শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


শিশুদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন; কী পেলাম, কী পেলাম না!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বদরুন আখতার জলি
অতিথি লেখক

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে একটি সফল আন্দোলন হয়ে গেল। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন আন্দোলন কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ধারণা করতে পারি পৃথিবীর বুকে যেমন আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি, একইভাবে আমরাই একমাত্র জাতি যাদের শিশু কিশোররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে। আবাল বুড়ো বনিতার অভূতপূর্ব সাড়া এবং সমর্থন পেয়েছে।

আন্দোলনের অপরাজনৈতিক ব্যবহার যদি বাদ দিই, তবে আমি বলবো শিশুদের এ আন্দোলন শতভাগ সফল। তারা আমাদের অনেক কিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গোটা বাংলাদেশকে তুমুল এক ঝাকুনি দিয়েছে।

এই আন্দোলনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির হিসাব কষলে হয়তো অনেক কথা বলা যাবে, মোটা মোটা দর্শন লেখা যাবে, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এখানে না পাওয়ার কিছু নেই। শোলআনা প্রাপ্তিতে ঠাসা কোমলমতি আন্দোলনটি বিশ্ব ইতিহাসের মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

এই আন্দোলনটি না হলে হয়তো আমরা কোনো দিনই জানতে পারতাম না- বাংলাদেশের ভিআইপি, সিআইপি, রাজনীতিক, সচিব, আমলা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, সাংসদ, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বিচারপতিদের বড় অংশের গাড়ির কোনো বৈধ কাজগপত্র থাকে না। তারা অবৈধ গাড়ি ব্যবহার করেন। তাদের গাড়ির চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে না। তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া অথবা নকল লাইসেন্সধারী চালকদের লালন করেন, চাকরি দেন।

অর্থাৎ আমাদের দেশের উঁচু চেয়ারের বড় মানুষরা আইন মানেন না। তারা নিজেদের আইনের উর্ধ্বের মানুষ মনে করেন।

এমন বিরল সৎ প্রজাতির ‘বড় মানুষ’ কী পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে? নাকি এক্ষেত্রেও আমরাই একমাত্র উদাহরণ? উত্তর আমার জানা নেই।

এ আন্দোলনটি না হলে হয়তো জানতে পারতাম না- আমাদের নতুন প্রজন্ম ভেতরে ভেতরে কতো কঠিন রকম দেশপ্রেম লালন করে। তারা আমাদের শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ভঙ্গুর দশায় খুব জোরে পদাঘাত করে প্রমাণ করেছে, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত।

ছাত্রদের এই আন্দোলন না হলে হয়তো আরো একটা বিষয়ে জানা হতো না, তা হলো- কী ভয়ানক রুচিহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আন্দোলনে তারা কতো সহজ সাবলীলভাবে কূরুচিপূর্ণ স্লোগান লিখলো, মুখে বললো।

তারা একবারও ভাবলো না এই কূরুচিপূর্ণ স্লোগানগুলো তাদের মা-বাবারা দেখছেন। শিক্ষকরা দেখছেন। আত্মীয়-স্বজন মুবব্বিরা দেখছেন। গোটা বিশ্ব দেখছে। রুচিহীনতার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েতেও কোনো বাছ-বিচার দেখলাম না। কতো অবলিলায় তারা ছেলে-মেয়ের বৈষম্য ভেঙ্গে ফেলেছে!

এমন শিক্ষা তারা পেলো কোথায়? আমাদের শিক্ষায় সংস্কৃতিতে তো এমন কূরুচির ব্যবহার নেই। আমাদের মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরেও এমন ভাষার ব্যবহার দেখিনি কখনো। এরা পেলো কোথায়? কীভাবে এরা এমন কূরুচিপূর্ণ ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলো?

যারা রাজপথের একটি জাতীয় আন্দোলনে কোনো প্রকারের রাখ-ঢাক ছাড়াই এমন কূরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, মজা দুষ্টামি করে, তখন তাদের ভাষার লেভেল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, কেউ কী চিন্তা করতে পারেন?

এই প্রজন্ম যখন বড় হবে, দেশের বড় বড় চেয়ারে বসবে তখন আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতার কী হাল হবে, কেউ কী ভাবতে পারেন?

এই অশ্লীল তালিম ওরা কোথায় পেলো? মিডিয়া থেকে? আমাদের লিভিং রুমের বিনোদন মাধ্যম অনেক দিন থেকে উঠে পড়ে লেগেছে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটাতে। তারা নাটক সিনেমায় অবলীলায় ভাষার অশ্লীল ব্যবহার দেখায়। চিত্র দেখায়। প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে এমন কিছু শব্দের ব্যবহার তারা সহজ করে তুলেছে যা নিছক রুচিহীনতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

প্রেম ভালোবাসা, সমাজ সামাজিকতাসহ সব কিছুর যে একটা সৌন্দর্য আছে, প্রাইভেসি আছে এটা তারা আর মানতে চায় না। তারা প্রতিযোগিতা করে ‘পাশ্চাত্য’ হতে চায়। ব্যাভিচারের প্রথম স্তর ‘প্রকাশ্য চুম্বন, নারী পুরুষের প্রকাশ্য আলিঙ্গন, চটুল কথাকথি’ তারা সহজ করে তুলতে চায়। তারা দেশকে পাশ্চত্যের মতো এগিয়ে নিতে চায়।

কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নাটক সিনেমায় দেখলাম না- পাশ্চত্যের নাগরিকদের মতো আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, নিয়ম মানা, নিয়ম অমান্য না করা, সততা, মানবতা, মানবিকতা শেখাতে। তারা বাংলাদেশকে পাশ্চাত্যের মতো এগিয়ে নিতে চায় শুধু অশ্লীলতা এবং যৌনতার দিক থেকে। তারা ব্যাভিচারকে জাতীয়ভাবে বৈধতা দিতে চায়।

শিশু কিশোরদের এই আন্দোলন থেকে আমরা নতুন করে জানতে পেরেছি, আমাদের রাজনীতিকরা, মন্ত্রী এমপিরা কতো দক্ষতার সাথে একটা সুস্থ আন্দোলনকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। তারা কতো নিপুন ভবে রাজনীতির অপব্যবহার করতে জানে।

এই আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছে, মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে কতো ভয়ঙ্করভাবে ভোগাস খবর বা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ কতোভাবে প্রতারিত, বিভ্রান্ত হয়।

ব্যবসার হিসাব নিয়ে জটিলতা আর নয়, ক্লিক করুন

শিশুদের এই আন্দোলন দেখিয়েছে, আমাদের দেশের নামকরা লেখক, বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন স্তরের সমাজ উন্নয়ন কর্মী, মানবাধিকার কর্মীরা কতোটা সুবিধাবাদী, সরকারের অনুগ্রহভোগী।

এই আন্দোলন দেখিয়েছে, আমাদের সরকার ভেতরে ভেতরে কতো অগোছালো। তারা বাইরে থেকে উঁই এর ঢিবির মতো একটা শক্ত আবরণ সৃষ্টি করে রেখেছে, কিন্তু ভেতরটা একদম ফাঁপা।
এত অগোছালো, এত সিদ্ধান্তহীন, অসহায় সরকার কী বাংলাদেশে আগে কখনো ক্ষমতায় এসেছে? আমার মনে হয় না।

একজন শ্রমিক নেতার (মন্ত্রী) কাছে সরকার এত অসহায় কেনো? ছোট ছোট শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করতে ছাত্রলীগ নামাতে হয় কেনো? সরকার কেনো সব কিছুতে রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পুলিশি সমাধান, বাঁশ, হাতুড়ি, চাপাতির সমাধান খোঁজে?

সরকারের নেতা মন্ত্রীরা কেনো অপপ্রচার আর অভিযোগের প্রতিযোগিতায় নামে? এত অসারতা কেনো তাদের?

এই আন্দোলন থেকে আবারও প্রমাণ হলো- আমাদের সরকার একচুলও সংশোধন হয়নি। এক পাতাও শিক্ষা নেয় নি। তারা আগের জায়গাতেই পড়ে আছে- প্রথমে একটু নরম হওয়া, দাবি মেনে নেয়ার কথা বলা, এর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে শক্ত হওয়া। শক্তি প্রয়োগ করে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা।

নিকট অতীত আন্দোলনগুলোতে আমাদের সরকার যা করেছে, এখনো তা’ই করছে। হামলা, মামলা, রিমান্ড আর বিরোধীদের ওপর দোষ চাপানোর কৌশলেই আটকে আছে। তারা কোনোভাবেই বুঝতে চেষ্টা করছে না, নতুন প্রজন্ম আর আগের জায়গায় নেই। তারা এখন আর টিডিকে ক্যাসেট ব্যবহার করে না যে ফিতা পেঁচিয়ে একই জায়গায় ঝুলে থাকবে।

শিশু কিশোরদের এই আন্দোলন যে জাতির গালে কষে এক চপেটাঘাত ছিল তা বুঝতে হবে আমাদের জাতীয় নীতিনির্ধারকদের। সরকার এই বাস্তবতা যতো তাড়াতাড়ি বুঝবে বা বোঝার চেষ্ট করবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল তত তরান্বিত হবে।

অন্যথায় আবারও জেগে উঠবে নতুন প্রজন্ম। তখন হয়তো বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য হতে- হতে পারে।

লেখক: মানব সম্পদ উন্নয়ন গবেষক

ভোটের আগে জোটের খেলায় ইসলামপন্থীরাও!

-আরআর


সম্পর্কিত খবর