শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সাইয়েদ কুতুব কিভাবে খোমেনিকে অনুপ্রাণিত করেছেন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ তামিম: সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-২৫ আগস্ট ১৯৬৬) হলেন একজন মিশরীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠক।

তিনি মিশরের ইসলামি আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলের মুখপত্র ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ এর সম্পাদক ছিলেন। তাকে তৎকালীন সরকার ফাঁসির আদেশ দেয় এবং ফাঁসির কাষ্ঠেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সালের ৯ অক্টোবর মিসরের উসইউত জেলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম সাইয়েদ, কুতুব তার বংশীয় উপাধি।

তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিশরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তার বাবার নাম হাজি ইবরাহীম কুতুব; তিনি চাষাবাদ করতেন।

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হেফয করেন। পরবর্তীকালে তার বাবা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

সাইয়েদ কুতুব তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষা শেষ করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদরাসা থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি পড়াশুনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

তিনি দু’বছরের র্কোস শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকা থাকাকালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।

১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী- ইখওয়ানুল মুসলিমুন এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। কারণ, ওই বছর মিসর সরকার ব্রিটিশের সাথে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে।

পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। একটি হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করেন।

১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাকে মুক্তি দিয়ে তারই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।

এক বছর যেতে না যেতেই তাকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন।

শুধু তিনি নন, তার ভাই মুহাম্মদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাত শ’ ছিলেন নারী।

১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় সদস্য সাইয়েদ কুতুবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।

মিশরের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের হত্যার পরিকল্পনা করার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।

কুতুবকে আধ্যাত্মিক নেতা ও বিপ্লবী ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রথম তাত্ত্বিক হিসেবে বিবেচনা করা হত, যারা অস্ত্রের অধিকার আদায়ের জন্য এবং বিদ্যমান বাস্তবতা পরিবর্তন করার জন্য একটি সমাধান হিসেবে সহিংসতা অবলম্বন করার আহ্বান জানায় তারা তাকে শত্রু মনে করতো।

তিনি শরিয়াহ শাসন এবং অন্যান্য বিষয়কে সহজি করণের চিন্তা করে সামাজিক অনেক কাজ করেন। যার কারণে তিনি আজো অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।

সাঈদ কুতুব সমসাময়িক শিয়া ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তাধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছেন। তার প্রচারে সহিংসতা ও চরমপন্থার কোনো অবস্থান ছিলো না। বরং তার চিন্তা চেতনার দ্বারা চিহ্নিত বিভিন্ন শিয়া ইসলামি আন্দোলনের ধারণা ও নীতিসমূহের ধারণার সঙ্গে মিল থাকায় শিয়া সম্পর্কের এক নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করেছিল।

তার বই ও প্রবন্ধগুলো শিয়া মতাবলম্বিদের একটি অনুপ্রেরণার বিষয়ে পরিণত হয়। এদিকে খোমেনিকে শিয়ারা যে ইমাম মনে করে সেটা সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা চেতনার অনেক দিকে মিল পেয়েছে শিয়া মতাবলম্বিরা। যার কারণে তারাও তাকে গুরুত্বের আসনে সমাসিন করেছিলেন।

তার বই ‘ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার’ শিরোনামে, তিনি উসমান বিন আফফান ও আবু সুফিয়ান বিন হারব,  আমর ইবনুল আসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির সমালোচনা করেছেন। যেটা শিয়াদের মতের পক্ষে যায়।

একই বইয়ে কুতুব শিয়া আন্দোলনের প্রশংসা করেন, যা শিয়া আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। চতুর্থ শতাব্দীর (হিজড়ার পর) আব্বাসীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কুতুব  এ আন্দোলনকে ইসলামের আত্ম প্রকাশ বলে উল্লেখ করে বলেন, এ লড়াই ছিলো শোষণ ও ক্ষমতা গ্রহণের লড়াই।

প্রথম সাক্ষাত

সাইয়েদ কুতুব ও ইমাম খোমেনির মধ্যকার প্রথম বৈঠক ও সমসাময়িক শিয়া পণ্ডিতদের একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করে যা ঘটেছিলো ১৯৫৩ সালে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মিশরীয় বুদ্ধিজীবী ইরানের সাইদ মুজতবা মীর লোহি যিনি পরিচিত সাফি নামে।

সিরিয়ার গবেষক রসাস লিখেছেন, খোমেনি ও সাইয়েদ কুতুবের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। মিশরের নানান বড় বড় অনুষ্ঠানে কুতুব নিজেই মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় অবস্থানের কারণে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।

ইরানের ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হামিদ গারিব রেজা বলেন, এ সফরটি মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাদের দুই নেতার একত্রিত সফরটি ছিলো ব্যতিক্রমর্ধী একটি সফর।

সমসাময়িক শিয়া আন্দোলনে সাইয়েদ কুতুবের চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাব বিশিষ্ট ইরাকি চিন্তাবিদ মুহাম্মদ বাকির আল-সদরের লেখায় ফুটে উঠে।

১৯৬৪ সালে প্রথম দফায় যখন তিনি কারাগারে ছিলেন তখন সাইয়েদ কুতুবের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন মুহাম্মদ বাকির আল-সদর ইরাকি রাষ্ট্রপতি আবদুস সালাম আরিফকে মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদুন নাসেরের সঙ্গে কুতুবকে মুক্ত করার আহ্বান জানান।

কারাগারে সাইয়েদ কতুব

১৯৬৯ সালে, ইরান বিপ্লবের নেতা ও শিয়াদের ইমাম- খোমিনি, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বই ‘ইসলামি সরকার’ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

কুতুবের মৃত্যুদণ্ডের তিন বছর পর এটা প্রকাশ হয়। তখন এটা অনেক পণ্ডিতদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। যারা খোমেনি ও কুতুব উভয়ের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখেনি তাদের ধারণা স্পষ্ট করেছে।

এটাও বল হয়েছে, খোমেনি মিশরীয় চিন্তাবিদদের লেখাগুলির সাথে পরিচিত হতে পারে। তার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। একটি ধর্মীয় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে পথনির্দেশ করে যে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় সেগুলোর বহি:প্রকাশ ছিলো তার এ বই।

বর্তমান ইরানি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি, সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা ও তার দর্শনে অনুপ্ধারাণিত বলে মনে করা হয়।

খোমেনির আদেশে তার কিতাবগুলোর অনুবাদ করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। তিনিও তার অনেক কিতাবের ওপর আলোকপাত করেছেন। সাইয়েদ কুতুব শহিদ অনেক গ্রন্থ লিখেছেন।

সাইয়েদ কুতুব মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যিকদের সিংহ পুরুষ হিসেবে খ্যাত। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবিদের কাহিনী লিখে তার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাটা) নামে ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট একটি উপন্যাস রচনা করে বিশ্বব্যাপী সমাদ্রিত হন।

তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মুশাহিদুল কিয়ামাহ ফিল কুরআন, আত্ তাসবিরুল ফান্নি ফিল কুরআন, আল আদালাতুল ইজতিমাঈয়া ফিল ইসলাম, ফি যিলালিল কুরআন ইত্যাদি প্রসিদ্ধ।

সূত্র: আল আরাবিয়া ও উইকিপিডিয়া

ব্যবসার নিয়ে জটিলতার দিন শেষ – বিস্তারিত জানুন

 


সম্পর্কিত খবর