শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


থাইল্যান্ডে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. মোহম্মদ ওবায়দুল্লাহ
শিক্ষাবিদ ও গবেষক

পিএইচডি করার সময় বেশ কয়েক বছর মালয়েশিয়া থাকাকালীন সময়ে এদেশের বর্ডার দেশ থাইল্যান্ডে ভ্রমন কিংবা কোন প্রোগ্রামে যাবার তীব্র আকাংখা থাকা সত্ত্বেও যেমন যাওয়া হয়নি তেমনি প্রফেশনাল জীবনে বিভিন্ন দেশের কনফারেন্সে গেলেও সেখানে যাওয়া হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সেই সুযোগটা চলে এলো। সেদেশের ইয়ালা প্রোভিন্সে (জেলা) অবস্থিত ইয়ালা রাজাবাহাত বিশ্ববিদ্যালয় একটা আন্তর্জাতিক সন্মেলনের আয়োজন করে।

সেখানে আমার একটা গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য প্রেরণ করলেও আমার সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) দেখে কর্তৃপক্ষ আমাকে কিনোট স্পীকার এবং আন্তর্জাতিক প্যানেল ডিসকাসেন্ট হিসেবে আমন্ত্রণ করে।

ফলে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য যাতায়াত, খাবারসহ যেসব খরচ লাগত তা আর তো লাগলই না বরং এমনসব ব্যবস্থা তারা আমার জন্যে করল যে, প্রত্যেক পদে পদে অবাক হলাম। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে তা হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সামাজিক জীবনে ইসলাম এবং তার অনুশীলন দেখে।

মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ মুসলিম অধ্যুশিত এই দেশটির তিনটি প্রভিন্স মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে বিবেচিত। তার মধ্যে অন্যতম হলো ইয়ালা প্রভিন্স। সেখানকার মোট জনগোষ্ঠির ৭৫ শতাংশ মুসলিম। এখানকারই একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইয়ালা রাজাবাহাত বিশ্ববিদ্যালয়।

সেখানকার কনফারেন্সে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন আমি ব্যাংকক থেকে ডমেস্টিক ফ্লাইটে হাটইয়াই বিমানবন্দরে পৌছাই তখন আমাকে নেয়ার জন্য সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্র সেখানে অপেক্ষারত দেখি। তাদের সাথে পরিচয়ের পর্বে দেখি শিক্ষকজন আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বললেও ছাত্রটি আরবিতে কথা বলছে। আমি মনে করলাম হয়ত সে ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা আরবি বিভাগে পড়ে।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কোন প্রগ্রামে এবং কোন বিভাগে অধ্যায়ন করছে? সে জানালো যে, এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত। আমি অবাক হয়ে সে কিভাবে আরবি শিখেছে তা জানতে চাইলাম। আমি যেমন অবাক হয়েছিলাম তারচেয়ে বোধহয় তারা দুইজনই বেশি অবাক হলো আমার প্রশ্ন শুনে।

এরপর সেই শিক্ষক আমাকে যা জানালো তা হলো থাইল্যান্ডের এ অঞ্চলের সব মুসলিম ছাত্ররাই ইংরেজিতে ভাল কথা বলতে পারবে না এটা ঠিক কিন্তু আরবিতে মোটামুটি কমিউনিকেট করতে পারবে।

কারণ, হলো তাদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই আরবিটাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়ে শেখে যে শুধু কুরআন তেলওয়াত বা হাদিস পড়তে পারাটাই তাদেরকে সন্তুষ্টি করতে পারে না বরং এটি তাদের জন্য সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় প্রত্যেক মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীই আরবিতে কথোপকথন করতে পারে।

বিষয়টা জানার পরথেকেই মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করতে লাগল। আমাদের বহনকারী প্রাইভেটটি তখন নীল সমুদ্রের তীর ঘেষে ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে চললেও ক্ষনিকের জন্য লাল-সবুজে মোড়ানো ১৫৫০০০ বর্গমাইলের ৯২ শতাংশ মুসলিমের কথা মনে পড়ে আমার পৃথিবীটা যেন স্থীর হয়ে গেল। আমাদের মাদ্রাসায় পড়–য়ারাও যেখানে কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে পারে না সেখানে অন্যদের কথা কিই বা বলব!

আমার জন্যে যে আরো চমক অপেক্ষা করছিল তা কে জানে। থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়াটা সামাজিকভাবে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত্ব সচেতনদের মাঝে খুব বেশি গর্বের না। কারণ হলো সেদেশের বিশেষ কিছু খারাপ সংস্কৃতি ও তার ব্যবসা। প্রাশ্চত্যের মানুষ বিনোদন, সময়কাটানো এবং জীবনকে উপভোগ করতে এখানে বিশেষ সময় যাপন করে।

তাই, অনেকেই থাইল্যান্ড যাচ্ছি শুনে যেমন নাক শিটকায় তেমনি বিশেষ কিছু পরামর্শও দেয়। এমন একটা দেশে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষাকে দেখে আমাকে এতটা অবাক করবে ভাবিনি কখনও।

যাই হোক, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রোগ্রাম সেখানে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা শতকরা ৭৫ ভাগ হলেও শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারির অনুপাত ৫০:৫০। তবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে উচ্চপদস্থ প্রায় সকলেই অমুসলিম। তবুও তাদের কনফারেন্স হলে যখন প্রবেশ করি তখন থেকেই অবাক হতে থাকি।

আমাকে অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে, রেজিষ্ট্রেশন বুথসহ হলের মধ্যে যারা বসে আছে তাদের পোশাক বিশেষ করে এমন একজন মুসলিম ছাত্রী কিংবা শিক্ষককে দেখলামনা যে বা যারা হিজাব পরেনি। এমন পরিস্থিতি দেখব তা চিন্তাও করিনি। প্রোভাইচ চ্যান্সেলরকে তারা ভাইচ প্রেসিডেন্ট বলে। তিনি ছিলেন এ প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি। সাথে আরো কতিপয় অমুসলিম কর্মকতাও ছিলেন। তাদের অপুস্থিতিতে প্রোগ্রাশ শুরু হলো হামদ্ ও নাতে রাসূল (সা.) এর সাথে।

প্রায় ৩০ মিনিট যারা এই অনুষ্ঠানে পারফরমেন্স করলেন তাদের সবারই ইসলামি পোশাক পরিহিত ছিল। বাজনা ব্যবহার করলেও হাদিসে বর্ণিত ‘দফ’ই দেখলাম এখানে। এটাকেই তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত করে।

পরবর্তী দিন ছিল শুক্রবার। এটি রমজানের পূর্বে শাবানের শেষ জুমু’আ বার। কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুরোধ করলেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মসজিদে খুতবা ও জুমু’আর সালাত আদায় করার জন্যে। একটু শংকাবোধ থাকলেও তাদের বিশেষ অনুরোধকে উপেক্ষা করতে পারিনি।

মসজিদটি অতবড় নয়। দুইতলা মসজিদে সবমিলিয়ে ৫-৬ শত মুসুল্লি সালাত আদায় করতে পারে। আমাকে যখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো আমি মসজিদে প্রবেশ করেই চারপাশে তাকিয়ে দেখি তিনপাশে পুরোটাই বিভিন্ন বইয়ের শেলফে ঘেরা। একটু কাছে যেয়ে দেখলাম, কুরআন ও হাদিসের গ্রন্থের পাশাপাশি রাসূল (সা.) এর সিরাত, ফিকহ্ মাসলা-মাসায়েলের বইসহ ইসলামের উপর বিভিন্ন বই। ছোটখাট একটা লাইব্রেরিই মনে হলো।

একবার আমার চাকুরিরত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে হলো সেখানে একখানা কুরআনই থাকে শেলফে। আরো কিছু বই থাকলেই কিছুদিন আগে বিশেষ মুহুর্তে হাদিসসহ অন্যন্য কয়েকটা মাত্র যে বই তাও সরিয়ে রাখা হয়েছে। যাই হোক, একটু আগেভাগেই যাওয়ার কারণে দেখতে থাকলাম যারাই মসজিদে প্রবেশ করছে দুই রাকাত সালাত আদায় করেই কেউ কুরআন, কেউ হাদিস নিয়ে অধ্যয়ন করছে। এইতো সেই মসজিদ যা রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরবর্তীতে একটা সময়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম ইসলামী শিক্ষা নামে কোন বিভাগ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা? আমাকে আবারও অবাক করে দিয়ে যা জানালো তা সত্যিই বিষ্মিত হবার মত। এই ইয়ালাতেই নাকি একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার নাম পাটানি বিশ্ববিদ্যালয়।

সেই রাতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে। গেইট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা স্থাপত্যে ইসলামের একটা প্রভাব সুস্পষ্ট। এখানে শুধু কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি পড়ানো হয় না বরং অন্যান্য প্রত্যেকটা বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পড়ানো হয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি তাদের আরো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রিন্স সংখলা ইউনিভার্সিটি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ক্যাম্পাস আছে পাত্তানি প্রোভিন্সে। সেখানে আরবি, ইসলামি স্টাডিজসহ, ইসলামি ল’, ইসলামি এডুকেশন নামে বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তারা বলল যেখানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ শুধু নয়, ইসলামি আইন, ইসলামি এডুকেশনের পাশাপাশি বিশ্বধর্ম বিভাগে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ইসলামি শিক্ষা পড়ানো হয়।

কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলিম ছাত্ররার আরবি শিখে। তাছাড়া মুসলিম অধ্যুসিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি মাদ্রাসার পাশাপাশি স্কুল কলেজেও ইসলামি শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে পাঠদান করা হয়। এসব এলাকার অনেকেই আল-আজহার, উম্মুল কুরা, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মদিনা, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ফিরে এসে নিজ এলাকায় ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ইসলামি অনুশাসন ও তা চর্চার জন্য মানুষের মাঝে কাজ করে যাচ্ছে।

এরকম শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য মানুষগুলোকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে তাই ছিল ইসলামের কাম্য। সুতরাং এ পরিবেশ, শিক্ষাব্যবস্থা, বাস্তব জীবনে ইসলামি অনুশাসন সত্যিই অদুর ভবিষ্যতে অন্যান্যদের জন্য শুধু অমুসলিম দেশে মসুলিমদের জন্য নয় বরং মুসলিম দেশসমূহের জন্য অনুকরণীয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।

দূতাবাস স্থানান্তরকারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে: ওআইসি

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ