[জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।
এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।
আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি সপ্তাহে দুদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আজ প্রকাশ হলো ২২ তম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মাওলানা উমর ফারুক ইবরাহীমী।]
দেওবন্দ থেকে হিজরত করে পাকিস্তান পৌঁছার পর পাক সরকার একটি নয়নাভিরাম ও সৌন্দর্যমন্ডিত বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থাপনা করেছিলেন। বাড়িটির নাম ছিলো ‘কিংস কোর্ট’।
বাড়ির ডানপাশ ঘেঁষে সোজা চলে গেছে করাচি শহরের প্রধানতম সড়ক ‘বন্দর রোড’। এ সড়কটিকে বর্তমানে ‘কায়দে আজম রোড’ বলা হয় এবং এখানেই ছিলো ট্রামের (ছোটছোট রেল গাড়ি) প্রধান স্টেশন।
এ স্থানকে বলা হতো ‘ট্রাম গোদি’। বাঁ দিকে ছিলো সদরে’র জাঁকজমকপূর্ণ ব্যস্ততম বাজার। সে যুগে করাচির মূল সড়কগুলো নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হতো। আমরা দেওবন্দের গাঁ-গ্রাম থেকে উঠে আসা লোকদের পুলকিত হবার মত এখানে হরেকরকম উপলক্ষ ছিল।
আমাদের বাসার পাশঘেঁষে এই সড়ক দিয়েই ততকালীন পাকগভর্নর, জেনারেল, প্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশি অতিথিবৃন্দ এবং সরকারের উপরস্থ কর্মকর্তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিলো।
‘কিংস কোর্ট’ নামক সেই বিল্ডিংটি আজও এই নামে বিদ্যমান। ভবনটি পাঁচতলা বিশিষ্ট।বাসগৃহের দিক দিয়ে সেটিকে বলা যেতে পারে multicultural অর্থাৎ বহুবিচিত্র সংস্কৃতি ভবন।
আমাদের আবাস ছিলো চতুর্থ তলায়। পঞ্চম তলায় সিন্ধের একজন প্রথিতযশা সিন্ধি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম মুহাম্মদ লায়েক লাখু সাহেব থাকতেন। ‘লাখু’ সিন্ধের একটি সম্মানসূচক পদবী।সেকালে আশপাশের সবাই তাকে ‘লাখা সাহেব’ বলে সম্বোধন করতেন।
আমার কচিমনে লাখা’র মানে এই বুঝে আসতো যে উনি একজন লাখপতি, তাই সবাই তাকে লাখা বলে। তাদের সাথে আমাদের একরকম পারিবারিক বন্ধন ছিলো। লাখু সাহেবের পত্নী আমাদের সব ভাইকে প্রানভরে স্নেহ, আদর দিতেন এবং আমাদের সাথে বড়বোন সুলভ আচরণ করতেন।
তার ছেলে জনাব মরহুম গোলাম শাব্বির আমাদের সহোদর ভাইয়ের মত ছিলেন। আমার বয়স তখন আনুমানিক পাঁচ বছর ছিলো। তাই আমি তাদের ঘরে নিঃসংকোচে চলে যেতাম। লাখু সাহেবের স্ত্রী সিন্ধের প্রচলিত পন্থায় একটি সরল লোহার কড়ায় ঘিয়ে ভাজা রুটি বানাতেন। সেটি আমার অনেক প্রিয়ো ছিলো।
তিনিও সীমাহীন আদর, আপ্যায়ন ও যত্নসহকারে আমাকে খাওয়াতেন। তার ঘরে সিন্ধের প্রচলিত দোলনাও ছিলো। আমরা ছোটরা সেই দোলনায় হেসে খেলে আনন্দ উপভোগ করতাম।
বাসার উপর খোলা ছাদ ছিলো। আসরের পর সেখানে আমাদের ছেলেপুলেদের খেলার আসর জমতো। গোলাম শাব্বির আহমদ সাহেবও তখন অল্পবয়সী ছিলেন। তিনিও নিঃসংকোচে আমাদের ঘরে আসতেন।
লাখু সাহেবের ঘরের মহিলাদের সাথে আমাদের ঘরের মহিলাদের সম্পর্কও ছিলো মধুর।
মোটকথা, যতদিন আমরা সেখানে ছিলাম দুখেসুখে একে অন্যের সহযাত্রী ছিলাম। দেখে মনে হতো যেন আমরা একই ঘরের সন্তান। পরবর্তীতে আমরা সেখান থেকে চলে গেলাম, তবে আমাদের সম্পর্কে নুন্যতম ফাটল ধরেনি।
লাখু সাহেব এবং তার সন্তান গোলাম শাব্বির সাহেবের ইন্তেকাল হয়ে গেছে তবে গোলাম শাব্বির সাহেবের ছেলে গোলাম হাদি সাহেব যিনি বর্তমানে এস্টেট এজেন্সির কাজ করেন তার সাথে এখনো নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
আমাদের নিচে অর্থাৎ তৃতীয় তলায় থাকতেন উজির গুল। তিনি নেভির একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ছিলেন। তার বাড়ি ছিলো সো’বায়ে সারহাদ (বর্তমান খাইবার পখতুখা) অর্থাৎ‘কেপিকে’।
তাদের সাথেও এতটাই হৃদ্যতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো যে তার স্ত্রী আমার আম্মাজানকে মা বলে ডাকতেন। তার সন্তান শাহজাহান এবং তার বোনরা নিয়মিত আমাদের বাসায় আসাযাওয়া করতো।
উজির গুল সাহেবের স্ত্রীর যেকোন সমস্যা দেখা দিলে আমার আম্মাজানের কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে আসতেন।
আপনার ব্যবসা সহজ করবে বিসফটি – বিস্তারিত জানুন
চতুর্থ তলায় আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে আরেকটি ফ্ল্যাট ছিল। এটিতে পারস্যের মায়মান গোত্রের একটি পরিবার থাকতো। তাদের ঘরের দরজায় পাউডার নিয়ে অঙ্কিত সাজসজ্জা দেখা যেতো যেটি সে সময়ে পার্সিদের ঘরের নিদর্শন ছিলো।
দ্বিতীয় তলায় সাহারানপুর থেকে আগত একজন মুহাজির থাকতেন। তিনি পেশায় সরকারি অফিসার ছিলেন।
নিচতলায় একটি মধ্যবয়সী ইংরেজ দম্পতির আবাস ছিলো। ইংরেজ পুরুষের একহাত ছিলো বিকল এবং তাদের ঘরের সামনে একটি ছাদবিহীন পুরাতন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম।
গাড়িটি স্বীয় মালিককে যা সেবা দিতো তারচে বেশি মালিক থেকে সেবা নিতো। আমরা দেখতাম, যদি তারা সন্ধ্যায় কোথাও যাবার ইচ্ছে করতো সেই দুপুর থেকে যন্ত্র হাতে কখনো গাড়ির বোনাটের সামনে কখনো গাড়ির নিচে শুয়ে গাড়ির পরিচর্যা করতে থাকতো।
ধুয়েমুছে সন্ধ্যায় ইংরেজ দম্পতী গাড়িতে চড়তো। গাড়ির স্টার্টের আওয়াজ শুনে আমরা বুঝতাম ধোয়ামোছা শেষে গাড়ি এখন তাদের সেবার জন্য প্রস্তুত। চলবে...
আগের পর্ব: ভারত থেকে পাকিস্তান যাওয়ার পথে কয়েক টুকরো স্মৃতি
-আরআর