্তরিকতা নিয়েও আছে প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জোটবদ্ধ এমন কিছু দল আছে যারা কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোরবিরোধী।
কিন্তু শেখ হাসিনার অটল মনোভাব, কৌশলী ভূমিকা সর্বোপরি একচ্ছত্র ক্ষমতার কারণে কেউ ‘টু’ শব্দ বলার দুঃসাহসও করেনি। এমনকি আওয়ামী ও বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
অথচ এই স্বীকৃতি খালেদা জিয়ার হাত ধরে এলে তাদের মধ্যে ‘হায় হায়’ রব উঠে যেত।
সংসদে পাস হওয়া স্বীকৃতির বিলে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি করে এই সমমান দেয়া হলো।
বিলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এই আইন দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নেসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসরণে পরিচালিত হবে। আপাত দৃষ্টিতে আলেম-উলামা যেভাবে চেয়েছেন এই স্বীকৃতি সেভাবেই দেয়া হয়েছে। এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ রাখা হয়নি। এমনকি কমিটিতে সরকারি কোনো প্রতিনিধি থাকবে না বলে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
এতোটা ‘নমনীয়’ ও ‘উদার’ হয়ে স্বীকৃতি আর কোনো সরকার দিতো কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে কী কারণে এভাবে ‘ব্ল্যাক চেকের’ মতো করে স্বীকৃতি দিয়ে দিলো তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। ভবিষ্যৎই বলে দেবে এর প্রকৃত কারণ।
দুই.
কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়ে কী হবে-এটা নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ চলছে। এই স্বীকৃতি কতটা কাজে লাগবে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।
প্রথমত এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সামাজিক একটি স্বীকৃতি পেলেন কওমিপড়ুয়ারা। লাখ লাখ কওমি আলেমকে যেখানে সরকারি খাতায় শিক্ষিত হিসেবে গণ্য করা হতো না সেখানে তারা এখন থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত হিসেবে গণ্য হবেন।
কওমিপড়ুয়াদের একটা সময় ‘খারেজি’ (স্বীকৃতিহীন) বলে তাচ্ছিল্য করা হতো। এখন আর সেই সুযোগটা থাকবে না। অপরাপর শিক্ষাধারার সর্বোচ্চ ডিগ্রির সঙ্গে তুলনা করলে হয়ত অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে; কিন্তু দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করা একজন আলেমও সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এটা এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত। আগে মানসিকভাবে আলেমরা যে জায়গাটিতে দুর্বল ছিল এখন সেটা আর থাকবে না।
এ স্বীকৃতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো সংসদে বিল আকারে তা পাস হয়েছে। যদিও সরকার যেকোনো সময় তাতে পরিবর্তন আনতে পারবে। একটি স্বাধীন দেশে সে অধিকার যেকোনো সরকারের আছে।
আমাদের দেশে দীর্ঘদিন স্বীকৃত আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাও সংসদে পাসকৃত নয়। পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে কওমি সনদের যে স্বীকৃতি আছে সেটাও সংসদে পাস করা নয়। এ হিসেবে আমাদের স্বীকৃতিটি বেশ পাকাপোক্ত।
জাতীয় সংসদে কওমি সনদের বিলটি পাস হওয়ার আগে এর ওপর বিভিন্ন সদস্য বক্তব্য রেখেছেন। তাদের প্রায় সবার বক্তব্যেই ছিল কওমি মাদরাসার শিক্ষাধারার প্রশংসা। অনেক সংসদ সদস্য এই শিক্ষাধারা সম্পর্কে আগে হয়ত খুব একটা জানতেন না, এই বিলের কারণে তাদের ধারণা হয়েছে।
সমাজের উচ্চ শ্রেণির অনেকে আগে কওমি মাদরাসা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখতেন না। তারা এবার জানতে পারলেন সাধারণ ও আলিয়া মাদরাসার পাশাপাশি কওমি মাদরাসাও এদেশের একটি স্বীকৃত স্বতন্ত্র শিক্ষাধারা।
এই স্বীকৃতি দিয়ে কওমি শিক্ষিতরা কী কী সুবিধা ভোগ করতে পারবেন এটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা মাস্টার্স করেন নিশ্চয় তাদের সমমান কওমি পড়ুয়ারা পাবেন না।
স্বীকৃতিতেও এটা স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইসলামিক স্টাডিজ ও এরাবিকে মাস্টার্সের সমমান। এটা সত্য যে, এই দুটি বিষয়ে কওমি পড়–য়াদের জানাশোনা সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজে যেসব বিষয় পড়ানো হয় এর অনেকগুলো সম্পর্কে মাদরাসার মক্তব বিভাগের শিক্ষার্থীরাই ভালো ধারণা রাখে।
কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন
আরবিতে কওমি শিক্ষিতদের মোটামুটি বেসিক থাকে, যা থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের। এ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দুটি বিষয়ে যোগ্যতার বিচারে কওমি পড়ুয়ারা নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবে।
তবে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়েছে শুধু দাওরায়ে হাদিসকে। নিচের স্তরগুলোর কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। উল্লিখিত দুটি বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো চাকরিতে কওমি পড়ুয়ারা হয়ত আবেদন করার সুযোগ পাবেন; কিন্তু অন্যদের আগের যেখানে আরও চার-পাঁচটি সার্টিফিকেট আছে সেখানে তাদের সার্টিফিকেটের সংখ্যা মাত্র একটি।
সার্টিফিকেট ও ফলাফল বিবেচনা করলে সাধারণ ধারার গ্র্যাজুয়েটদের এগিয়ে রাখবে সংশ্লিষ্টরা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্র যেমন সরকারি মসজিদের ইমাম, বিভিন্ন ধর্মীয় বিভাগের শিক্ষক, কাজী এসব ক্ষেত্রে কওমি পড়ুয়ারা সুযোগ পেতে পারেন।
এই স্বীকৃতির প্রক্রিয়া নিয়েও আছে কিছু জটিলতা। মাস্টার্সের মান দেয় সাধারণত স্বতন্ত্র কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ছয়টি বোর্ডের অধীনে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এখন না হলেও সামনে এটা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
স্বতন্ত্র কওমি বিশ্ববিদ্যালয় বা আল হাইয়্যাতুল উলয়া স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলে এর প্রধানের যোগ্যতা কী হবে এটা নিয়েও আছে জটিলতা। এখন থেকে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা মাস্টার্সের মান পাবেন; কিন্তু তাদেরকে যারা মাস্টার্সের মান দেবেন তাদের নিজেদের কি এই মান আছে-এমন প্রশ্নও দেখা দিতে পারে।
মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে স্বীকৃতিটা দ্রুত এসেছে। পদ্ধতিগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় আগামীতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে এই স্বীকৃতি হোঁচট খেতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে।
তবে সবকিছুর পরে কথা হলো, যাদের শিক্ষিত বলেই গণ্য করা হতো না এতদিন তাদের এখন অন্তত অশিক্ষিত কেউ বলতে পারবে না। এই স্বীকৃতি বা সার্টিফিকেট নিয়ে কর্মজীবন বা পেশাগত জীবনে কী করতে পারবে সেটার চেয়ে বড় হলো সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে কওমি পড়ুয়ারা আর এখন পিছিয়ে নেই।
তারাও এখন সমাজের মূলধারার অন্তর্ভুক্ত। আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে যে শিক্ষায় শিক্ষিতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষিত বলে গণ্য করা হতো না তাদের এখন শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু নেই।
হ্যাঁ, সামনে রাজনৈতিক কারণে কওমি স্বীকৃতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে একবার যেহেতু তা সরকারিভাবে ঘোষণা এবং পাস হয়েছে ভবিষ্যতে তা প্রত্যাহার করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এজন্য স্বীকৃতি কওমি মাদরাসার জন্য একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হবে।
তবে এই স্বীকৃতি একসময় বিকৃতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না তা নিয়েও আছে সংশয়। অনেকে এ ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কথা নানাভাবে তুলেও ধরেছেন।
যারা স্বীকৃতির কারণে কওমি মাদরাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তাদের এই শঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের চোখের সামনেই আলিয়া মাদরাসা অস্তিত্ব সংকটের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে।
মোটা অংক; কওমি সনদের স্বীকৃতি: বুঝার ভুল; না বুঝার ভান
এর জন্য প্রধানত দায়ী সরকারি স্বীকৃতি ও সুযোগ সুবিধা। স্বীকৃতির কারণে কওমি মাদরাসাও যে একদিন আলিয়ার পরিণতি ভোগ করতে হবে না তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। এজন্য আশঙ্কা ও সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এই আশঙ্কার কারণে স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করা সমীচীন নয়। কারণ পতনের স্রোতধারা এখন সবকিছুতেই বহমান। সময়ের বিবর্তনে দিন দিন সবখানে স্খলন দেখা দিচ্ছে। স্বীকৃতি ছাড়াও কওমি মাদরাসায় আগের সেই ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
বৈষয়িকতার নানা অনুসঙ্গ এখন কওমি মাদরাসাগুলোকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই অবস্থায় সরকারি স্বীকৃতি কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের জন্য একদিকে যেমন আশির্বাদ অন্যদিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সময়কে ধারণ করে ঐতিহ্যের ধারায় সামনে পথ চললে আশা করা যায় ইলহামি এই শিক্ষাব্যবস্থা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে না।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
-আরআর