শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


স্ত্রীর প্রতি সদাচার : একজন বুজুর্গ ডাক্তারের দৃষ্টিপাত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আমজাদ হোসাইন : বিশ্বমানের শাশ্বত জীবনবিধান ইসলামে আছে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও সদাচারের জোরালো নির্দেশ। দাম্পত্য জীবনের সুদীর্ঘ সফরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য এ নির্দেশ সমভাবে প্রযোজ্য।

দায়িত্বশীল হিসেবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর তুলনায় স্বামীর দায়বদ্ধতা বেশি। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্বামীদের আদেশ করে বলেছেন, স্ত্রীদের সঙ্গে ওঠাবসা করো সদাচারের সঙ্গে। তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ আল্লাহ যার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন। (নিসা : ১৯)

অর্থাৎ তাদেরকে ভালোবাসো, তাদেরকে যাথাসাধ্য মনোরঞ্জন দাও। উত্তম অন্নবস্ত্র দাও। তাদের সেবা, ত্যাগ ও অবদানকে মূল্যায়ন করো। ত্রুটি গুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো।

অন্যদিকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের বিশেষ উপদেশ দিয়ে বলেছেন, শোনো, নারীদের বিষয়ে তোমরা কল্যাণের উপদেশ গ্রহণ করো। কেননা তারা তোমাদের সঙ্গে একটি সম্পর্কে আবদ্ধ। (তিরমিযি, ১১৬৩, ইবনে মাজাহ, ১৮৫১)

অর্থাৎ তারা শুধু কবুল শব্দ বলার দ্বারা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে তোমাদের দাম্পত্য গ্রহণ করেছে। এখন তোমরা চাইলে তাদের দাম্পত্য জীবনে এনে দিতে পারো অনাবিল সুখ। আবার চাইলে অবিরাম দুঃখ-কষ্টও দিতে পার।

তবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহজগত থেকে বিদায়কালে তোমাদের থেকে তাদের জন্য কল্যাণকর আচরণ করার আদেশ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। কারণ তাদেরকে তোমরা আল্লাহর আমানতরূপে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর নামে বিয়ে করেছ। (তিরমিযি)

আরো ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম। (তিরমিযি)

অর্থাৎ অন্যসব বিষয়ের মতো স্ত্রীর প্রতি সদাচারের ক্ষেত্রেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে আদর্শ রূপে তুলে ধরেছেন যে, স্ত্রীদের প্রতি সদাচারের ক্ষেত্রে তোমরা আমাকে অনুসরণ করো।

অন্য বর্ণনায় আছে, মুসলিমদের মধ্যে ঈমানের দিক থেকে সেই সর্বোত্তম যার চরিত্র উত্তম এবং স্ত্রীর সঙ্গে যার আচরণ সৌহার্দ্যপূর্ণ। (আবু দাউদ)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে আর আল্লাহর রসূল সা. হাদিস শরিফে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে সদাচার করার প্রতি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের পূর্বসুরীগণও অধিক সচেতন ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত ডা. আব্দুল হাই আরিফি রহ.। তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি রহ. এর নিকট দীক্ষাপ্রাপ্ত এবং আত্মশুদ্ধির বিষয়ে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে আজীবন কিরূপ আচরণ করেছেন।

একবার জনৈক ব্যক্তি ডাক্তার আবদুল হাই সাহেব রহ.এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের হালাত জানাতে গিয়ে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ আমার ‘ইহসানের মাকাম’ হাসিল হয়েছে।

‘ইহসান’ কুরআনের একটি পরিভাষা। হাদিসে তার ব্যাখ্যা এই দেয়া হয়েছে যে, এমন মনোযোগের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করাকে ‘ইহসান’ বলে, যেন ন্যূনতম এ অনুভূতি তার হয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন। সে ব্যক্তি এ কথা বোঝাতে চেয়েছে যে, আলহামদুলিল্লাহ, ইবাদত করার সময় আমার এমন মনোযোগ লাভ হয়েছে, যাকে হাদিসের পরিভাষায় ‘ইহসান’ বলা হয়।

তখন হযরত ডাক্তার সাহেব তাকে মুবারকবাদ জানান এবং বলেন যে, ইহসান সত্যিই অত্যন্ত দামি একটি নেয়ামত, যা লাভ হলে আল্লাহর শোকর করা উচিত। কিন্তু আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা হলো, ইহসানের এই মাকাম আপনার শুধু নামাযের মধ্যেই লাভ হয়েছে, নাকি যখন আপনি আপনার পরিবার পরিজন কিংবা বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে কোন কাজ কারবার করেন, তখনও এ মনোযোগ বহাল থাকে?

তখন লোকটি বলল যে, আমি শুনেছি যে, ইহসানের সম্পর্ক শুধুমাত্র নামায ও অন্যান্য ইবাদতের সঙ্গে। তাই আমি শুধুমাত্র নামাযের মধ্যেই তার অনুশীলন করেছি এবং নামাযের মধ্যে আমার অনুশীলন আল্লাহর মেহেরবানিতে সফলও হয়েছে। কিন্তু নামাযের বাইরে জীবনের সাধারণ কাজকর্মের ক্ষেত্রে ইহসানের অনুশীলন করার কথা আমার মনেই আসেনি।

হযরত ডাক্তার সাহেব বলেন, এই ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করার জন্যই আমি আপনাকে এ প্রশ্ন করেছি। নামায ও অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই মনোযোগ কাংখিত বস্তু।

কিন্তু এই মনোযোগের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র নামাযের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রত্যেক কাজে এর প্রয়োজনীয়তা আছে। মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করার ক্ষেত্রেও এ কথার প্রতি মনোযোগ থাকা উচিত যে, মহান আল্লাহ আমাকে দেখছেন।

বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক এমন হয়ে থাকে, তারা পরস্পরের জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গী। জীবনে প্রতিটি মুহূর্তের সাহচর্যে তাদের মধ্যে বিচিত্র রকমের ঘাত-প্রতিঘাত এসে থাকে। নানা রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। দাম্পত্য জীবনে এমনও অনেক মুহূর্ত আসে, যখন মানুষের রিপু তাকে এ সমস্ত অপ্রীতিকর আচরণের উত্তরে অন্যায় আচরণ করতে প্ররোচনা দিয়ে থাকে।

এ সমস্ত মুহূর্তে এই মনোযোগের প্রয়োজনীয়তা আরো বৃদ্ধি পায় যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন। এ সমস্ত মুহূর্তে এই উপলব্ধি অন্তরে বদ্ধমূল না থাকলে সাধারণত তার পরিণাম অবিচার ও অধিকার হননরূপে আত্মপ্রকাশ করে থাকে।

অতপর ডা. সাহেব বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত হলো, তিনি সারাজীবনে কখনো পবিত্র স্ত্রীগণের সঙ্গে সহজাত ক্রোধ ও কঠোর আচরণ করেননি। এই সুন্নতের ওপর আমলের চেষ্টায় আমিও এ অনুশীলন করেছি, আমি আমার ঘরের লোকদের সঙ্গে ক্রোধান্বিত হব না।

আমি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে বলছি, আমার বৈবাহিক জীবনের আজ একান্ন বছর হয়ে গেছে, কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে আলহামদুলিল্লাহ, আমি কখনো তার সঙ্গে ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাও বলিনি। (ইসলাম ও আমাদের জীবন, ২৬৮)

বস্তুত স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে তাহলে তাদের দাম্পত্যজীবন হবে প্রকৃতপক্ষে সুখময়। অন্যথায় সুখ তো হবেই না বরং দুঃখের কোনো সীমা থাকবে না। যার বাস্তব প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তাই আসুন আমরা ইসলামের বিধি-বিধান মেনে দাম্পত্য জীবন গড়ি।

লেখক
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহমাদিয়া মাদরাসা।
কচুয়া, চাঁদপুর।


সম্পর্কিত খবর