শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সবুজ গম্বুজের ছায়ায় স্মৃতিময় ইফতার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সুফিয়ান ফারাবী: বাইতুল্লাহ থেকে যিযারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় আসি। মক্কা থেকে সকাল ছ‘টায় গাড়ীতে চড়ি। আসতে সময় লাগে প্রায় দশঘন্টা।

রাস্তায় একটি উট গাড়ী চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। একারণে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। আসতে দু‘ঘন্টা বেশি লেগেছে। সাধারণত মক্কা থেকে মদীনায় আসতে সাত থেকে আটঘন্টা সময় লাগে।দীর্ঘ জার্নির কারণে শরীর খুব ক্লান্ত । গায়ে প্রচুর ধুলো।

গোসল করা ছাড়া উপায় নেই। আমি মুয়ল্লিম সাহেবের কাছে গিয়ে বলি, মুফতি সাহেব! আমার গোসল করা প্রয়োজন। শরীওে প্রচন্ড ময়লা।

মুফতি সাহেব বললেন, দাঁড়ান! এখনি মাশওয়ারা হবে।মুফতি সাহেব আমাদেও কাফেলার সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হলেন। সম্ভবত তারা মাশওয়ারার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

মুফতি সাহেব সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখণ বাজে বিকেল চারটা। আসরের নামাজের বাকি মাত্র ত্রিশ মিনিট। আর ইফতারির বাকি এখনো আড়াই ঘন্টা। এখন কী আপনারা গোসল করে বেলাল মসজিদে নামাজ আদায় করে মসজিদে নববিতে যাবেন নাকি এখনি মসজিদে নববিতে যাবেন?

আমাদের কাফেলায় আমি ছাড়া সবাই এর আগে হজ্ব বা উমরায় এসেছেন। আমাদেও সফরসঙ্গী মাওলানা আহসান মাহবুব এ নিয়ে চারবার উমরা করছেন।

তিনি বললেন, মুফতি সাহেব! আমার মনে হয় গোসল নামাজ সেরে একসাথে মসজিদে নববিতে যাওয়াই উত্তম হবে। কারণ তখন আমরা ইফতারি, তারাবি ও কিয়ামুল লাইল শেষ করে হোটেলে ফিরবো। আর তা না হলে ইফতারি করে আমাদের আবারো হোটেলে আসতে হবে গোসলের জন্য।

সবাই তার কথার সাথে একমত পোষণ করলেন। তাই ফয়সালা হলো আমরা বেলাল মসজিদে নামাজ পড়ে তারপর মসজিদে নববিতে যাবো।

আমরা সবাই গোসল করে নামাজ আদায় করি। বেলাল মসজিদে নামাজ আদায় করে ছুটলাম মসজিদে নববির দিকে। এখান থেকে রাসুল সা. এর রওজা প্রায় এক কিলো।

রমজান মাসে মসজিদের আশেপাশের হোটেলগুলো খালি পাওয়া যায় না। কিছু খালি থাকলেও সেগুলোর প্রতিরাতের ভাড়া পাঁচ হাজার রিয়াল। বাংলাদেশী টাকায় একলক্ষ টাকা।

উচ্চবিলাসি ধনীব্যক্তিরা এসব হোটেলে থাকেন। মানে একদম ফাইভস্টার। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মসজিদে নববির একদম নিকটে চলে আসি। ঐ তো! মসজিদে নববির উঁচু উঁচু মিনারগুলো দেখা যাচ্ছে।আমার মনে সঙ্গে সঙ্গেই উদয় হলো এক অন্যরকম ভাবনা, ভালো লাগা।

মনের অজান্তেই কখন যে বলে ফেল্লাম, আস সালাতু ওয়াস সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্ আস সালাতু ওয়াস সালামু

আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। কিন্তু আমি জানতাম না যে আমি কাঁদছি। চোখের অশ্রু যখন গাল গড়িয়ে ঠোটের কাছে এসে জমলো তখন ভঙলো আমার ঘোর।

কিছুক্ষণ কান্না করার পর চোখ মুছলাম্ মনে মনে ভাবছি, জীবনের এই দু‘ফোটা অশ্রু বৃথা যায় নি। এদু‘ ফোটা অশ্রু বির্সজন দিয়েছি রাসূলের প্রেমে। এদু‘ফোটা অশ্রু র্স্বাথক।

এই কথাগুলো ভেবে ভেবে চোখ মুছতে মুছতে একদগম রওজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আবারো সালাম দিয়ে যিয়ারতের কিছু দোয়া দরুদ পাঠ করলাম। সে যে কী অনুভূতি। কী আত্মতৃপ্তি। বলে বুঝানো যাবে না।

ভাষায় প্রকাশ করলে যথাযত হবে না। লিখনির মাধ্যমে কাগজে স্থান দিলে ফুটে উঠবে না। এটা মনের আবেগ, মনের ভালোবাসা। তাই মনেই থাকুক।

যিয়ারত শেষে আমরা ইফতারিতে বসলাম্ প্রতিদিন প্রায় দশহাজার রোজাদার এখানে একসাতে ইফতারি করে আরবের শেখ,কোটিপতি ও দরীদ্র অসহায় মানুষ এক দস্তরখানায় বসে ইফতারি করে।  বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে ধনী গরীবের মধ্যে কোন র্পাথক্য নেই। এমনকি র্পাথক্য হয় না জাতীয়তা ভেদেও। এখানে বাঙালি, সৈাদিয়ান, তুর্কিশ রোহিঙ্গাদের মাঝেও সবাই সমান।

ইফতারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি রোজাদারদের দিকে তাকিয়ে আছি নিবিড় চোখে। তারা নিবিষ্ট চিত্তে দোয়া করছে। সবার চেহারা মলিন। অসহায় অসহায় ভাব। সবাই নিজ নিজ পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। যেন তারা সর্বহারা। বস্তুত তাঁর নিতান্তপক্ষে দামী মানুষ।

আমার পাশে বসেছেন এক সৌদি ধনকুবের। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হবে হয়ত। সাধারণত একবয়সী টগবগেযুবকদের কাঁদতে দেখা যায় না। কিন্তু তিনি কাঁদছেন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। অঝরে অশ্রু ঝরছে তার চোখ দিয়ে। আহ, কী দামী তার রোদন! কী দামী তার চোখের অশ্রু! কী দামী এই মানুষটি।

মুয়াজ্জিন আজান দিয়েছেন। আমরা জান্নাতি পরিবেশে ইফতারি শুরু করলাম আজওয়া খেজুর দিয়ে।

আরো পড়ুন- রোজা পালনে বয়স্কদের জন্য ৬ টিপস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ