বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


ইন্টারনেটব্যাধিতে হেফজখানা; পরিত্রাণের উপায় কী?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এ এস এম মাহমুদ হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক

স্বল্প মূল্যে সহজলভ্য ইন্টারনেট সুবিধা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকাংশ হিফজুল কুরআন মাদরাসায়। পরিচালকদের অভিযোগ, হিফজুল কুরআন বিভাগে রুটিন মাফিক কার্যক্রমে যারপরনাই ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে ইন্টারনেট সেবা।

সারা বিশ্বের ডিজিটালাইজ্ড শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাক্ষেত্রে যতটা নতুনত্ব ও অগ্রগতি সৃষ্টি করছে। ঠিক ততটাই পিছিয়ে দিচ্ছে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ মুখস্থ করার একমাত্র শিক্ষাব্যস্থাকে।

অভিযোগ উঠেছে, হিফজ বিভাগের শিক্ষকগণ ক্লাসের ছাত্রদের সবক শোনানোর সময়ও মোবাইল হাতে ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকেন। ফলে ছাত্রদের লাহান, তাজবিদ ও ইয়াদ এবং হিফজ সংক্রান্ত জরুরি বিষয়ে অসংখ্য ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। নির্ভুল সবক ও আমুখতা গ্রহণে শিক্ষকদের অলসতায় শিক্ষার্থীদের কাঙ্খিত উন্নতি হচ্ছে না।

এছাড়া হিফজ বিভাগের শিক্ষক কর্তৃক নিরবিচ্ছন্ন তদারকিতেও ঘাটতি হচ্ছে । দিনে ও রাতে বিশ্রামের নির্ধারিত সময়ের একটি বড় অংশ জুড়ে মোবাইলে ফেসবুক ও ইউটিউব ঘাঁটাঘাটিতে ব্যস্ত সময় পার করেন অনেক শিক্ষক। ফলে ঘুমের ঘাটতি থাকায় ক্লাসে মেজাজ খিটখিটে ভাব দেখান তারা। চুন থেকে পান খসলেই সর্বনাশ বেঁধে যায়।

এ সংক্রান্ত অভিযোগ ও তথ্য যাচাই করে জানা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে হিফজের শিক্ষক নিয়োগের সময় মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ও শর্ত উল্লেখ করে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া হিফজ বিভাগে পূর্ণ আন্তরিকতা ও রুটিন মাফিক ক্লাস করানোর মানসিকতা থাকা সাপেক্ষে শিক্ষক ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে বেতন নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু খ্যাতি পাওয়া হিফজুল কুরআন মাদরাসা ছাড়া অধিকাংশ মাদরাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষকরা মানেন না তাদের নিয়োগের সময়ের শর্তগুলো।

এ ব্যপারে একাধিক শিক্ষক ও পরিচালকদের কাছে পাওয়া গেল দুই মেরুর অভিযোগ। শিক্ষকদের অভিযোগ, পরিচালক কর্তৃক হিফজ বিভাগে এত বেশি কড়াকড়ি আরোপে আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না।

ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফুজাতের অনন্য অ্যাপ ইসলামী যিন্দেগী ইনস্টল করুন

পরিচালকগণ ২৪ ঘন্টাই শিক্ষকদের খাটাতে চান। শিক্ষকদের রুচি, স্বাদ- আহ্লাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হলেই পরিচালকরা অভিযোগ করেন।

পক্ষান্তরে পরিচালকদের অভিযোগ, শত বছরে ধরে চলে আসা হিফজের নির্ধারিত রুটিন ও স্বাভাবিক ক্লাস পদ্ধতির তোয়াক্কা না করে, নিয়োগের সময়ে মোবাইল ব্যবহার সংক্রান্ত শর্ত ভঙ্গ করে শিক্ষার্থীদের হক নষ্ট করেন।

নির্ভুল ইয়াদ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্বার বিষয়ে তারা অমনোযোগী থাকেন। অথচ হিফজের শিক্ষক যাবতীয় শর্ত মেনে তার জন্য নির্ধারিত বেতনে চাকরি করতে রাজি হয়েই শিক্ষকতা করছেন। তাহলে তিনি কেন নিয়ম ভেঙ্গে নিজস্ব আঙ্গিকে হিফজ বিভাগে শিক্ষকতা করবেন?

হিফজের আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী তেলাওয়াত করার যোগ্যতা তৈরিতে এখন ১৫ জন ছাত্রকে এক শিক্ষকের তত্বাবধানে দেওয়া হয়। তারপরও কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে কয়েক বছর পূর্বেও একজন শিক্ষকের তত্বাবধানে থাকত অসংখ্য শিক্ষার্থী।

শিক্ষকদের ক্লাসে ও বিশ্রামের সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে মারকাজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদরাসার পরিচালক ও আন্তর্জাতিক মানের কারি হাফেজ নাজমুল হাসান আওয়ার ইসলামকে বলেন, মোবাইল সংক্রান্ত এসব সমস্যার কারণে আমি আমার মাদরাসায় নেটওয়ার্ক জ্যামারের ব্যবস্থা নিয়েছি। ক্লাসের সময়ে জ্যামার ব্যবহার করে শিক্ষকদের অযাচিত মোবাইল ব্যবহার ঠেকানো যেতে পারে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহার সংক্রান্ত এত সমস্যা হওয়ার পরও জাতীয় পর্যায় থেকে ক্লাসে মোবাইল ব্যবহারের বিধি নিষেধ সম্পর্কে সজাগ করা হচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এসব সমস্যায় চরমভাবে ভোগান্তির শিকার হওয়ার পরও কেউ উদ্যোগ নিচ্ছি না। এটার জন্য আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের অলস মানসিকতা দায়ী।

আপনি বা কোনো আত্মীয় কি ইন্টারনেট ও মাদকাসক্তিতে ভুগছে?

পুরো বাংলাদেশে সকল হিফজুল কুরআন মাদরাসাতেই একই ধরনের যাচ্ছেতাই অবস্থা।

শিক্ষকদের রুটিন না মানা, যখন তখন মোবাইল ব্যবহার করা বিষয়ে সব মাদরাসা থেকে একই অভিযোগ শোনা যায়। হিফজ মাদরাসা পরিচালকদের উদ্দেশে কারি নাজমুল হাসান বলেন, শিক্ষকদের বোঝাতে হবে। বুযুর্গদের সহচর্যে নিতে হবে। নিয়োগের সময় কড়া হুশিয়ারী দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কাজ না হলে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নেটওয়ার্কিং জ্যামার লাগিয়ে শিক্ষকদের শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করাতে হবে।

হিফজ শিক্ষকদের অযাচিত কর্মকাণ্ড, পরিচালকদের বিভিন্নভাবে পেরেশানিতে ফেলা, ক্লাসে মোবাইল ও নেট ব্যবহার বন্ধ করতে জাতীয় পর্যায় থেকে প্রচার ও করণীয় নির্ধারণ করতে খুব শিগগির উদ্যোগ নিবেন বলে তিনি আওয়ার ইসলামকে জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি পাওয়া মারকাজুত তাহফিজ মাদরাসার পরিচালক ও খ্যাতি সম্পন্ন হফেজ কারি নেছার আহমাদ আন নাছিরী বলেন, আমার পরিচালনাধীন মাদরাসায় শিক্ষকদের এন্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ। যে কারণে কোনো শিক্ষক এন্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করে না।

তিনি বলেন, নেট ব্যবহারে শিক্ষকদের মানসিক প্রশান্তি হ্রাস পায় ও স্থিরতা হারিয়ে যায়। তিনি হিফজ মাদরাসা পরিচালকদের শিক্ষক নিয়োগের সময়ই শর্ত দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও ক্লাসের সময় শিক্ষকদের প্রতি নজর রাখার পরামর্শ দেন।

ইসলামি স্কলার ও শিক্ষাবিদ, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট মাদরাসার পরিচালক মুফতি মামুনুর রশীদ বলেন, সাধারণত হুফফাজুল কুরআন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাফেজগণ হিফজ বিভাগে শিক্ষকতা করেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিফজ মাদরাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে কড়াকড়ি করলে না বলেই হুট করে চলে যাওয়ার মানসিকতা অনেক হাফেজ শিক্ষকের রয়েছে। আবার মোবাইল বা নেট ব্যবহারে শর্ত জুড়ে দিলে তারা থাকতে চান না। বিশেষ করে এখনো প্রতিষ্ঠিত নয় বা খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি এমন মাদরাসাগুলোতে হিফজ শিক্ষকদের রুটিনওয়ার্কের মধ্যে অনেক কাজই প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য।

সুতরাং নূরানী ট্রেনিং সেন্টারগুলোর মডেলে আদর্শ হিফজ শিক্ষক তৈরিতে হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশন, বেফাক ও সংশ্লিষ্টদের আরো ভাবতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় হিফজুল কুরআন শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকির মধ্যে পড়বে।

হিফজখানার পাঠদান ব্যবস্থা ও মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতি নিয়ে আওয়ার ইসলামের নেয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারটি দেখুন। 

-আরআর

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ