শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


‘চোখ-কান খোলা রাখলে টের পাবেন পর্দার আড়ালে অনেক কিছু হচ্ছে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত আলেম সাংবাদিক। লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩ দশক ধরে। বিশিষ্ট আলেম পরিবারে জন্ম নেয়ায় এবং সাংবাদিকতার সূত্রে সাধারণ ও আলেম সমাজে তার বিচরণ অবাধ। কাছ থেকে দেখছেন দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন।

সম্প্রতিক হেফাজতে ইসলাম নিয়ে মিডিয়ায় শুরু হওয়া গুঞ্জন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন এ আলেম সাংবাদিক। কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থান কী তা নিয়ে গণমাধ্যমে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। হেফাজত কি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারছে না?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : দেশের গণমাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান কি; বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে গুঞ্জন চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বিভিন্ন মধ্যমাধ্যমে হেফাজতের আসন বণ্টনের মতো বিষয়ও এসেছে।

জন্মলগ্ন থেকে সংগঠনটি বলে আসছে রাজনীতির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও মনে হয়, মিডিয়ার কোনো একটি অংশ হেফাজতের গায়ে রাজনীতির লেবেল লাগাতে উৎসাহী।

হেফাজতে ইসলামের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা যাদের ভিন্ন দল রয়েছে- তাদের কার্যক্রমকে হেফাজতের বলা হচ্ছে। আর সেটা যে অজ্ঞতার কারণে করছে আমার তা মনে হয় না। সাংবাদিক হিসেবে এতোটুকু সচেতনতা তাদের অবশ্যই রয়েছে।

তবে এটা অসম্ভব নয় যে, হেফাজতের কোনো কোনো নেতা ‘হেফাজত পরিচয়’ সামনে রেখে দেন দরবার করছে। এটা এক ধরনের অসততা। বিষয়টি এমন হলে সাংবাদিকদের এক তরফাভাবে দোষ দেয়া যায় না।

আওয়ার ইসলাম : নাকি তারা হেফাজতের রাজনৈতিক প্রভাবকে ভয় পাচ্ছে?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ হেফাজতের রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা এ দেশের ভোটার। হেফাজতের অনুসারী দল ও ব্যক্তিরা জাতীয় নির্বাচনে একদিকে যাবে। এজন্য হেফাজতকে সরকার ও সরকার বিরোধী সবাই কাছে টানতে চাচ্ছে। সেটা অস্পষ্ট কিছু নয়।

আওয়ার ইসলাম : মিডিয়া হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্য ও এক ধরনের যোগাযোগ দাবি করে। বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের নীতিনির্ধারক নেতৃবৃন্দ ভালো বলতে পারবেন। তবে যখন সরকারের কোনো মন্ত্রী বলেন, ‘হেফাজত আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা বললে কর্মসূচি দেয়, নিষেধ করলে প্রত্যাহার করে এবং তার শক্ত কোনো প্রতিবাদ হয় না তখন মিডিয়ায় নানা কল্পনা-জল্পনা ডানা মেলতেই পারে।

আমার জানা মতে হেফাজতের কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য পর্যন্ত করেন নি। অথচ সরকারের এমন বক্তব্যের জোর প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিলো। যদিও হেফাজত আমীর ও মহাসচিব বারবার স্পষ্টকরে বলছেন, আমাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। হেফাজত একটি ঈমানী আন্দোলন।

গত কয়েক দিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উপদেষ্টা দিল্লিতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে আমাদের যে সখ্য তা আন্তরিক বা নীতিগত নয়; (টেক্টফুল) কৌশলগত।’ হেফাজতে ইসলাম তার কথারও কোনো প্রতিবাদ করে নি।

আওয়ার ইসলাম : আপনি বলছিলেন, হেফাজতে এমন লোক থাকা অসম্ভব নয় যারা হেফাজতকে সামনে রেখে বিভিন্ন গোষ্ঠির সঙ্গে দেন-দরবার করতে চায়। প্রশ্ন হলো, হেফাজত কি তাদের অসততা রোধ করতে পারবে?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : যারা এমন করছে তারা নিজেদের দীন দুনিয়া উভয়টিই বরবাদ করছে। ১৩ দফায় বর্ণিত ঈমানী ও শরীয়তি ইস্যুসমূহ শিকায় তুলে রেখে যারা দু’য়েকটি আসন আর কিছু টাকার বিনিময়ে কোটি তওহীদি জনতার ঈমানী আবেগ কে বিক্রি করছে তারা এজন্য নিজেরাই একদিন জবাবদিহি করবে।

এর দায় ঈমানদার কোটি মানুষ নেবে না। হেফাজতের মুরব্বীরাও না। তবে হেফাজত তাদের রুখতে পারবে কি না সে প্রশ্ন ভিন্ন। কারণ, হেফাজতে ইসলাম শক্ত কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সাংগঠনিক ব্যবস্থার বাইরে হেফাজত একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে চলছে।

হেফাজত চলছে আল্লামা আহমদ শফি-এর একক ও প্রশ্নাতীত নেতৃত্বে। হেফাজতের সবাই মনে করেন, হুজুরের দোয়া, তার মনের খেয়াল বা ইলহাম এ সংগঠনের জন্য বেশি ফলপ্রসূ। তার দ্বারা ইসলামের কোনো ক্ষতি হবে না। এটা ঈমানি ও আধ্যাত্মিক সংগঠন।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতে ইসলামের একজন যুগ্ম-মহাসচিব আওয়ার ইসলামকে বলেছিলেন, যে দল হেফাজতের দাবির প্রতি যতো বেশি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং তাদের নির্বাচনী এজেন্ডাভূক্ত করবে- তারা হেফাজতে ইসলামের সমর্থন পাবে। এটা কি এক ধরনের আপোষের ইঙ্গিত?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : না। এ কথা যিনি বলেছেন তিনি ঠিক বলেছেন। তার কথা যৌক্তিক। কারণ, হেফাজতে ইসলাম তো কিছু দাবি নিয়েই মাঠে নেমেছে। দাবিগুলো ঈমানি দাবি হলেও তার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রের গতি নির্ধারক শক্তির অনিচ্ছা থাকলে তা সম্ভব নয়।

সুতরাং কেউ হেফাজতের দাবি মানলে তার সমর্থন পাবে এ কথা বলায় কোনো দোষ দেখছি না। প্রশ্ন হলো দাবী মানবে কি না। না কি অঙ্গীকার ভঙ্গের মধ্য দিয়ে হেফাজতওয়ালারা প্রতারিত হন। ৩০ আসন বলে সমর্থন নিয়ে দেওয়া হয় ৩ আসন।

কওমী স্বীকৃতি, আলেমদের অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয় সেক্যুলার স্টাইলে। দু’য়েকজন চিহ্নিত লোভী ও ব্যক্তিত্বহীন নেতাকে ফ্ল্যাট, গাড়ি, টাকা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে গোটা আলেমসমাজের সর্বনাশ যাতে না করা হয়। এসব বিষয় ভেবে কাজ করতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতে ইসলাম কি রাজনীতির বাইরে থেকে –দাবি আদায়ের স্বার্থে- রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারবে?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : আমার মনে হয়, সেটা করতে পারে। এতে কোনো দোষ নেই। কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে হেফাজতের দাবি নব্বইভাগ নাগরিকের দাবি আমরা তা মানবো। হেফাজত প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তাদের সমর্থন দিতে দোষ কোথায়?

তবে হ্যাঁ, এখানে কিছু বিষয় হিসেবেরও আছে। যেমন, তারা কথা রাখবে কি না? রাখলে কতোটুকু রাখবে? সব মিলিয়ে তাদের সমর্থন দেয়া যায় কি না? সমর্থন দিলে কতোটুকু দায় আমাদের মাথার ওপর আসবে।

তাছাড়া হেফাজতকেও একথা মনে রাখতে হবে যে এটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। তাদের নির্দেশনা রাজনৈতিক ময়দানে তেমন কার্যকর নয়। নয়তো সরাসরি হেফাজতের ছায়া ও নেতৃবৃন্দের ছোটাছুটির পরও গাজীপুরে তারা দুই হাজার ভোটও পাননি কেন?

মোটকথা হেফাজতের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ হবে মারাত্মক ভুল ও আত্মঘাতি। এটি ঈমানী আন্দোলন হিসাবেই সফল হতে পারে। সরাসরি রাজনীতিতে নয়।

আওয়ার ইসলাম : সামনের জাতীয় নির্বাচনে হেফাজতের সামনে নানান ধরনের প্রলোভন, প্রস্তাব অথবা প্রেসার আসা অসম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে হেফাজতের করণীয় কী হবে?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : এমন পরিস্থিতিতে হেফাজতের চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিবেন। অথবা হুজুরকে (আল্লামা আহমদ শফী) সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে তার কাছ থেকে সিন্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।

বিশেষত হেফাজতের যেসব নেতা হেফাজতকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করতে চায় তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : আপনি কাদের নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। স্পষ্ট করবেন কি?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : আমি কারো নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। তবে চোখ-কান খোলা রাখলে আপনিও টের পাবেন পর্দার আড়ালে অনেক কিছু হচ্ছে।

সারা দেশে হেফাজতের বিপুল পরিমাণ সমর্থক গোষ্ঠি রয়েছে। তারা জানে লেনদেনের জন্য এটা ভালো পূঁজি। তাই যেমনটি শোনা যাচ্ছে যে, হেফাজতের পদ-পদবী, নেতৃত্ব, আত্মীয়তা ও আঞ্চলিক প্রভাব ইত্যাদিকে ব্যবহার করে অনেকেই লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের ব্যাপারে দেশবাসীর সতর্ক থাকতে হবে।

কারণ, অতীতে যেসব দেশে ইসলাম বিরোধী শক্তি ধর্মীয় উন্নত অবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে, সেসব দেশেও একদল লোভী ও আদর্শহীন লোককেই তারা প্রথমে কিনে নিয়েছিল।

এরপর যখন প্রজন্মের মহা সর্বনাশ হয়ে যায়, ইসলামের চরম ক্ষতি সাধিত হয় তখন মানুষ বুঝতে পারে যে, গুটিকয় দুষ্ট লোক একটি জাতির কত বড় সর্বনাশ করতে পারে।

আওয়ার ইসলাম : আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যদি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো প্রস্তাব আসে সে ক্ষেত্রে হেফাজতের কী করা উচিৎ?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : শোনা যাচ্ছে, বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনীতিতে বিরাট শূন্যতা তৈরি হবে। তখন ইসলামি রাজনীতিবিদদের উচিৎ হবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ গ্রহণ করা। কারণ, সংসদে প্রতিনিধিত্ব তাদের নেতৃত্বকে প্রভাবশালী ও সুসংহত করবে।

আর সেটা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়েও সম্ভব। তারা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছক সাজিয়ে আসন বন্টন ও নির্বাচন করলে বেশকিছু সিট পেতে পারেন। বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলেও তারা দীনের কথা জোর গলায় বলতে পারবেন।

তবে যদি বিএনপি মাঠে থাকে এবং রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি না হয় তখন তাদের অন্যভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতের ব্যানারেই?

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : না, হেফাজতের ব্যানারে নয়। প্রত্যেক ইসলামি রাজনৈতিক দল তার দলের ব্যানারে নির্বাচন করবেন। প্রয়োজনে জোটের আকারে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই হেফাজতের ব্যানারে নয়। হেফাজতের ব্যানারে নির্বাচন মানেই হেফাজতের অপমৃত্যু।

আওয়ার ইসলাম : আওয়ার ইসলামকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : আপনাকে ও আওয়ার ইসলাম পরিবারকে আমার পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ।

একই বিষয়ে দেয়া আলেম সাংবাদিক শরীফ মুহাম্মদের সাক্ষাৎকার পড়ুন: ‘জাগরণমূলক যে কোনো আন্দোলনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়েই’

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ