মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


মধ্যপ্রাচ্যে ইতিহাস পাল্টানোর রাজনীতি: স্বৈরশাসকরা কি রক্ষা পাবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বাশির নাফি
ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাস গবেষক

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বারুদে চূড়ান্ত আগুন লেগেছে যেদিন থেকে কাতার সংকট শুরু হয়েছে। কাতার সংকট শুরু হওয়ার হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্কের নিজস্ব বলয় তৈরির প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়েছে।

একদিকে সৌদি আরব তার মিত্রদের সহযোগিতায় আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। এজন্য তারা ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়েছে, ইসরাইলের সঙ্গে অলিখিত আপোষ-মীমাংসায় চলে এসেছে।

অন্যদিকে ইরান সিরিয়া ও লেবাননের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করছে।

একইভাবে তুরস্ক যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তার সোনালি অতীতে ফিরে পেতে। কৌশলগত কারণে তুরস্ক ও ইরান তুলনামূলক কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করছে। ত্রিমুখী প্রভাব-প্রচেষ্টায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে দারুণভাবো আন্দোলিত করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এ কূটনৈতিক যুদ্ধের নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইতিহাসের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন।

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মদিনায় নিযুক্ত তুর্কি কমান্ডার ফাকরি পাশার স্মৃতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মদিনা গ্যারিসনে দায়িত্বপালন করেন।

অন্যদিকে মিসর কায়রোয় অবস্থিত তুর্কি সুলতান ১ম সেলিম সড়কের নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ দুই ঘটনার ভেতর মিল ও অমিলের দুটি দিকই রয়েছে। মিলের দিক হলো, সৌদি জোটের মিত্র হিসেবে উভয় দেশ তুরস্কের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছে।

আর অমিলের দিক হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন। তার ইতিহাসজ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। অন্যদিকে একজন মিসরীয় প্রফেসর রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

হিলওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মুহাম্মদ সাবরি আল দালি দাবি করেছেন, ‘সুলতান ১ম সেলিমই মিসরে প্রথম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই মিসরের স্বাধীনতা হরণ করেন এবং মিসরকে তুর্কি সম্রাজ্যের অন্তর্গত করেন। শেষ মামলুক সুলতানকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলান এবং মিসরীয় সেনা বাহিনী ভেঙ্গে দেন।’

মিসরীয় এ প্রফেসর দাবি করেন, কায়রো বা মিসরের অন্য কোনো শহরে সুলতান সেলিমের নামে সড়ক থাকতে পারে না।

কায়রোর গভর্নর তার দাবি মেনে নেন এবং ঘোষণা করেন তিনি সড়কের নাম পাল্টাবেন।

এ ঘোষণার পর মিসরের জনগণ বিতর্কে লিপ্ত হয় নি, মিডিয়াও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আলোচনা করে নি এবং বুদ্ধিজীবী মহলও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। কারণ মিসরীয় জনগণ জানে মিসর এখন কোন পথে হাঁটছে। আর তারা জানে বলেই এ বিষয়ে তারা আগ্রহ হারিয়েছে।

মিসরের জনগণ মানে তারা এমন একজন সামরিক শাসকের অধীনে বাস করছে যে হাজার হাজার মিসরীয়কে বিনা বিচারে বা অভিযোগে আটক করে রেখেছে। যিনি সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কিডনাপ করছে।

জনগণ এক অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে বসবাস করছে এবং তারা তাদের ভবিষ্যত ও স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং তাদের জন্য একটি সড়কের নাম পরিবর্তন নিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ কোথায়?

কিন্তু ইতিহাস যখন রাজনৈতি স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয় তখন তার প্রতি মনোযোগ দেয়াও প্রয়োজন।

সুলতান ১ম সেলিম মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংঘাতের করুণতম সময়ে মিসর বিজয় করেন।

তুর্কি সম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিলো একটি আদর্শিক ভিত্তির উপর। তার মূল লক্ষ্য ছিলো বাইজেনটাইন সম্রাজ্য ও বলকান অঞ্চলের অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো। তারা যথাসম্ভব ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও মিসরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে চলেছে।

কিন্তু ইরানে সাফাভি রাজবংশের উত্থান অটোমান সম্রাজ্যকে হুমকির মুখে পরে। ফলে সুলতান ১ম সেলিমের মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি প্রথমে সাফাভিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং মামলুকদের সঙ্গে কখনোই যুদ্ধে না জড়ানোর নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু সাফাভি ও মামলুকদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।

মামলুক সেনা বাহিনী প্রশিক্ষিত ও উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী তুর্কি বাহিনীর সামনে দীর্ঘ সময় টিকতে পারে নি। সুলতান সেলিম কায়রোতে প্রবেশের পরও মামলুক সুলতান তুমান বাই তুর্কি বাহিনীর উপর আক্রমণ ও গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। বিপরীতে সিরিয়ার বুদ্ধিজীবী ও পদস্থ ব্যক্তিরা তুর্কি বিজয়কে স্বাগত জানান।

বাস্তবতা হলো, সুলতান সেলিম যখন মিসর বিজয় করেন তখন মিসরে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়ের বালাই ছিলো না। তখন পৃথিবীতে চলতো সুলতান ও অভিজাতদের শাসন। সেই সূত্রে মামলুক ও তুর্কিদের ভেতর মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিলো না।

তুর্কিদের মিসর অভিযান মৌলিকার্থে সুলতান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলো না। বরং তা ছিলো মামলুকদের পেশাদার বাহিনী ও তুর্কিদের মধ্যে। তুর্কি বাহিনীর অধিকাংশ আবার তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিলেন না।

তাবলীগের সাথীদের জন্য একটি অনন্য অ্যাপ, এখনই ইনস্টল করুন

মজার ব্যাপার হলো, যে মামলুক সুলতানকে মিসরের শেষ স্বাধীন সুলতান বলা হচ্ছে নৃ-তাত্ত্বিকভাবে তিনি মিসরীয় ছিলেন না। তিনি মিসরীয় জাতীয়বাদের প্রতিষ্ঠাও চান নি।

তিনি ছিলেন সুলতান ১ম সেলিমের মতোই একজন বিদেশি উপনিবেশক। ফলে তুর্কি সুলতান মিসরে অভিযান চালালে সাধারণ জনগণ তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে নি। ফলে সাধারণ মানুষের উল্লেখযোগ্য প্রাণহানিও ঘটেনি তখন।

মামলুকরা মিসর, জাতীয় পরিচয় ও তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কোনোটাই রক্ষা করতে চায় নি। তাদের কাছে মিসর ছিলো একটি উপনিবেশ। সুতরাং মিসর একটি উপনিবেশিক যুগ থেকে আরেকটি উপনিবেশিক যুগে প্রবেশ করে।

সুলতান সেলিমের নাম যদি বিদেশি শাসক হওয়ার কারণে মুছে ফেলতে হয় তবে কায়রো যে দুটি সড়ক ইরানি শাসকদের নামে রয়েছে তাও পাল্টে দেয়া উচিৎ। মেসিডোনিয়ার উপনিবেশিক শাসক আলেক্সেন্ডারের নামে বিদ্যমান আলেক্সেন্ড্রিয়া শহরটির নামও পাল্টাতে হবে।

মিসরের ইতিহাস যারা জানেন তারা স্বীকার করবেন, মিসরের গৌরবোজ্জ্ব ইতিহাস নির্মাণ করেছেন বিদেশি শাসকরাই।

মিসরে ইসলামের আগমন করেছিলো আরব বীর আমর ইবনুল আস রা. এর মাধ্যমে। মিসরের সবচেয়ে গর্ব আল আজহার মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন ফাতেমি কমান্ডার জাওহার আল সিকলি, আব্বাসি কমান্ডারের নামে রয়েছে ইবনে তুলুন মসজিদ এবং আধুনিক মিসরের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলিও মিসরীয় ছিলেন না।

এসব বিদেশিদের হাতেই মিসরের ইতিহাস নির্মিত হয়েছে যাদের কেউ মিসরীয় ছিলেন না। এমনকি মিসর নামটিও দিয়েছিলো বিদেশিরা।

যাইহোক কেউ যদি মনে করেন তাদের নামগুলো পরিবর্তন করে মিসরের ইতিহাস পরিবর্তন করা হয়ে যাবে তবে তারা অবশ্যই ভুল করবেন। কেননা ইতিহাসই বলে দিবে ইতিহাস কখনো বদলানো যায় না।

সূত্র : মিডলইস্ট আই থেকে আতাউর রহমান খসরুর অনুবাদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ