বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


খতিবুল ইসলাম মাওলানা সালেম কাসেমি; বর্ণিল পুরো জীবন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তাওহীদ আদনান
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ

উপমহাদেশের অন্যতম আলেমে দ্বীন মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম কাসেমি রহ. দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর ১৪ এপ্রিল স্থানীয় সময় বিকেল ৩ টায় ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলেন।

তার মৃত্যুতে পুরো উপমহাদেশে ছেয়ে গেছে শোকের ছায়া। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে ইলমি জগত। ভেঙ্গে পড়েছেন হাজারো আলেমে দ্বীন। ইলমি জগতে তার ছিলো সরব পদচারণা। রেখেছিলেন ইলমের অঙ্গনে বিরাট অবদান।

দ্বীন ও ইসলামের খেদমতে তিনি লিখে গেছেন অসংখ্যা কিতাব। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চালিয়েছেন তিনি তার ক্ষুরধার লেখনি। তিনি জীবন যাপন করতেন অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। ছিলেন খুবই বিনয়ী এবং কোমল হৃদয়ের অধিকারী।

জন্ম: মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম কাসেমি রহ. ৮ জানুয়ারি ১৯২৬ ঈসায়ি মোতাবেক ২২ জুমাদাস সানি ১৩৪৪ হিজরি সনে ভারতের উত্তরপ্রদেশস্থ সাহরানপুর জেলার দেওবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

মাওলানা সালেম কাসেমি রহ. ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ.-এর পর নাতি এবং দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারি মুহাম্মাদ তৈয়ব সাহেব রহ.-এর ছেলে।

তার পূর্ব পুরুষগণ নানুতা নামক গ্রামের অধিবাসী হলেও তার পিতার পর থেকে তাদের সবই ছিলেন দেওবন্দের বাসিন্দা৷ বংশীয় দিক থেকে তারা ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর বংশধর।

শিক্ষা জীবন: পড়া-লেখার হাতে খড়ি তার বাবার কাছেই। বাবার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। প্রথমেই তিনি দেওবন্দে হেফজ বিভাগে ভর্তি হন।

হেফজ সম্পন্ন করেন পারজি শায়েখ শরিফ গাঙ্গুহি রহ.-এর কাছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাকি পড়ালেখাও তিনি দারুল উলুম দেওবন্দেই শেষ করেন। শিক্ষা জীবনে তিনি ছিলেন মেধাবী ও কর্মঠ।

ছাত্র জীবনের শুরু লগ্নেই ১৯৪৩ ঈসায়ি মোতাবেক ১৩৬২ হিজরিতে তিনি একটা লম্বা সময় হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ-একান্ত সান্নিধ্যও গ্রহণ করেন। তখন তিনি তার কাছে মিজান ও মুনশাইব পড়েন। সে হিসেবে তিনি তার একান্ত সান্নিধ্য প্রাপ্ত একজন ছাত্রও বটে।

ছাত্র জমানায় তার সহপাঠীদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা রাবে হাসানি নদভি, যিনি তার হেদায়ার সাথী ছিলেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে আরো রয়েছেন মাওলানা সালিমুল্লাহ খান রহ., শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.-এর ছেলে মাওলানা আসআদ মাদানি, মাওলানা মনযুর আহমাদ নোমানি রহ.-এর ছেলে মাওলানা আতিকুর রহমান প্রমুখ।

তার উল্লেখযোগ্য উস্তাদদের মধ্যে রয়েছেন শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ., শাইখুল আদব মাওলানা এজাজ আলি খান রহ., জামেউল মাকুল ওয়াল মানকুল মাওলানা ইবরাহিম বালিয়াবি রহ. ও মাওলানা সাইয়েদ ফখরুল হাসান মুরাদাবাদি রহ. প্রমুখ।

কর্ম জীবন: তিনি ১৯৪৮ ঈসায়ি মোতাবেক ১৩৬৭ হিজরি সনে ফারাগাত হাসিল করেন। শিক্ষা জীবন থেকে ফারাগাতের দুই বৎসর পর তিনি দেওবন্দে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন।

প্রথমত তিনি কুরআন তরজমা ও নুরুল ইজাহ দরস দিতেন। পর্যায়ক্রমে তিনি নুখবাতুল ফিকার, শরহে আকায়েদ, হেদায়া, মেশকাত, আবু দাউদ ও বুখারি-এর দরস দিয়েছেন।

দীর্ঘ কর্ম জীবনে তার অসংখ্যা ছাত্র গড়ে ওঠে। যারা আজ বিশ্ব মাঝে তাকে স্মরণ করে করে তার জন্য ইসালে সওয়াব করে যাচ্ছেন।

তিনি সময়ের পাবন্দি ও দরসের গুরুত্বের ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়। অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি ছিলো তার নিত্য দিনের অভ্যাস। অবসর সময়ে কিতাবাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

এসলাহি এবং দাওয়াতি সফরের প্রতি বিশেষ আগ্রহ বোধ করতেন। ফলে ফারাগাতের পর দারুল উলুম দেওবন্দে কর্ম জীবন শুরু করার পূর্বে দুই বৎসর পর্যন্ত লাগাতার সফর জারি রেখেছিলেন।

এ সময় তিনি এসলাহি ও দাওয়াতি সফরে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে সফর করেছেন। এমনকি তিনি হিন্দুস্তানের প্রতিটি শহরেও সফর করেছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে গিয়ে মানুষকে হেদায়েতের বাণী শুনিয়েছেন। তার কৃত নসিহতগুলো বই আকারে কয়েক খণ্ডে 'খুতুবাতে খতিবুল ইসলাম' নামে বাজারে প্রকাশিতও হয়েছে।

১৯৮২ তে দারুল উলুম দেওবন্দের শত বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের পর দারুল উলুম দেওবন্দে একটি মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে দেওবন্দ ভাগ হয়ে ওয়াকফ দেওবন্দ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

তখন অনেক বড় বড় উস্তাদ ওয়াকফ দেওবন্দে চলে যেতে লাগলে তিনিও সেই সাথে সেখানে চলে যান। সেখানে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতার পদে সমাসীন ছিলেন। তখন ওয়াকফ দেওবন্দে মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস ছিলেন মাওলানা কারি তৈয়ব রহ.।

তার ইন্তেকালের পর ওয়াকফের সকল জিম্মাদারি তার উপর বর্তায়। ফলে সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি ওয়াকফ দেওবন্দের মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস ছিলেন। সুদীর্ঘ কাল তিনি এ পদে বহাল থাকার পর গত কয়েক বছর পূর্বে বার্ধক্যের দরুন ইস্তফা দেন।

তিনি দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দের সদরে মুহতামিম ও শাইখুল হাদিসের পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল'বোর্ডের নায়েবে সদর ও ইন্ডিয়া ইসলামি ফেকাহ বোর্ডের তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন। ছিলেন আরো বহুল পরিচিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জিম্মাদার।

উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য আলেমদের একজন ছিলেন তিনি। তার দরসে হাদিসের সুখ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে। বহু সুনাম রয়েছে তার দরসে হাদিসে মুসালসালের। অসংখ্যা-অগণিত ছাত্র রয়েছে তার পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। তার ইলমি খেদমতের অবদানও অনিস্বীকার্য।

আধ্যাত্মীক জীবন: তিনি তার শিক্ষা জীবন ও কর্ম জীবনের পাশাপাশি সরব ছিলেন আধ্যাত্মিকতার জগতেও। আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি প্রাথমিকভাবে বাইয়াত হয়েছিলেন মাওলানা শাহ আবদুল কাদের রায়পুরী রহ.-এর হাতে।

তার ইন্তেকালের পর তিনি ইসলাহি ও তরবিয়তি সম্পর্ক গড়েন নিজ পিতা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ তৈয়ব রহ.-এর সাথে। ফলে তিনি তার বাবার থেকেই খেলাফত প্রাপ্ত হন।

খেলাফত লাভের পর পিতার খুলাফা ও মুরিদানগণ তাকে বাবার পদে সমাসিন করে দিলে তিনি তার বাবার আধ্যাত্মিক মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যান। তখন তার বাবার খুলাফা ও মুরিদানরাও তার হাতে বাইয়াত হয়ে যান। বাবার খুলাফা ও মুরিদান ব্যাতিরেকেও পরবর্তীতে অসংখ্যা মানুষ তার হাতে বাইয়াত হন।

জীবন যাপন: হুজুরের দুঃসম্পর্কের এক নাতি মাওলানা ইয়াসির ওয়াজিদি-এর কাছে হুজুরের জীবনের কোনো ঘটনা শুনতে চাইলে তিনি বলেন, মাওলানা সালেম কাসেমি সম্পর্কে আমার নানা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন খুবই মিশুক এবং সাদাসিধে।

এত বড় ব্যক্তি হওয়া সত্তেও তার মাঝে ছিলো না কোনো অহঙ্কার। ছোটো-বড় সবার প্রয়োজনেই তিনি সাড়া দিতেন আগ্রহ নিয়ে। দেওবন্দে এমন কোনো ঘর অবশিষ্ট নেই যেখানে কোনো প্রয়োজনে তাকে ডাকা হয়নি।

আবার তার জীবনে এমন কোনো নজিরও নেই যে, কেউ তাকে কোনো প্রয়োজনে ডেকেছে কিন্তু তিনি যাননি। দেওবন্দের প্রতিটি ঘরেরই কোনো না কোনো বিয়ে তিনি পড়িয়েছেন। তার সুস্থতার সময়ে এমন কোনো বিয়ে মজলিস ছিল না যাতে তিনি অংশগ্রহণ করেননি।

সকল বিয়ের মজলিসেই তাকে ডাকা হতো এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তিনি সেই ডাকে সাড়া দিতেন। কেউ এসে যদি নিজ সন্তানের কুরআন শরিফ খতম উপলক্ষ্যে আয়োজিত মজলিসে ডেকে বসতেন তো আগ্রহ নিয়ে সেখানে চলে যেতেন।

একবার তো এক ছেলে বিসমিল্লাহ পড়া আরম্ভ করবে সেই উপলক্ষ্যে তাকে ডাকা হলে তিনি দৌড়ে দৌড়ে সেখানে চলে গেলেন।

তিনি বলেন, আমার এখনো মনে আছে, আমি পড়া-লেখার শুরুর জমানায় যখন কিতাব নিয়ে তার কাছে যেতাম, তখন তিনি এত এত দোয়া এবং উৎসাহ দিতেন যা সারা জীবন আমাকে পড়া-লেখায় প্রেরণা যোগিয়েছে।

আমি তার সেই দোয়া ও উৎসাহ প্রদানের কোনো নজির পেশ করতে অক্ষম। আর তার এই দোয়া ও উৎসাহ প্রদানের নজির সবার সাথেই ছিলো। কেবল যে আমার সাথেই ছিলো বিষয়টা এমন নয়। যে কেউই কুরআন-কিতাব যা নিয়েই তার কাছে যেতো তিনি তাকে ভরপুর দোয়া আর উৎসাহ দিয়ে দিতেন।

তিনি আরো বলেন, নানার পারিবারিক জীবনেও এমন আনেক ঘটনা আছে যার কোনো নজির আমি আজো খুঁজে পাইনি। যেমন ছোটো সময়ে আমারা প্রায়ই তার স্ত্রী মানে আমাদের নানুর কাছে যেতাম।

তো একবার আমি নানুর কাছে গেলাম। সেদিন তিনিও সেখানে বসা ছিলেন। তো আমি কামরায় প্রবেশ করলাম। এরপর যতক্ষণ আমি তার কাছে বসা ছিলাম তিনি বিভিন্ন ইলমি লতিফা শুনাচ্ছিলেন। যার সবগুলোই ছিলো বিভিন্ন শিক্ষণীয় কাহিনী।

তো তিনি এরকম হাস্য-রসের মাধ্যমেও সকলকে শিক্ষণীয় কাহিনী শুনিয়ে শুনিয়ে জীবন গঠনের দীক্ষা দিতেন। যা পরবর্তিতে আমাদের জীবন চলার উপকরণ হয়েছিলো সারাজীবন। আজ তিনি চলে গেলেন ভাবতেই পারছি না।

সাংসারিক জীবন: সাংসারিক জীবন বা পারিবারিক জীবনে তার ছিলো এক স্ত্রী। আর সন্তানাদির দিক থেকে তিনি ছিলেন চার ছেলে ও দুই কন্যার জনক। চার ছেলের মাঝে বড় ছেলে মাওলানা সালমান কাসেমি রয়েছেন পাকিস্তানে।

দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা সুফিয়ান কাসেমি ওয়াকফ দেওবন্দের বর্তমান মুহতামিম। তৃতীয় ছেলে মাওলানা আদনান কাসেমি হিন্দুস্তানি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের একজন। চতুর্থ ছেলে মাওলানা আসেম কাসেমি 'তৈয়ব ট্রাস্ট দেওবন্দ'র চেয়ারম্যান। আর কন্যা সন্তানের উভয়জনই হিন্দুস্তানে রয়েছেন বিশেষ অবস্থানে।

মৃত্যু: গতকাল ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ঈসায়ি মোতাবেক ২৬ রজব ১৪৩৯ হিজরি রোজ শনিবার বেলা ৩ ঘটিকায় দেওবন্দস্থ তার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। জানাজার ইমামতি করেন তার ছেলে ওয়াকফ দেওবন্দের বর্তমান মুহতামিম মাওলানা সুফিয়ান কাসেমি।

দাফন: দেওবন্দস্থ মাকবারায়ে কাসেমিতে তার পরদাদা হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ. ও তার বাবা হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারি মুহাম্মাদ তৈয়ব রহ.- এই দুইয়ের কবরের মাঝাখানে তাকে দাফন করা হয়।

আসিফা বানু ধর্ষণ-হত্যা; কাশ্মিরিরা কি এভাবেই পঁচে মরবে?

-রোরা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ