বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ইসলামি সভ্যতার খোঁজে রাশিয়ার পথে পথে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাহা আকিল
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরব নিউজের সাংবাদিক মাহা আকিলি একবার ওআইসি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে রাশিয়ার মুসলিম প্রধান অঞ্চল ভলগা-উরাল সফর করেছেন। তিনি এ সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এ লেখায়।

“ভলগাউরাল অঞ্চলটি বর্তমানে রাশিয়ান ফেডারেশনে অবস্থিত। ইসলামের আবির্ভাবের প্রথমদিকেই আরবভূমি থেকে বহু উত্তরে অবস্থিত এ অঞ্চলে শান্তির বাণী পৌঁছে যায়। আধুনিক তাতারস্তান প্রজাতন্ত্র, বাশকরতোস্তান প্রজাতন্ত্র, চুভাশিয়া প্রজাতন্ত্র, আরি ইল প্রজাতন্ত্র, উদমুরতিয়া প্রজাতন্ত্র, মোলদাভিয়া প্রজাতন্ত্র এবং ভলগা ও উরাল অঞ্চলে অবস্থিত এলাকাগুলো নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে এই ভলগা-উরাল অঞ্চলটি গঠিত।

ভৌগোলিক দিক থেকে পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম সাইবেরিয়া সমভূমির মাঝখানে উরাল পর্বতমালার চারদিকে এই অঞ্চলটির অবস্থান। এর উত্তর দিকে উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণে ওরস্ক সিটির নিকটবর্তী উরাল নদী। অঞ্চলটির সীমানা ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

ইসলামী সংস্কৃতি, সভ্যতা ও শিক্ষার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর এ অঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাজান, আস্ত্রাযান, উফা, ওরেনবার্গ ও ট্রটস্ক। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলটির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তাহলো বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের লোকদের একত্রে বসবাস ও সহাবস্থান।

ওআইসির মহাসচিব একমেলেদ্দিন ইহসানগ্লুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমি সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলাম। এক শীতের রাতে আমরা তাতারস্তানের রাজধানী কাজান শহরে পৌঁছি। সেখানে বিমানবন্দরে সাদর অভ্যর্থনা জানান তাতারস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিত্রতাইমার শামিয়েভ। তার সঙ্গে ছিল চমৎকার কারুকাজ করা লম্বা রঙিন ও শালীন পোশাক পরা একদল তরুণী।

বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা আমাদের অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে বসায়। এরপর আমাদেরকে ঐতিহ্যবাহী রুটি ও সঙ্গে চক চক নামের এক ধরনের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তাতারস্তানের ঐতিহ্যবাহী এ খাবারই সাধারণত মেহমানদের পরিবেশন করা হয়। পরদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান বলগার নগরীতে।

কাজানের বাইরে অবস্থিত এই নগরীতে ৯২২ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছিল। অঞ্চলের মধ্যে সর্বপ্রথম এই স্থানটিতে ইসলাম ধর্মের চর্চা শুরু হয়। এখন এই স্থানটিতে খনন কাজ চলছে এবং এটিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

সোভিয়েত আমলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন আমলের মসজিদগুলোও খুঁড়ে বের করা হচ্ছে। সদ্য আবিষ্কৃত ইসলামী শিল্পকর্ম ও পান্ডুলিপিসমূহ সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে এখানে একটি যাদুঘরও তৈরি করা হচ্ছে। ভলগা-উরাল অঞ্চলের অতীত ইসলামী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বলগার হচ্ছে অন্যতম। স্থানীয়রা এলাকাটি পবিত্রস্থান বলে মনে করে থাকে।

ব্যবসার নিয়ে জটিলতার দিন শেষ – বিস্তারিত জানুন

কাজান শহর নির্মিত হওয়ার পর এই শহরটি অবহেলার শিকার হয় ও পরিত্যক্ত হয়। তাতারস্তানের সরকার এটির প্রাচীন গৌরব সংরক্ষণ করতে চাইছে। শামিয়েভ জানান, বলগারের প্রাচীন নগরীর সংলগ্ন এলাকাগুলোর খনন কাজ ২০১২ সালে সম্পন্ন হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শামিয়েভের চেষ্টায় তাতারস্তানে ইসলামের গৌরবময় দিন আবার ফিরে আসছে। তার দেশে ইসলামী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ শামিয়েভ ২০০৭ সালে বাদশাহ ফয়সল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।

সোভিয়েত আমলে তাতারস্তানের মসজিদগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। শামিয়েভ ক্ষমতায় আসার পর মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পেরেস্ত্রোইকার আমলে যেখানে মসজিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩২টি এখন সেখানে মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১২শয়ের বেশি হয়ে গেছে।

সংরক্ষণ প্রকল্প সম্পর্কে শামিয়েভের কথা শুনতে শুনতে আমরা পুরা নগরীটিই পরিদর্শন করে ফেললাম। মসজিদ পুনর্নির্মাণ ছাড়াও ধর্মীয় ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন শিল্পকর্মও স্থান পাবে।

রুটির জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা খুবই আগ্রহ প্রকাশ করলাম। শামিয়েভ বিভিন্ন প্রকারের রুটিসহ ঘরে তৈরি ঐতিহ্যবাহী রুটি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন। এখন মেশিনে তৈরি রুটি আগের রুটিগুলোর স্থান দখল করে নিচ্ছে।

শামিয়েভ জানালেন, তিনি রুটি তৈরির প্রাচীন পদ্ধতি এর ইতিহাস ও তৈরি প্রণালীসহ সংরক্ষণ খরতে চান। আমরা বিকেলে কাজান ফেডারেল ইউনিভার্সিটিতে ‘তাতারদের ইতিহাস ও সভ্যতা' শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নেই।

ওআইসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রিসার্চ সেন্টার ফর ইসলামিক হিস্টোরি, আর্ট এন্ড কালচারের উদ্যোগে এই বইটি প্রকাশিত হয়। উপস্থাপনায় শামিয়েভ বলেন, ইসলামের ইতিহাসে তাতারদের স্থান এই বইয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

দশম শতাব্দীতে এখানে ইসলামের আগমন ঘটে এবং শান্তিপূর্ণভাবে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। তিনি জানান, সরকার এ অঞ্চলে ইসলামের আগমনের দিন হিসেবে ২১ মে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইহসানগ্লু বলেন, এই বইটিতে এমন একটি অঞ্চলের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে যে, অঞ্চলটিকে ইসলামের প্রান্তসীমা বলে মনে করা হয়। অবশ্য রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই সীমা প্রযোজ্য হবে না যদিও সেখানে ২ কোটি মুসলমান বাস করে।

তিনি বলেন, রিসার্চ সেন্টারের দায়িত্ব পালনকালে আমি ভলগা-উরাল অঞ্চলের ইসলামী সভ্যতার উপর একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করি। এটি অনুষ্ঠিত হয় কাজানে। পরে অন্যান্য শহরেও এ ধরনের সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।”

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, আরব নিউজ।
তথ্যসচিব,  ওআইসি ।

(আরব নিউজ থেকে শফিকুর রহমানের অনুবাদ)

অারও পড়ুন: রাশিয়ায় ৮০ বছর বন্ধ থাকা মসজিদ ফের চালু

আরএম/


সম্পর্কিত খবর