ইসমাইল বিন কাসেম
রসুলপুর। গ্রামের মাঝ দিয়ে আসা পথটি এখানে এসে একটু বাঁক নিয়েছে। কাঁচা মাটির রাস্তা । দুপাশে সারি সারি গাছ ।
বাঁকের মাথায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল দেহে পত্র-পল্লব নিয়ে একটি বট গাছ । ডাল পালাগুলো ছড়িয়ে আছে বহুদূর পর্যন্ত। ঘন ডালপালায় আবৃত থাকায় ঠিক মতো সূর্যের আলো এখানে আসে না । কেমন যেন এক ভুতুড়ে গলি । গাছের শিকড় ঘেঁষে একটি দোকান। রোদ বৃষ্টির মিলন মেলায় নিজেকে মেলে ধরে লালবর্ণ ধারণ করেছে, দোকানের টিনগুলো ।
কোথাও কোথাও চালের পেরেকগুলো খুলে গেছে। ওলো মাটিতে ভরে আছে অর্ধ দোকান। সন্ধ্যায় জ্বালানো চেরাগের আবছা আলোয় যা বুঝায়, কেমন যেন একটি ছায়া মুর্তি বসে আছে । তার পাশে খালি তাকের কয়েকটি কাঠের আদল । তেল চিকচিক; লিকলিকে শরীর মাঝ বয়সি এক ব্যক্তি।
গ্রামের লোক তাকে গণি মিয়া বলে চিনে। কিন্তু অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই শরীর দেখে কেউ অনায়েসে বলবে-নব্বই বসন্ত পাড় করেছেন তিনি।
সামনে বিস্তৃত মাঠ। সবুজ ধানক্ষেত । বিস্তৃত সবুজের গা ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাসে একের পর এক বিড়ি টেনে যাচ্ছে। আর আকাশ পাতাল কী যেন ভাবছে । তীব্র বাতাসে ধপধপ করে জ্বলছে চেরাগ। আবার কখনো নিভে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে । পাশের শুকনো খালের তলায় পায়ের নিচে শামুকের পিষ্ঠ হওয়ার শব্দ তাকে আসান্বিত করছে।
গ্রামে রাত ৯টা ১০টা মানে অনেক রাত। ঘুম তখন গ্রামের মেঠোপথ ধরে বহু দূর এগিয়ে। চারদিকে ছেয়ে আছে পিনপতন নিরাবতা। মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ ডাকে কেমন যেন পুরো গ্রাম কেঁপে উঠছে।
রাস্তা-ঘাটে দুএকজন লোক পাওয়া দুষ্কর । বৃদ্ধ লোকটি চেরাগ জ্বালিয়ে একের পর এক বিড়ি টেনে যাচ্ছে খদ্দেরের অপেক্ষায়। এবার বৃদ্ধ চেরাগে আরেকটু তেল ঢালে । দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে প্রদীপ শিখা।
ক্ষণিক বাদে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এভাবে কেটে যায় তার দিনরাত । এক সময় চলে আসে তার পরপারের ডাক। জানিনা সে ওই জগতের জন্য কতটুকু সম্বল যুগিয়েছে। দুনিয়ার জীবনে যিনি নিজের পরিবারের সুখের জন্য নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করতে করতে নুয়ে পড়েছিলেন।
আজ তার এই বিদায় মুহূর্তে কী বা করার আছে তার পরিবারের । খোদার কাছে তার পরপারের সুখময় জীবনের মিনতি ছাড়া। হয়তো বা মুছে যাবে এই ক্ষতের দাগ পরিবারের সকলের মন থেকে । কিন্তু সারা দিন খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে বাতের ব্যথায় যিনি কুঁকিয়ে উঠতেন বারবার।
এটা কী কারো অন্তরে স্পর্শ করতে পেরেছে? আজ যিনি রিক্ত হস্তে বিদায় নিলেন। তার পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী কি তার এই বিদায় থেকে শিক্ষা নেবে না ? হয়তো বা এক দুদিন মসজিদের কাতার ভরে মানুষের উপচে পড়া ভীড় পরিলক্ষিত হবে।
তারপর ইমাম আর মুআযিযন ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আজ যিনি চলে গেলেন তার বিদায় থেকে। রাসুল সা. বলেন করেন, “সকল স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ কর”।
কত মানুষ আজ গণি মিয়ার মত পরিবারের সুখের জন্য চেরাগ জ্বেলে রাত পাড় করে। না দুনিয়ার কোনো সুখ তাকে ধরা দেয় না সে আখেরাতের জন্য কিছু কামায়।
এভাবেই খালি হতে প্রতিনিয়ত দুনিয়া ছাড়া হচ্ছে কত মানুষ। আমি আমরাও কী শূণ্য হাতে যেতে হবে? গণি মিয়া আজ শুধু চোখের কোণে ভেসে ওঠে।
জীবনের কথা ভাবলে। মৃত্যুর চোখে তাকালে আজ ভয় ভয় লাগে। গণি মিয়া কী কোনো দিনও সেই অন্ধকার কবরের দিকে তাকায়নি ? ভাবেনি? আমরা কী ভাবি?
না ভাবি না। না ভাবতে ভাবতেই গণিমিয়ার চেরাগের মত আমাদের জীবন চেরাগ দপ করে নিভে যাবে একদিন। আমাদের থাকতে হবে চেরাগহীন মাটির ঠাণ্ডা হিমেল কোলে। যেখানে আমলের চেরাগ ছাড়া আর কোনো চেরাগ জ্বলবে না। যেখানে নামাজের চেরাগ ছাড়া জ্বলবে না আমলবিহিন জীবনের চেরাগ।
লেখক : শিক্ষক: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বাইতুল আরকাম মাদরাসা ছাটগাও, জিনজিরা , কেরাণীগঞ্জ , ঢাকা
আরো পড়ুন- শ্রমজীবি সাহাবিদের গল্প