কাজী হামদুল্লাহ
আলেম, লেখক
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষাব্যবস্থা কওমি মাদরাসার দাওরা হাদিসকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। এ জন্য আমরা মাননীয় সরকারের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
এ স্বীকৃতির বিল চূড়ান্তভাবে পাস হওয়ার পর থেকেই আমরা লক্ষ করছি, চিহ্নিত কয়েকটি মহল এর বিরোধিতায় নেমে পড়েছে। কেউ শঙ্কায়-আতঙ্কে আর হিংসায়। এদের মধ্যে অন্যতম হল নাস্তিক্যবাদ শক্তি। এদের একজন হল তসলীমা নাসরীন।
চলুন কওমী স্বীকৃতির বিল পাস-পরবর্তী ফেসবুকে দেয়া তার পোস্টের কিছু অংশ পড়ে নেয়া যাক। সে লিখেছে-
‘আজ শুনি কওমি মাদরাসার সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমান দেওয়ার বিল পাস হয়েছে বাংলাদেশে। অশিক্ষিত ধর্মান্ধগুলো এখন অনায়াসে সিইও হবে, সচিব হবে, প্রশাসক হবে, বিচারক হবে, শিক্ষক হবে, উপাচার্য হবে। এই মূর্খ কূপমন্ডুকগুলোই দেশ চালাবে। দেশে শরিয়া আইন আনবে। এরা এদের গুরু ওয়াজবাজদের আদেশ পালন করবে। দেশটাকে বানাবে মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দোযখ।’
এই ছিল তার পোস্টের মূল বক্তব্য। একজন বাচ্চাও হয়ত এটা পড়ে বুঝে নিতে পারবে, এই লেখার পেছনে তার মনে কতবড় ভয় কাজ করেছে। কতটা আতঙ্কিত হয়ে সে এটা লিখেছে।
একজন তো তার ওই পোস্টে কমেন্টও করেছে, ‘দিদি, ভয়েক কিছু নেই। একদিন আমাদের জয় হবেই।’ কী ভয়? সেটাও তার লেখাতেই বলেছে সে। লিখেছে, ‘(এরা) এখন অনায়াসে সিইও হবে, সচিব হবে, প্রশাসক হবে, বিচারক হবে, শিক্ষক হবে, উপাচার্য হবে। এই মূর্খ কূপমন্ডুকগুলোই দেশ চালাবে।’
তার কথায় মনে হচ্ছে দেশের নাগরিকস্বাধীনতা বিষয়ক চ্যাপ্টারটি সে ঘুমের ঘোরে পড়েছিল অথবা পড়েইনি। বাংলাদেশে স্বীয় যোগ্যতা অনুযায়ী যে কেউ যে কোন পদ পেতে পারে। এটা দেশের নাগরিক অধিকার।
আমরা তো বর্তমানে দেখি প্রশাসন-বিচারকদের পরিচালক তথা অনেক এমপি-মন্ত্রিও কোনরকম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই দেশের নেতা বনে যাচ্ছে। তাদের কথায় পুরো আইনব্যবস্থা উঠবস করছে।
এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
এই পরিস্থিতিতে যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার বলে কোনো কওমিয়ান প্রশাসক, বিচারক বা অন্যকোনো রাষ্ট্রীয় পদে বসেন, তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যাটা আসলে দেশের নয়, সমস্যা ওদের নিজেদের। যদি নীতি-আদর্শে বলিয়ান কোনো কওমি পড়ুয়া বিচারক বা প্রশাসক হন, দেশের পরিচালক হন তখন সব’চে বড় সমস্যা পশ্চিমাদের লেজুরবৃত্তি করা এসব ছেঁড়াতেনাদের।
এরা যে কারো ক্ষেত্রে যে কোনো বাজে মন্তব্য অনায়াসে করতে পারবে না। আইনের সীমারেখা লঙ্ঘন করে কাউকে কটাক্ষ ও কুরুচিকর কথা বলতে পারবে না। বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে তাদের দলন-মলনের কায়দাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
আরেকটা কারণ হতেও পারে, নাও হতে পারে। হয়ত তার এবং তাদের দেশে ফেরার স্বপ্ন আছে। হয়ত সে অপেক্ষাও তারা করছে। (তের সালের শাহবাগ আন্দোলনে কিছুটা আশা পেয়ে থাকলেও তা ভেস্তে গেছে, সেটা আজ বললাম না।)
এখন যদি কওমিরা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে চলে যেতে পারে, তাহলে ১০০% শিওর যে, ওরা স্বপ্নেও আর দেশে ফিরতে পারবে না। ফিরলেও মুহূর্তেই বিচারের কাঠগড়ায় পড়বে কঠিন শাস্তির মুখোমুখী। এ জন্যও তাদের ভীতি মাত্রাতিরিক্ত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনাসহ ৯ এজেন্ডা নিয়ে বৈঠকে বসছে হাইআতুল উলয়া
সে আরো লিখেছে, ‘(কওমিরা) দেশে শরিয়া আইন আনবে। এরা এদের গুরু ওয়াজবাজদের আদেশ পালন করবে। দেশটাকে বানাবে মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দোযখ।’
শরীয়া আইনে দেশের উন্নতি হয় নাকি অবনতি হয়, তা নিয়ে বিস্তৃত কিছু বলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ সচেতন যে কেউই আরববিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ইসলামি শরিয়াভিত্তিক পরিচালিত দেশের অবস্থা জানেন। জানেন তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারমানবিক ও আন্তর্জাতিকসহ অন্যান্য সকল অানুসাঙ্গিক অবস্থা।
এমন কি, বাংলাদেশেও পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সব’চে পরিতৃপ্তির জীবনযাপন করছেন ইসলামি অনুশাসন মেনে চলা মানুষগুলো। (বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা অবশ্যই আছে। তবে তা এতটাই নগণ্য যে, সেগুলো এ কথায় কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না।)
তসলিমা বলেছে, ‘কওমিরা ওয়াজবাজদের কথায় দেশ চালাবে।’ এটা খারাপ কী? ওয়াজবাজ, মানে যে ওয়াজ করে, মানুষকে উপদেশ দেয়। মানুষকে ভাল-মন্দের পথনির্দেশ করে। হ্যাঁ, এর মধ্যে কিছু কিছু মন্দ ওয়ায়েজ আছে। তারা খারাপ, খারাপ এবং খারাপ। এতেও সমস্যা কী?
মানুষ ভাল-মন্দের সংমিশ্রণেই তো! প্রত্যেক সমাজে যেমন ভাল আছে, তেমনি মন্দও আছে। তবে সামগ্রিক বিচারে তুলনামূলক মন্দের সংখ্যাটা যে অন্যান্য সমাজের চেয়ে (যেমন দেশে অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থায় এবং যারা এখন দেশ চালাচ্ছে তাদের সমাজের চেয়ে) কওমি সমাজে কম, তা পৃথকভাবে বলার দরকার নেই।
দেশের বিচ্ছিন্ন দু'য়েকটি গণ্ডির মানুষ ছাড়া বাকি সবাই এ কথা অকপটে স্বীকার করে এবং করবেন। কোন কোন গণ্ডি সে আলোচনায় আজ যাব না। প্রিয় পাঠকের আশা করি এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও অনুমান আছে।
তসলিমার শেষ কথা ছিল, ‘(কওমিরা) দেশটাকে বানাবে মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দোযখ।’
তসলিমার এই লেখা সম্বলিত পোস্টের কমেন্টেই কেউ একজন বলেছিল, মেয়েরা যতটা না অসহায় তারচে’ও বেশি অসহায় হিসেবে জাতির সামনে উপস্থাপন করছে এই তসলিমারা। এরা কেমন যেন মেয়েদের অবলা-অপয়া জাত হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
নারীদের ক্ষেত্রে অনেকটা সাংঘর্ষিক আচরণ তার ও তাদের। অথচ ইসলাম কখনই নারীকে অসম্মান করেনি। খাঁটো করেনি। বরং নারীর মর্যাদা বিষয়ক অসংখ্য হাদিস আমাদের সামনে বিদ্যমান।
শুধু তা-ই নয়। সম্মানের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি মুসলমানরা। নারীদের নিরাপদে ঘরে রেখে পুরুষ নিজ দায়িত্বে তার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া পূরণ করছে। অনেকটা ‘জো হুকুম’ টাইপে নারীর দেখভাল করছে মুসলিমরা।
পক্ষান্তরে তসলিমার মত নারীবাদীরা তাদের টানতে টানতে রাস্তার মোড়ে উত্তপ্ত রোদ্রে পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হোক ঝড় বা বৃষ্টি; একবদনা সম্মান (?) নিয়ে নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ট্রাফিকমোড়ে। তাহলে নারীর জন্য দেশটাকে আস্ত দোযখ বানালো কারা? কওমিরা না অন্য কেউ?
বলার অপেক্ষা রাখে না, নারীদের জন্য দেশটাকে আস্ত দোযখ বানানোর এই মহাপরিকল্পনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে কেবল কওমিরাই। আর তাই তাদের প্রাপ্য অধিকার রাষ্ট্রীয় সনদস্বীকৃতি নিয়ে তাদের এত ভয়। কওমি সনদ নিয়ে তাদের এত শঙ্কা ও ভীতি।
লেখক: সম্পাদক, মাসিক প্রবচন।
কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন