শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


আমাদের বিশ্বাস ও চেতনাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় একটি শক্তিমান স্বাতন্ত্র্য তৈরি হওয়া দরকার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বাংলা ভাষায় ইসলামি ধারার সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। আলেম, চিন্তক ও কুশলী বুদ্ধিজীবী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গলিঘুপটি যার নখদর্পণে। শক্তিমান শব্দের গাঁথুনিতে বাংলা ভাষায় যারা বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞানের আলো বিতরণ করছেন, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন তাদের অন্যতম।

প্রয়োজনের খাতিরে অসংখ্য অনুবাদ করলেও মৌলিক লেখার হাতই তার সবচেয়ে বেশি উজ্জ¦ল। অনুবাদ ও মৌলিক মিলিয়ে এ যাবত সত্তর-ঊর্ধ্ব বই লিখেছেন তিনি। সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান থেকে আজকের সব ধারার ছোট-বড় মিডিয়ায় তার অবাধ পদচারণ। লাখ লাখ পাঠকের মন কেড়েছেন তিনি। জয় করেছেন সাহিত্যপ্রেমীদেরও হৃদয়রাজ্য।

ঘনিষ্ঠ আলাপে তার লেখকজীবনের টুকিটাকি তুলে এনেছেন তরুণ কবি ও সাংবাদিক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম নিউজরুম এডিটর সুলাইমান সাদী

সুলাইমান সাদী : আপনি লেখালেখির প্রথম প্রেরণা কোথায় পান?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এ বিষয়ে বলতে হলে আমাকে দুটি জায়গা ছুঁতে হবে। এক. আমি যখন স্কুলে পড়ি, যখন আমি নিতান্ত শিশু, তখনই সাহিত্য-লেখালেখি আমাকে নাড়া দেয়। ওই বয়সটাতে একজন শিশুকে যে বিষয়গুলো টানে ছড়া, কবিতা, গল্প, ইত্যাদি আমাকে খুব টানত। ধীরে ধীরে আমার ভেতরে ওইরকম একটা মন গড়ে ওঠে। লেখালেখি, কবিতার সান্নিধ্য, সাহিত্যের সান্নিধ্য তখন থেকেই আমার ভালো লগত। বলতে পারি, চরিত্রগতভাবেই আমার মধ্যে বিষয়গুলো ছিল।

দ্বিতীয়. আমি যখন স্কুল থেকে মাদরাসায় এলামÑ সেটা আমার ষষ্ঠ শ্রেণির বছর। এখন থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে। ১৯৮০-৮১ তখন। ওই সময়ে আমাদের বাংলাদেশে যে কওমি মাদরাসা, তার যে চরিত্র তখন বাংলা ভাষা থেকে অনেক দূরে, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলতে গেলে অনেকটা বিমুখ।

এটা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না, কোথাও কোথাও বাংলা ভাষাকে নিজেদের বিশ্বাস ও চেতনার প্রতিপক্ষ মনে করা হতো। এইরকমের একটি প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের লেখালেখির সূচনা হয়। এজন্য আমাদের জীবনে এটা অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন, এ প্রেরণাটা আমরা কীভাবে পেলাম?

এ ক্ষেত্রে খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে, খুবই গর্বের সঙ্গে যার নাম উচ্চারণ করবÑ তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রথম সারির অন্যতম চিন্তক আলেম, মুহাদ্দিস, লেখক, সাহিত্যিক, কবি হযরত মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ দা.বা.। তিনি সেই সময়, তার তত্ত্বাবধানে কিছু মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুণকে সঙ্গে করে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, লাজনাতুত তালাবা বাংলাদেশ।

এ লাজনাতুত তালাবার নেতৃত্বে প্রথম সারিতে যেমন ছিলেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী; ঠিক তাদের পর শিক্ষার্থী তরুণদের মধ্যে চারজন ছিলেন এর প্রাণপুরুষ। মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ., মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.। তাদের মধ্যে জীবত আছেন এখনো ড. মাওলানা মুশতাক আহমাদ ও মাওলানা আবু সুফিয়ান যাকী। তাদের সমন্বয়ে যে সংগঠন গড়ে ওঠে সে সংগঠনের একটা স্লোগান ছিল, ‘তোমাকেই নিতে হবে আগামী পৃথিবীর ভার।’

সেই আগামী পৃথিবীর ভার যখন আমাকে নিতে হবে তখন আগামী পৃথিবীর নেতৃত্বের জন্য আমাকে গড়ে তুলতে হবে। সেখান থেকেই মূলত আমাদের বাংলা জানতে হবে, বাংলা বুঝতে হবে, বাংলা পড়তে হবে এবং বাংলাভাষী মানুষের কাছে আমাদের দীনের ম্যাসেজটা যদি বাংলা ভাষায়ই পৌঁছাতে পারি তাহলেই এদেশে ইসলামি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলাম ধর্ম শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে একটি মর্যাদাশীল আসন তৈরি করতে সক্ষম হবে। এই প্রেরণা থেকে মূলত আমি দ্বিতীয় স্তরে এসে বাংলা ভাষার প্রতি মনোযোগী হই এবং একসময় চিন্তা করি যে, আমাকেও লিখতে হবে।

সুলাইমান সাদী : আপনি বললেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে এসে আপনি মাদরাসার এ পরিবেশে মিশেছেন এবং লেখালেখি শুরু করেছেন। স্কুল থেকে এসেই কি পরিবেশটি পেয়েছিলেন নাকি আরো পরে?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : অনেক পরে। আরও অনেক পরে। আমি যখন গ্রামে কওমি মাদরাসায় পড়তে শুরু করি, সেখানে আমাদের মাধ্যমটা ছিল উর্দু ফার্সি ও আরবি। পাঠদান করা হতো মূলত উর্দু ভাষায়। এটাই ছিল তৎকালীণ সারা বাংলাদেশের একটি সামগ্রিক অবস্থা। এরপর আমরা যখন ঢাকায় এলাম পড়তে, সেটা উনিশশ চুরাশি সাল। তার দুবছর পর, উনিশশ ছিয়াশি সালে আমি লাজনার সঙ্গে পরিচিত হই।

সুলাইমান সাদী : তখন কোন মাদরাসায় পড়তেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : সেটা ছিল ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসা।

সুলাইমান সাদী : ফরিদাবাদ মাদরাসায়ই কি লাজনার কার্যক্রম শুরু হয়?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : না, এটা একটা মজার ব্যাপার। ফরিদাবাদ মাদরাসায় যখন মাওলানা ইসহাক ফরিদী, মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া পড়তেন তখনই কাজটা শুরু হয়; কিন্তু প্রকাশ্যে না। কারণ প্রকাশ্যে বাংলাচর্চা তখন ভয়াবহ রকমের অপরাধ ছিল।

আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া তার একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন একথা, তার লেখাতেও উল্লেখ করেছেন বিষয়টি যে, বাংলা বই পড়ার অপরাধে তাকে বহিষ্কার করার পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই ফরিদাবাদ মাদরাসায়। আমরা তখন ফরিদাবাদ পড়তাম। আর তারা ততদিনে লাজনাতুত তালাবা নিয়ে ক্ষাণিকটা অগ্রসর হয়েছেন এবং তার উত্তুঙ্গ যৌবন চলছে তখন।

এই যৌবনদীপ্ত সময়টার মধ্যে মালিবাগ মাদরাসা লাজনাতুত তালাবার কেন্দ্র। সেখানে, বলা যায় লাজনা একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। বাংলা ভাষা সেখানে একটি নিষিদ্ধ ভাষা। একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের অধীনে থেকে একটি নিষিদ্ধ ভাষাচর্চ করা, এর অর্থ হলো, সর্বক্ষণ মাথায় ফাঁসির হুলিয়া নিয়ে ঘোরার মতো অবস্থা। ওই অবস্থাতেই আমাদের চর্চার সূচনা।

সুলাইমান সাদী : লাজনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে বা স্কুলে থাকতে আপনার লেখালেখি কদ্দুর কী ছিল। কী লিখেছেন সেই সময়টায়?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : না, সেটা হয়নি। এ কারণে হয়নি, মূলত কোনো একটা শাস্ত্র কিংবা কোনো একটা শিল্প, যা চর্চার জন্য প্রধান যে বিষয়টা থাকে সেটা হলো একজন শাস্ত্রজ্ঞ বা একজন শিল্পীর সান্নিধ্যে আসা। শুধু শিল্প দেখে দেখে শিল্পচর্চা করতে শুরু করে, এমনটা খুবই কম। মূলত শিল্পচর্চা করে এমন কোনো ব্যক্তির সান্নিধ্যে যখন আসে কেউ তখন তার শিল্পচর্চাটা প্রকাশ পায়।

আমাকে টানত, কিন্তু নিজে চর্চা করাটা তখনও হয়ে ওঠেনি। সেটা হয়ে উঠেছে, যখন ফরিদাবাদ মাদরাসায় এসে লাজনাতুত তালাবার সঙ্গে আমি যুক্ত হই এবং যখন আমাদের শেখানো হয়, এখন তোমাদের লিখতে হবে।

সুলাইমান সাদী : ওই সময়টাতে লাজনাতুত তালাবা ছাড়া ইসলামি অঙ্গনে লেখালেখি বা সাহিত্যচর্চার পরিবেশটা কেমন ছিল? অন্য কারা ছিল, যারা লেখালেখি করছে, পত্রিকা করছে? পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : অবস্থাটা ঠিক এইরকমের বলা যায়, লাজনাতুত তালাবা প্রতিষ্ঠারও আগে, স্বাধীনতাউত্তরকালে ফরিদাবাদ মাদরাসাকে কেন্দ্র করে এদারাতুল মাআরিফ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেটা ছিল মূলত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী। প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী। যিনি পরবর্তী সময়ে পটিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মতো মনীষী পুরুষ সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। এর সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত ছিলেন বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ.। মেধাবী তরুণদের নিয়ে বাংলা ভাষাচর্চা, পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও উদারভাবে উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা এবং সমাজের নানা প্রয়োজনকে সামনে রেখে গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ, এইসব উদ্দেশ্যে মূলত তারা প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যতটুকু অনুমান, সেটা আর খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি।

এরপর আমাদের জানা মতে সাংগঠনিক, কিংবা যদি বলেন যূথবদ্ধভাবে চর্চার একটা পরিবেশ তৈরি করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভেতরে, একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে কাজ করা; আমরা যতটুকু জানি লাজনাতুত তালাবাই একমাত্র সংগঠন ছিল। এর বাইরে হতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে, ব্যক্তিগত সাহচর্যে কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, লেখালেখি করেছেন।

যেমন শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.। তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে লেখালেখি করেছেন। তার সান্নিধ্যে থেকে শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক রহ. ব্যক্তিগতভাবে লেখালেখি করেছেন। সেটা সাংগঠনিক না, যূথবদ্ধভাবে না, একটা গোষ্ঠী নিয়ে বড় কোনো টার্গেটকে সামনে রেখে তাদের সেই চর্চাটা ছিল না।

সুলাইমান সাদী : তখন মাদরাসাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা ছাড়াও মাদরাসা অঙ্গনের বাইরেও একটা দল ছিল, যারা ইসলামি সাহিত্যের নাম দিয়ে লেখালেখি করত বা তারা নিজেদের মুসলিম লেখক বলে দাবি করত। তাদের সঙ্গে আপনাদের দূরত্ব বা ঘনিষ্ঠতা কেমন ছিল?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : দেখুন, এখনকার সময় আর তখনকার সময়ের মধ্যে একটা বড় রকমের গ্যাপ আছে। এখন যে মিডিয়া, আমাদের বাংলাদেশের মাটি ও মিডিয়া একসঙ্গে মিশে এক পাটাতন হয়ে গেছে। ফলে এখন যেকোনো মেরুর সঙ্গে আরেকটা মেরুর যোগাযোগটা যেমন সহজ হয়ে গেছে; আমাদের সময় কিন্তু ঠিক সেরকমের ছিল না বিষয়টা। সৈয়দ আলী আহসানের মতো মানুষকে আমরা জেনেছি, সেটাও বেশ পরে।

আমাদের কওমি মাদরাসায় যারা লেখাপড়া করা কেউ এর বাইরে গিয়ে কাউকে আবিষ্কার করবে এবং তার সঙ্গে লেখালেখি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবে, এই রকমের একটা চিন্তা তখনো পর্যন্ত আমাদের সমাজে জেগে ওঠেনি।

তারপরও বলব, লাজনাতুত তালাবার সংস্পর্শে আসার কারণে আমাদের ভেতরে যে একটা আবেগ তৈরি হয়েছিল, সে আবেগটা এমন ছিল, আমি মাদরাসার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারি না এবং একইভাবে এ দেশ-জাতিকে অনেককিছু দেয়ার আছে। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার আছে। এ কারণে আমরা হয়ত কিছুটা বাইরে গিয়েছি। সে কিছুটা বাইরে বলতে, আমি মাদরাসার দেয়ালের বাইরে অধ্যাপক আখতার ফারূক পর্যন্ত পৌঁছেছি। তার অধীনে সরাসরি তার কাছে আমি চর্চা করেছি।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। আমার খুব কাছের উস্তাদ, প্রিয় উস্তাদ। নানাভাবে আমাকে অনেক বেশি উপকার করেছেন লেখালেখির ক্ষেত্রে। আরেকজন হলেন মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ। যিনি তাবলিগী নেসাব অনুবাদ করেছেন এবং দারুল কিতাবের স্বত্বাধিকারী।

মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ সাহেবই প্রথম লেখালেখির প্রতি আমার আগ্রহ দেখে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কাছে নিয়ে যান। তিনিও কিন্তু আমাদের দেয়ালের বাইরের মানুষ। এ টু জেড আলিয়া মাদরাসা পড়–য়া। সারাজীবন তিনি লেখালেখি, সাংবাদিকতা করে জীবন পার করেছেন। আমি যখন শরহে বেকায়া পড়ি তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর মৃত্যু পর্যন্তই সে পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল; ধীরে ধীরে তা আরও ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। আরও কাছের হয়েছি তাঁর।

সুলাইমান সাদী : ড. কাজী দীন মুহাম্মদ স্যারের সঙ্গেও তো তখন পরিচয় হয় আপনাদের?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : হ্যাঁ, তবে সেটা একটু আলাদা বিষয় ছিল। সেটা হলো, লাজনাতুত তালাবার যে নিজস্ব কর্মসূচি ছিল, যে রুটিন ছিল, সেই রুটিনওয়ার্কের মধ্যেই বছরে একটা দীর্ঘ কর্মশালা হতো। সেই কর্মশালাতে প্রশিক্ষক হিসেবে ড. কাজী দীন মুহাম্মদ স্যার আসতেন। সেখানে তিনি ভাষাবিষয়ক ক্লাস নিতেন।

তার ক্লাসে বসতেন, ড. মুশতাক সাহেব, মাওলানা ইসহাক ফরিদী সাহেব, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব, মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন সাহেব এবং বারিধারা মাদরাসার শিক্ষক, ভালো আধুনিক গদ্যচর্চা করেন মাওলানা আবূ সালেহ সাহেব। তারা হলেন মূলত ওই ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র।

তাদের পেছনে আমরাও বসতাম। আমরাও বুঝবার চেষ্টা করতাম। কারণ দীন মুহাম্মদ সাহেব একজন ভাষাবিজ্ঞানী। তার দক্ষতা ছিল অসামান্য। তিনি খুব সহজভাবে ভাষা বোঝাতে পারতেন। এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ভাষা বিচার করা ও বিশ্লেষণ করার প্রেরণা আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

সুলাইমান সাদী : তো প্রথম কখন বুঝতে পারলেন, আপনি লিখতে পারেন বা আপনার ভেতরে লেখার ক্ষমতা আছে?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এটা একটা জটিল ব্যাপার, কোনো ব্যক্তির নিজের ভেতরকার শক্তি আবিষ্কার করা। সেটা হয়ত খুব কমই ঘটে যে, নিজেই নিজের শক্তি আবিষ্কার করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, অন্য সাথীসঙ্গী বা টিচাররা সেটা আবিষ্কার করে।

আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা হলো, পরীক্ষার খাতা... তারপরে... প্রতিদিনকার ক্লাসনোট... এগুলো তৈরি করা দেখে আমাদের যারা সামান্য সিনিয়র ছিলেন; দুইজনের নাম এক্ষেত্রে আমি বলব, আমার জীবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যাদের বড়সড় রকমের অবদান আছে; একজন হলেন আরজাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস, মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ.-এর বড় জামাতা মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব।

আরেকজন হলেন আমাদের ইক্বরা জামিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব। আবদুর রহীম সাহেব আমার এক ব্যাচ আগের। মাওলানা তয়্যিব সাহেব আমার তিন বা চার ব্যাচ আগের। তারা মূলত আমার ভেতরে এইরকম একটা শক্তি আছে, এটা অনুমানই করেছেন। তারা বলেছেন, আপনি এদিকে অগ্রসর হলে ভালো করতে পারবেন।

সুলাইমান সাদী : সেটা কীভাবে? কীভাবে তারা অনুমান করতে পারলেন যে...

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : সেটা হলো, লেখাপড়ার ভিত্তিতেই...। আমি নিয়মিত ক্লাসনোট লিখি। মাদরাসায় যারা বরাবর মেধাবী ছাত্র হয়, ক্লাসে ফার্স্ট হয় এবং সে সময় ফরিদাবাদে তুমুল পড়াশোনার একটা প্রতিযোগিতা চলত। আমি চার বছর পড়েছি, প্রথম পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছি। বাকি চার বছর বরাবর আমি ফার্স্ট হতাম। সারা মাদরাসায় যারা ভালো ছাত্র তাদের নিয়ে একটা চর্চা হতো।

সুলাইমান সাদী : তাহলে আপনি কি তখনই বাংলায় পরীক্ষা দিতেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : আমি সেখানকার রেওয়াজ অনুযায়ী প্রথমে উর্দুতে লিখেছি। তারপর সাহস করে আরবিতে লিখেছি। তখনও সেখানে আরবিতে উত্তরপত্র লেখার উল্লেখযোগ্য রেওয়াজ ছিল না। এরপর আমি যখন ক্লাসনোট বাংলায় লিখতে শুরু করলাম তখন এটাও একটা চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে যে, উস্তাদ ক্লাসে উর্দুতে আলোচনা করছেন, লেকচার দিচ্ছেন; আমি সেটাকে বাংলায় লিখছি।

মূলত এসব কারণেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, আপনি বাংলাচর্চা করলে ভালো করবেন।

সুলাইমান সাদী : আপনার লেখালেখির শুরুটা কীসের মাধ্যমে হয়? শুরুতেই আসলে কী লিখতেন?  ক্লাসনোট ছাড়া...

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এর বাইরে যেভাবে আমি লিখি, মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ সাহেব আমাদের মাকামাত পড়াতেন। আমার ভেতরে লাজনা থেকে পাওয়া যে ভাবনাটা ছিল, সে ভাবনার আলোকেই প্রথম যে কাজটা করি, নুরুল আনওয়ারের ভেতরে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের যে তুলনামূলক একটা আলোচনা রয়েছে, আমার মাথায় আসল, ওই তুলনামূলক আলোচনাটাকে আলাদা একটা আর্টিকেল হিসেবে বাংলায় আমি লিখি। লিখে মুফতি মুহাম্মদ উবাউদুল্লাহ সাহেবকে আমি দেখালাম।

তিনি এটা দেখে খুশি হলেন। বললেন, তোমার ভেতরে লেখার প্রতিভা আছে, আমার মনে হয় যারা লেখেন এবং লেখালেখির সঙ্গে যাদের সরাসরি সম্পর্ক আছে তাদের কাউকে যদি সরাসরি লেখাটা দেখাও তাহলে খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।

এই বিষয়গুলো তখনো আমি ওইভাবে বুঝি না। আমি শুধু অতটুকুনই বুঝি, বাংলাদেশের কওমি ঘরানার ভেতরে একজন মানুষই লেখক, তার নাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। এর বাইরে কোনো লেখক আছেন, তার সঙ্গে আমি দেখা করতে পারি এবং তাকে আমি লেখা দেখাতে পারিÑ এইসব বিষয় তখনও আমার জানাশোনার ভেতরে ছিল না।

দু’তিনটা পত্রিকা বের হতো তখন সারাদেশে। দাওরা মাদরাসাও তো তখন সারাদেশে হাতে গোনা কয়েকটা। এখনকার মতো পরিবেশটা এতো ছড়ানো, উদার, উন্মুক্ত ছিল না। মুফতী মুহাম্মদ উবাদুল্লাহ সাহেব আমাকে বললেন, তুমি তোমার এ লেখাটাকে একটা ফ্রেশ কপি করো। আমি লিখে আবার দেখালাম। তিনি আমাকে সরাসরি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের কাছে মাসিক মদীনা অফিসে নিয়ে গেলেন।

মুহিউদ্দীন খান সাহেব পুরো লেখাটা পড়লেন এবং পুরো লেখাটা পড়ে বললেন, তোমার লেখার মধ্যে ফরীদ উদ্দীন মাসউদ এবং আরিফ রব্বানীর গন্ধ আছে। অনেক জটিল শব্দ ব্যবহার করেছ এখানে। যদি লিখতে চাও তাহলে নূর মুহাম্মদ আজমী ও শামসুল হক ফরিদপুরী যে স্টাইলে লেখতে ওই স্টাইলে লেখো। সরল করে লেখো। আর তুমি যে বিষয়টা গ্রহণ করেছ সেটা বেশ জটিল বিষয়। এতোটা জটিল বিষয়ে তুমি এখনো লিখো না।

তুমি আগামী বছর কী পড়বে?

বললাম, আমি আগামী বছর হেদায়া পড়ব।

তাহলে হেদায়ার মুসান্নেফের জীবনী আর হেদায়া কিতাব সম্পর্কে একটা লেখা তৈরি করে নিয়ে এসো।

এরপর পনের দিন বা একমাস পরে হেদায়ার মুসান্নেফ ও হেদায়া কিতাব সম্পর্কে একটা আর্টিকেল লিখি পাঁচ-ছয় পৃষ্ঠার। লিখে প্রথমে আমি মুফতী উবাইদুল্লাহ সাহেবকে দেখাই। হুজুর বললেন, চলো আবার নিয়ে যাই তোমাকে। আবার নিয়ে গেলেন তিনি।

লেখাটা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব দেখে বললেন, সুন্দর হয়েছে। এটা আমার কাছে থাকুক। আর তুমি যদি পার তাহলে মাঝেমধ্যে বিকালে আমার অফিসে চলে এসো। এখানে যারা প্রুফ দেখে তাদের সঙ্গে যদি বসে প্রুফ দেখাটা শিখে ফেল তাহলে শব্দের বানানগুলো ঠিক হয়ে যাবে এবং শব্দের ব্যবহারগুলোও শেখা হয়ে যাবে।

সেটা তখন আর হয়ে ওঠেনি। কারণ ক্লাসের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগটা ছিল এমন, এটাই আমার সারাজীবনের টার্গেট, ধ্যান, জ্ঞান।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব দুই বা তিনমাস পর আমার এ লেখাটা মাসিক মদীনায় ছেপে দেন। লেখাটা প্রকাশিত হতে হতে আমি আবার হেদায়ায় চলে যাই। আমি বছরের শুরুতে হেদায়া ক্লাসে উঠলাম তখনই আমার লেখাটা মাসিক মদীনায় ছাপা হলো।

আমার জীবনে লেখালেখির চেষ্টার এটা দ্বিতীয় লেখা। আমার লেখালেখি প্রকাশের সূচনাটাই মাসিক মদীনা দিয়ে। কারণ ফরিদাবাদ মাদারাসায় তখন কোনো দেয়ালিকা ছিল না। এর আগে যত জায়গায় পড়েছি সেখানেও ছিল না।

অন্য কোনো জায়গাতেও আমার লেখা তখনও প্রকাশিত হয়নি। এটা আমার ক্ষেত্রে বা আমার বয়সের যারা লেখালেখি করেন তাদের মধ্যে সম্ভবত ব্যতিক্রম। আমার প্রথম লেখাটা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাসিক মদীনা শ্রেষ্ঠ নানা বিচারে। এমন একটি পত্রিকা না ইসলামি ঘরানায় হয়েছে, না সাধারণ ঘরানায় হয়েছে।

মাসিক মদীনা বাংলাদেশের একমাত্র পত্রিকা, যার সীরাত সংখ্যা এক লাখ ষাট হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। এ রেকর্ড বাংলাদেশে অন্য কোনো সাপ্তাহিক বা মাসিকের নেই।

সুলাইমান সাদী : ওই সময়টার পর আমাদের প্রচলিত মিডিয়ায় আপনি পা রাখেন কীভাবে? বা আপনার পদযাত্রার সূচনা কীভাবে হয়েছিল?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান পত্রিকাটা যখন প্রকাশ হয়, সেখানে কর্মরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের ভাগিনা, আমাদের ক্লাসমেট মাওলানা ইলিয়াস আমিনী। কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত আলেম মাওলানা আমিনুল হক মাহমুদীÑ একই সঙ্গে তিনি শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর ছাত্র ও খলিফা এবং শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ.-এরও খলিফা। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তার ছেলে মাওলানা ইলিয়াস আমিনী মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের ভাগিনা হওয়ার সুবাদে মুসলিম জাহানে তখন কাজ করতেন।

আমি তখন ময়মনসিংহে শিক্ষকতা করি। চিন্তা করলাম, ঢাকা আসব। ময়মনসিংহে শিক্ষকতা করার সময় আমার দুবছর ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা নিয়ে একটা স্মৃতিগদ্য লিখি।

শিরোনামটা এমন ছিল, ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা আমি দেখেছি। মুসলিম জাহানে লেখাটি তিন কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার পর চতুর্থ কিস্তির বিষয় ছিল লালকেল্লা। এ লেখাটি ঘটনাক্রমে হারিয়ে যায়। অফিস থেকেই কপিটি হারিয়ে যায়। এরপর ইচ্ছা ছিল বাবরি মসজিদ পর্যন্ত লিখব। আর লেখা হয়নি পরে। মুহিউদ্দীন খান আমার ওই লেখাটা পড়ে পছন্দ করেছেন।

আমি যখন ঢাকায় চলে আসার কথা ভাবছি এবং চলেও এলাম। মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আপনি তো তিন বছর শিক্ষকতা করলেন, কিছুদিন একটু শ্বাস নিয়ে একটা পত্রিকায় কাজ করেন। তারপর আবার শিক্ষকতায় ঢুকে পড়েন। আমি তখন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের কথায় মুসলিম জাহানে কাজ করতে শুরু করলাম। বছরখানেক কাজ করেছি। তারপর বারিধারা মাদরাসায় শিক্ষক হয়েছি। তখনও বিকালবেলাটায় মুসলিম জাহানে কাজ করতাম।

রাজনীতিক থেকে শুরু করে একেবারে সংবাদপত্র জগতের যারা সামান্য ইসলামি মনমানসিকতা পোষণ করেন তারা মুসলিম জাহানের অফিসে আসা-যাওয়া করতেন। পত্রিকার অফিসে থাকার কারণে পত্রপত্রিকা, লেখালেখি, সাহিত্য, সংস্কৃতি; এসব বিষয়ে তুমুল আড্ডা চলত সবসময়।

মূলত মুসলিম জাহানে কাজ করার ভেতর দিয়ে আমি আমাকে ভাঙতে পেরেছি বলে মনে করি। এর আগ পর্যন্ত আমার যে নির্মাণটা ছিল সেটা ছিল একেবারে আমার নিজস্ব, একেবারে কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক নির্মাণ। এ নির্মাণ থেকে একটু ভিন্ন জায়গায় যাওয়া, এটাকে না আমি অগ্রসরতা বলব, না অতিরিক্ত আত্মপ্রশংসা করব।

তবে এটা বলব, এর মধ্য দিয়ে আমি আমাকে ভাঙতে পেরেছি। ভেঙে নতুন আরেকটা জায়গায় এসেছি। এসে এই সময়ে কারা লেখালেখি করছে; কারা বেশি আলোচিত; কোন ঢঙটা মানুষ বেশি গ্রহণ করছে; কেন গ্রহণ করছে। এইসব বোঝার সুযোগ পেয়েছি। ভাববার সুযোগ পেয়েছি। লেখালেখিতে যে অনেকগুলো ঢঙ আছে, সেগুলো থেকে কোন ঢঙটা আমি গ্রহণ করব? এ বিষয় সেই সময়টাতে আমার সামনে আসে এবং আমি চিন্তা করার সুযোগ পাই।

সুলাইমান সাদী : সব দেশ ও জাতিগোষ্ঠীতেই শিল্প-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিল্প আন্দোলন বলে আমরা যেগুলোকে চিনি। বাংলাদেশে আপনার প্রথম কওমি ধারার ইসলামি সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন। সে ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের সাহিত্যচিন্তা হাজির করতে চেয়েছিলেন? কিংবা আদৌ কি সেটাকে একটা শিল্প আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভেবেছেন? ভেবে থাকলে সেটা কীভাবে?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এখানে দুটো বিষয়। একটা হলো মুসলিম, আরেকটা হলো ইসলামি। পাকিস্তান আন্দোলন বা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে আমাদের এ অঞ্চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আমূল বিপ্লব ঘটেছে। সেটা আপনারা পড়াশোনা করেন, ভালো করেই জানেন। বাংলা ভাষার মনীষী লেখক আহমদ ছফা।

তিনি তার গুরুকে নিয়ে লিখেছেন, যদ্যপি আমার গুরু। সেখানে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক কিন্তু এ কথাটা বলেছেন, মুসলিম জাতিসত্তা, মুসলিমি বোধ, মুসলিম জীবনবিশ্বাস, মুসলিম কালচার; এখানে বসে যেসব হিন্দু সাহিত্যিকরা সাহিত্যচর্চা করতেন তারা এগুলোকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছিলেন।

মুসলিম লেখক তো কম ছিল। কিন্তু মুসলিম তো ছিল। মুসলমানদের জীবনাচার ছিল। তাদের সংস্কৃতি ছিল। এগুলো সাহিত্যে উঠে আসেনি। শুধু এই কারণে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো মানুষেরা তখনকার পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। ভেবেছেন যদি মুসলমানদের একটি আলাদা রাষ্ট্র গড়ে না ওঠে তাহলে মুসলমানদের কালচারটাও সাহিত্যে কোনোদিন জায়গা পাবে না।

পাকিস্তান আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এখানকার রাজনীতিতে যেমন বড় রকমের একটি রঙবদল হয়েছে, এখানকার সাহিত্যেও একটা বড় রকমের রঙবদল হয়েছে। এই রঙবদলের ভেতর আমাদের বাংলাসাহিত্য যে জায়গাটায় পৌঁছেছে, সেটা হলো আমাদের দেশে হিন্দু সাহিত্য থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম সাহিত্যের একটি চেহারা দাঁড়িয়েছে।

এরপর আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, প্রত্যেক গোষ্ঠীই চায় নিজেদের মতো একটা জগত নির্মাণ করতে। এ ব্যাপারে আগে কখন আমি কী ভেবেছি এ মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে আমার এখনকার পরিমার্জিত চিন্তা হলো, আমাদের যে বিষয়টা অর্জন করা উচিত সেটা হলো, শব্দকেন্দ্রিক আমাদের স্বাতন্ত্র্য বড় নয়।

আমাদের বিশ্বাস, বোধ, চেতনাকে কেন্দ্র করে আমাদের একটি শক্তিমান স্বাতন্ত্র্য তৈরি হওয়া দরকার। আমরা যদি চিহ্নিত করি, এই এই শব্দ আমরা আমাদের লেখায় স্থান দিতে পারি না তাহলে দেখা যাবে আমাদের ভাব প্রকাশের শক্তিমত্তাটা সংকুচিত হয়ে আসছে। আমি মনে করি, আমাদের বাংলা ভাষার যে ব্যাপক শব্দাবলি, যেগুলো আমাদের তাহযিব-তামাদ্দুনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে খাটে সে শব্দগুলো আগে জারি থাকুক বা না থাকুক, আমি নেব। আরবি-ফারসি শব্দ তো ব্যাপকভাবে হুমায়ুন আহমেদরা ব্যবহার করেছেন।

অন্যা বড় বড় সব লেখকই ব্যবহার করেছেন। আমরা করতে অসুবিধা কী? তবে দুর্বোধ্য বা অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করে পাঠককে বিপাকে ফেলে দেয়ার চেয়ে আমি যে বিশ্বাসটা দিতে চাই সে বিশ্বাসের পক্ষে তথ্যাবলি, বিশ্বাসের পক্ষে আমার যুক্তিসমূহ; এগুলোকে শক্তিমত্তার সঙ্গে উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে আমাদের একটা স্বাতন্ত্র্য তৈরি করা উচিত বলে মনে করি।

সুলাইমান সাদী : বাংলা ভাষাচর্চার এ আন্দোলন শুরু করার পর আমরা দেখি এদেশের বইবাজারে ইসলামি মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে প্রচুর বই লেখা হয়েছে। এ পথে আপনারও একটা দীর্ঘ সফর আছে। আপনার বই লেখার শুরু ও শেষটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এ বিষয়গুলো আসলে এইরকমেরÑ একজন মানুষ যখন কোনো একটা পথে নামে তখন সূচনাটা হয়ত ভাবতে হয়। কিন্তু কেউ যখন কোনো কারণে কোনো একটা পথে নামে একটা সময়ে গিয়ে সে নিজে আর চলে না। পথ তাকে একটা জায়গায় নিয়ে যায়। একসময় আমরা অনেক রকমের প্রতিকূলতা উজিয়ে চলবার চেষ্টা করেছি। তার জন্য আমাদের অনেক খাটতে হয়েছে।

আমাদের আশপাশে এমন একজন লোক ছিল না, যাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, শব্দটার অর্থ কী? আমাদের অভিধানে যা পাওয়া গেল তাই পাওয়া গেল, অভিধানে যা পাওয়া গেল না তা পাওয়া গেল না। পরবর্তীতে আমরা রাস্তাটায় চলবার চেষ্টা করেছি, এখন আমাদের রাস্তাই চালাচ্ছে।

সুলাইমান সাদী : আপনার প্রথম বইটা থেকে শুরু করে শেষ বই পর্যন্ত অবশ্যই চেষ্টা করেছেন ভাষাকে প্রতিনিয়ত নবায়ণ করতে, ভাঙতে, ভাষায় নতুনত্ব আনতে। একেকটা বই যেন একেকটা বইকে উতরে যায়, সেক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনি লক্ষ রেখেছেন?

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : কঠিনভাবে তো এটা বিচার করা মুশকিল হয়। আমি যেটা চিন্তা করি, আমি আমাকে বদলাই। বদলানোটা বই, রচনা বা পত্রিকাকেন্দ্রিক নয়। আমি সেই ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত কোথাও যদি কোনো ভালো লেখা দেখি সেটা পড়ি। সেখানে যদি ভালো কোনো ঢঙ দেখি সেটা আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি, বারবার পড়ি। আমি চেষ্টা করি, গতকাল আমি যে কয় পৃষ্ঠা লিখেছি আজকের লেখাগুলো তার তুলনায় এক সুতো বরাবর হলেও যেন ভালো হয়।

সুলাইমান সাদী : লেখালেখি, সাহিত্যভাষা, গদ্যশৈলীতে আপনার পরিতৃপ্তি নিয়ে কিছু বলুন...

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, যেটা আমার অনুভূতিÑ আমাদের বাংলাদেশের প্রবাদতুল্য মনীষী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি তার এক বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, আমি বরাবর ভালোবাসি মেটে গদ্য। অথচ আমি জানি, আমি কখনো এ গদ্য লিখতে পারব না।

আমি আমার ক্ষেত্রেও চাই, খুব সরল, সহজ, তৃপ্তিদায়ক, সাহিত্যের ছোঁয়াও থাকবে, এমন গদ্য লিখতে। কিন্তু আমরা যে জায়গা থেকে উঠে এসেছি, সেখানে আমাদের হাঁটার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমি মনে করি, আজকালকার কোনো তরুণ যদি আমাদের বলে, তোমাদের গদ্য হচ্ছে না বা আধুনিক হচ্ছে না, এটা নিয়ে প্রতিবাদও করব না এবং লড়াই করতেও যাব না। কারণ সে তার জায়গা থেকে এটা বলবে। আমার যেখানে প্রায় শেষ সেখানে তার উন্মেষ।

সে আধুনিক পৃথিবীটার মধ্যেই বড় হয়েছে। আমি কিন্তু আধুনিক পৃথিবীটার মধ্যে সূচনা করিনি। তার চোখে যদি আমার লেখা না হয়, হতে পারে। কিন্তু আমি বলব, আমি পারছি না। তোমরা যেটাকে আধুনিক বল সেটাকেই আমি পছন্দ করি। সেটা আমিও লিখতে চাচ্ছি। কিন্তু আমার একটা সাধ্য আছে। আমার সাধ্যে যতটুকু ধরেছে ততটুকু করে যেতে আমি কার্পণ্য করিনি। এতটুকুই আমি বলব। এর বাইরে আমার কোনো প্রতিবাদও নেই। শক্তিশালী কোনো মাতমতও নেই আমার লেখার পক্ষে।

সুলাইমান সাদী : আপনার পাঠকদের উদ্দেশে যদি কিছু বলেন...
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : পাঠকদের উদ্দেশে বলব, পাঠক দিয়েই আসলে লেখক। পাঠকসমাজের ব্যাপারে আমরা খুবই আশাবাদী। আমি মনে করি, পাঠকসমাজ যদি সমাজের জন্য যেটা কল্যাণকর সেটাকে গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হন এবং একই সঙ্গে সমাজকে, দেশকে, আমার পরিবারকে, আমার জাতিসত্তাকে এবং রাষ্ট্রের বোধশক্তিকে আক্রান্ত করে, আহত করে, ক্ষতবিক্ষত করে; এ জাতীয় কাজ যারা করেন, সে লেখক হোক বা অন্য যেকোনো অঙ্গনের লোক হোক, আমাদের পাঠকরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করার একটা দৃঢ় সংকল্প করতে পারেন তাহলে এদেশ সুন্দর খুব ও শক্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াবে। সেই প্রত্যাশা করি।

সুলাইমান সাদী : আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সময় দেয়ায় আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন : ধন্যবাদ আপনাকেও, শুভকামনা আওয়ার ইসলাম পরিবারের প্রতি।

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ