বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


তিন সিটি নির্বাচন; কেমন করবে ইসলামপন্থীরা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান
ইতালি থেকে

শুরুতেই একটা কথা বলে নেয়া দরকার, ভোটের মাঠে ইসলামপন্থী বলতে এখন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকেই ধরে নেয়া হয়। কারণ অন্য কোনো ইসলামি দলকে ভোটের মাঠে সক্রিয় দেখা যায় না।

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নেই। তারা দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারে না। অন্যান্য দলগুলোকেও সক্রিয় দেখা যায় না। অধিকাংশ দল বড় দুই দলের সাথে জোটবন্ধ রাজনীতি করে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেই।

গাজীপুরের নির্বাচনে অবশ্য ইসলামি ঐক্য জোট অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাদের প্রাপ্ত ভোট এবং ভোটের মাঠের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল না। সুতরাং সাধারণ বিবেচনায় ভোটের মাঠে এখন ইসলামপন্থী দল হিসাবে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশকে আমলে নেয়া হয়।

এই দলটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, কুমিল্লা, খুলনা এবং গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে। তারা ওইসব নির্বাচনে হাতপাখা প্রতীকে আহামরি ভোট না পেলেও ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান দেশবাসীকে জানান দিতে সক্ষম হয়েছে।

আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনেও ইসলামি আন্দোলন হাতপাখা প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে। ভোটের মাঠে তাদের বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বরিশালের সিটি নির্বাচন নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের বেশ আশাবাদী বলে মনে হচ্ছে। এই প্রথম বারের মতো তারা কোথাও বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে।

বরিশাল যে কোনো বিবেচনায় ইসলামী আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। কারণ ইসলামী আন্দোলনের সুতিকাগার হিসাবে বরিশালকেই গণ্য করা হয়।

বরিশালের চরমোনাই ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠতা সৈয়দ ফজলুল করিম রহ. এর বাড়ি। দীর্ঘ দিন ওই ইউনিয়নের চেয়ারমেন ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম। বর্তমানে তার ভাই সৈয়দ আবুল খায়ের চেয়ারমেনের দায়িত্ব পালন করছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ওই এলাকায় চেয়ারম্যান হিসাবে সৈয়দ রেজাউল করিম বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। এখন তার ভাই আবুল খায়েরও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন। তাছাড়া চরমোনাই তরিকা, চরমোনাই মাদরাসাসহ বরিশাল অঞ্চলে অনেক বছর থেকে ধর্মপ্রচারক হিসাবে তারা পারিবারিকভাবে বেশ প্রসিদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। চরমোনাইর মাদরাসায় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করে থাকতেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অস্ত্রাগার ছিল বলে জানা যায়।

সব মিলিয়ে বরিশাল ইসলামি আন্দোলনের জন্য দেশের অন্য যে কোনো জেলা শহর থেকে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ইসলামি আন্দোলন বিজয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব একজন মাদরাসার শিক্ষক এবং হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা। প্রসিদ্ধ আলেম হিসাবে বরিশালে তার পরিচিতি আছে।

ইসলামী আন্দোলন মনে করছে মাওলানা মাহাবুবের ব্যক্তি ইমেজ, হেফজতের নেতা হিসাবে স্থানীয় আলেম ওলামাদের সমর্থন এবং আন্দোলনের ভোট ব্যাংক মিলিয়ে তিনি নির্বাচিত হতে পারবেন।

তাছাড়া আওয়ামী লীগের তরুণ প্রার্থীর ইমেজ সংকট আছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিএনপি পুড়ছে দলীয় কোন্দলে। শোনা যাচ্ছে মজিবর রহমান সরোয়ার অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো বিজয়ের জন্য ইসলামী আন্দোলনকে আশাবাদী করে তুলেছে।

ইসলামি আন্দোলনের নেতা সৈয়দ ফয়জুল করিম গত একমাস যাবত বরিশালে অবস্থান করছেন। দেশব্যাপী সকল সাংগঠনিক কর্মসূচি স্থগিত করে তিনি ফুলটাইম মাওলানা মাহবুবের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

প্রতিদিন মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন, ভোট কেন্দ্রীক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। তার দলের নেতাকর্মীরা দাবী করছেন বরিশালের মানুষ এবার পরিবর্তন চায়। সাধারণ মানুষ ইসলামী আন্দোলনের আহবানে সাড়া দিচ্ছে। সেখানে হাতপাখার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

আসলেই কী তাই? হাতপাখার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে? এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশালের সিটি নির্বাচনে এবারই প্রথম হাতপাখা প্রতিদ্বিন্দ্বীতা করছে। তারা ব্যাপক আকারে নির্বাচনী প্রচারণাও চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে। মানুষ হাসি মুখে তাদের লিফলেট গ্রহণ করছে।

কিন্তু এসবের অর্থ কী এটা ধরে নেয়া যায় সবাই হাতপাখায় ভোট দেবে? একজন আলেম হিসাবে, ধর্মপ্রচারক হিসাবে মানুষের সম্মান শ্রদ্ধা পাওয়া আর নির্বাচনে ভোট পাওয়া যে এক কথা নয় তা হয়তো বুঝতে তাদের আরো কিছুটা সময় লাগবে।

তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা গুঞ্জন আছে, ইসলামী আন্দোলন কেনো হেফাজত নেতাকে প্রার্থী করতে গেলো? তাদের দলে কী কোনো যোগ্য প্রার্থী ছিল না?

হেফাজতের সাথে যে ইসলামি আন্দোলনের সুসম্পর্কের কিছুটা ঘাটতি আছে তা সচেতন মহলের অজানা নয়। সরকার বিভিন্নভাবে হেফাজতকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল এবং নেতারা থাকার কারণে হেফাজতের প্রতি পর্দার আড়াল থেকে বিএনপির যে একটা প্রভাব থাকতে পারে এমন ধারণা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।

সুতারাং বরিশালের সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন যতো সহজ অংকে বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তব নাও হতে পারে।

দলীয় সূত্র দাবী করেছে, ইসলামী আন্দোলন মাওলানা মাহবুবকে হাতপাখার প্রার্থী করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। তারা অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোকে, বিষেশ করে যারা বিএনপির সাথে জোট বদ্ধ রাজনীতি করে তাদের বিশেষ একটা বার্তা দিতে চেষ্টা করেছে।

তবে রাজনীতির জটিল সমীকরণ থেকে দূরে থাকা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপি জামায়াতসহ জোটবদ্ধ দলগুলো একটা সরু বিশ্বাস বেশ সফলভাবে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে- ইসলামী আন্দোলনের সাথে আওয়ামী লীগের একটা গোপন বোঝাপড়া আছে। যদিও ইসলামি আন্দোলন সব সময় এসব অভিযোগ অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

অভিযোগকারীরাও দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে এই বিশ্বাসের বীজ উপড়ে ফেলতে পারেনি ইসলামী আন্দোলন।

সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাসে ঘি ঢালছে বিএনপি জামায়াত।

রাজশাহীর একজন বিএনপি নেতা খুব পরিস্কার করেই এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বলেছেন, সরকার বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে বিভিন্ন দলকে মাঠে নামায়, ভোটের মাঠে ইসলামী আন্দোলন তেমনই একটা দল।

রাজশাহীর এক ভোটারের সাথে কথা হলো- তিনি বললেন, হাতপাখা সেখানে হাজার পাঁচেক ভোট পেতে পারে। আমি বললাম, তাদের কাছে অতীতের ভোটের হিসাব তো তা বলে না। তারা অন্যান্য সিটিগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার ভোট পেয়েছে।

তিনি বললেন, রাজশাহী বিএনপি জামায়াতের ঘাঁটি। সেখানে সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগেরই জামানত টেকানো কষ্ট হয়ে যায়। হাতপাখা উল্লেখযোগ্য ভোট পাবে কী করে?

ভোটের হিসাব তো আবেগ দিয়ে হয় না। তাছাড়া এবারই প্রথম তারা রাজশাহী সিটি নির্বাচন করছে, তাদের অভিজ্ঞতার অভাব আছে। তাদের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম খুব পরিচিত কেউ নয়। সুতরাং আবেগি হিসাব না করলে হাতপাখা রাজশাহীতে খুব একটা ভালো করতে পারবে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, তারা যদি লেগে থেকে, এই ভোটের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে, গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দিতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় বিধি নিষেধের কড়াকড়ি দেখিয়ে দূরে সরিয়ে না রাখে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে, গণমানুষের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলে, সুখ দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তবে পরবর্তিতে ভালো করবে। তারা এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি।

সিলেটের প্রার্থী নিয়েও ইসলামী আন্দোলন বেশ আশাবাদী। তাদের প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক, প্রফেসর। কিন্তু ভোটের মাঠে তিনি কতোটা জনপ্রিয় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিএনপির হেভিওয়েট দুই প্রার্থীর বিপরীতে তিনি কতোটা ভালো করতে পারবেন তা সত্যিই ভাবনার বিষয়।

তবে ইসলামী আন্দোলন হিসাবটা একটু অন্যভাবে করার চেষ্টা করছে। তারা মনে করছে বিএনপিতে গৃহদাহ প্রকাশ্যেই চলছে। জোট ভেঙ্গে জামায়াত সেখানে প্রার্থী দিয়েছে।

আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে এন্টি-স্টাবলিষ্ট মনোভাব কাজ করছে। এই সুযোগে তাদের প্রার্থী সেখানে ভালো ভোট সংগ্রহ করতে পাবে।

তবে নির্বাচনের জটিল হিসাব তা বলে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধা সম্মানের জায়গা থেকে ভোট দেয় না। শিক্ষিত, অশিক্ষিত দেখে ভোট দেয় না। তাদের কাছে ভোটের হিসাব একেবারেই ভিন্ন রকম।

তাছাড়া জামায়াত কোনোভাবেই ইসলামি আন্দোলনকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা সিলেটে প্রার্থী দিয়েছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার হিসাব কষে। প্রথমত জাতীয় নির্বাচনের আগে জোটে তাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় কারণ হলো ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর পরিচিতি, জনপ্রিয়তা এবং জোটের টানা-হেঁচড়ায় ধর্মপ্রাণ কিছু মানুষের ভোট হাতপাখায় চলে যেতে পারে, যা কোনোভাবেই হতে দিতে চায় না জামায়াতে ইসলামি।

তারা প্রয়োজনে নিজের নাক কেটে হলেও ইসলামি আন্দোলনের যাত্রা ভঙ্গ করতে চায়।

সমালোচক, নিন্দুকদের কথার বাইরে বেরিয়ে যদি দুর প্রসারী হিসাব মেলানো হয় তবে ইসলামী আন্দোলন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভাবনাময় একটি স্বতন্ত্র শক্তি। দেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা যদি সত্যিকারার্থে এই বাস্তবতা বুঝতে পারে এবং সময়ের চাহিদা বুঝে গণমানুষের জন্য স্মার্ট রাজনীতি করে তবে সে দিন খুব বেশি দুরে নয়- ইসলামপন্থীরাই হবে দেশের রাজনীতিতে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি।

শেষ কথা

সব হিসাব নিকাশ ভেস্তে যাবে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়। সরকার যদি খুলনা, গাজীপুরের মতো ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন করে, নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকে কাঙ্খিত ভোট পড়বে না। জনরায় যাচাই হবে না। আশঙ্কায় পড়ে যাবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন।

লেখক: ইসলামপন্থী রাজনীতি বিশ্লেষক

প্রচারণায় এগিয়ে নৌকা; হারতে চায় না বিএনপি; মাঠে হাতপাখাও

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ