শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এখনো লেখাই হয়নি: মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭ পেয়েছেন মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা বইটির জন্য তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, গল্প ও ইতিহাস প্রাঞ্জল ভাষায় বলেন ও লেখেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকে বস্তুনিষ্ঠ করে তোলার অসামান্য শক্তির ব্যাপারে সুখ্যাতি আছে তার।

নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যথাযথ ভঙিমায় উচ্চারণ করতে জানেন তিনি। এইজন্যই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার যে কোনো লেখা বা বক্তব্য পাঠকশ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়। উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ চেতনায়।

অমর একুশে বইমেলার এ মৌসুমে, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এবং জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা বইটি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পওয়াকে উপলক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধা লেখক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার মুখোমুখি হন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব।

আপনি একত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অগ্রসেনানী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন। একটি স্বাধীন পতাকা ও সবুজ মানচিত্র উপহার দিয়েছেন আমাদের। আমরা আপনার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতিময় গৌরবময় গল্প শুনতে চাই।

প্রথমত আমি কোনো অগ্রসেনানি নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেনানি, এই পরিচয় দিতেই ভালোবাসি। আমার মতে, আমার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার যোদ্ধা ছিল। আমি তাদেরই একজন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গোটা দেশের মানুষই আমাদেরকে সামগ্রিক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আর দশজনের মতোই একজন। অগ্রসৈনিক বলতে- যারা আমাদের পথপ্রদর্শন করেছে, যারা প্রথমে বিদ্রোহ করেছে।

সেটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হোক, সামরিক ক্ষেত্রে হোক। তারা অগ্রসেনানি, যারা নির্দেশনা দিয়েছে। তাদের দিকনির্দেশনায়ই দেশ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে গেছে।

গাঁয়ের লোকেরা তাদের জায়গা দিয়েছে। আপ্যায়ন করেছে। কখনও বলেনি, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছ। কোনও সম্পর্ক রাখনি। এখন বিপদে পড়ে গোটা পরিবার নিয়ে এসেছ আশ্রয় নিতে। কোত্থেকে খাওয়াব। কিছু তো নেই। এধরণের কথা গ্রামের কৃষক জেলে মাঝিরা কখনও বলেনি। তাদের সেই মানবিকতার কাহিনিগুলো ছিল খুবই কষ্টের, যন্ত্রণার। আমরা এখন সব ভুলে গেছি। এইযে আমজনতা, এইযে ব্রাত্যজনের অবদান; সব ভুলে গেছি।

তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, গৌরব, গল্প এগুলো অনেক দীর্ঘতম বিষয়। সামান্য পরিসরে সেগুলোকে ব্যক্ত করা যায় না। তবে আজকে যখন আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করি, বুকভরা কষ্ট নিয়ে কাজ করতে হয়।

আমাদের অর্জন যেমন ছিল, সাফল্য যেমন ছিল, মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত দিক ছিল; তেমনি বুকভাঙা কষ্টের মুহূর্তও ছিল। আমাদের শহিদরা ছিল। আমাদের চোখের সামনে যারা যুদ্ধের সময় আমাদের আশ্রয় দিয়েছে।

আশ্রয় দেয়ার অপরাধে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিরা। দরিদ্র কৃষক! কষ্টে দিনাতিপাত করত। তার ওই ভিটেটা ছাড়া আর কিছু নেই। তবুও তারা বলে নাই, স্যার! আমাদের বাড়িতে থেকে যুদ্ধ কইরেন না। যেটা শহরের মানুষজন করেছে।

যারা প্রথমে ঢাকা শহরে যুদ্ধ করেছে। ফার্মগেট, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় যারা যুদ্ধ করেছে তাদের অনেক মানুষ বাড়িতে আশ্রয় দেয়নি। কিন্তু গ্রামে সেটা ছিল না। এদিক থেকে গ্রামের মানুষরা অনেক বেশি উদার। অনেক বেশি মহানুভব। তাদের কিছুই ছিল না। তারা সর্বস্ব উজার করে দিয়েছে।

তাদের ছোট্ট শোবার ঘরটা ছেড়ে বারান্দায় শুয়েছে। এমনকি তারা গোয়ালঘরেও শুয়েছে। শীতের সময় তাদের লেপকাঁথা ছিল না। যাও সামান্য ছিল, শিশু সন্তানদের লেপকাঁথা; সব আমাদের এনে দিয়েছে।

শরণার্থীদের উচ্ছেদের অবস্থার মতো, ঢাকা থেকে দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা গাঁয়ে ছুটে এসেছে। গাঁয়ের লোকেরা তাদের জায়গা দিয়েছে। আপ্যায়ন করেছে। কখনও বলেনি, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছ। কোনও সম্পর্ক রাখনি।

এখন বিপদে পড়ে গোটা পরিবার নিয়ে এসেছ আশ্রয় নিতে। কোত্থেকে খাওয়াব। কিছু তো নেই। এধরণের কথা গ্রামের কৃষক জেলে মাঝিরা কখনও বলেনি। তাদের সেই মানবিকতার কাহিনিগুলো ছিল খুবই কষ্টের, যন্ত্রণার। আমরা এখন সব ভুলে গেছি। এইযে আমজনতা, এইযে ব্রাত্যজনের অবদান; সব ভুলে গেছি।

যুদ্ধ মানেই সমূহ মৃত্যুর আশঙ্কা। এইটা কোনও নাটক না। এই দৃশ্যটা পারফেক্ট হলো না, আবার করো; কাট। যুদ্ধে সেই কাট নেই। কেননা, শত্রুর যে সৈনিকরা, তারা তো প্রশিক্ষিত, সংগঠিত এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞ।

আমাদের যে মুক্তিবাহিনি তারা তো কৃষিকাজ করে, নৌকার মাঝি; তাদের তো কিছুই নেই। তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, প্রশিক্ষণ নেই, সংগঠন নেই। তারা কেবলই দেশের জন্য প্রাণ দিতে এসেছে, স্বেচ্ছায়।

ধুলোমুক্ত নগর গড়ার শপথ নিলেন শত শত পথচারী

এই ছেলেরা কেবলমাত্র দেশপ্রেমের একটা বায়বীয় আবেগ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। এরা যুদ্ধ করতে পারে, কোনো ব্যাকরণই সেকথা বলছে।

১৯৭১ এর মার্চের আগে যেব গৃহস্থবাড়িতে একটা একনলা বন্দুক থাকত, সাধারণ মানুষ তো নয়ই, চোরডাকাতও তার বাড়ির আঙিনা মাড়াতে সাহস পেত না। সেইখানে, সেই গ্রামের ছেলেদের হাতে রাইফেল উঠল। এলএমজি উঠল। এসএমজি উঠল। এসএমসি উঠল। রকেট লাউঞ্চার উঠল। এক্সক্লুসিভভাবে ব্যবহার করতে শিখল।

এটা তো অসামান্য ব্যাপার। আমদের দীনতা, আমরা তাদেরকে মূল্যায়ন করিনি। করিনি, করি না, করবও না। কেননা, আমরা আছি ‘আমি আমার’ নিয়ে। আমি পরিকল্পণা করলাম, আমি নেতৃত্ব দিলাম। আমিই তো দেশ স্বাধীন করলাম।

আপনি যে জায়গাটায় কথা বলছেন, আমাদের জনযোদ্ধা, সাধারণ যেসব মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে তাদের অবদানকে রাষ্ট্র বা আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন...

না, রাষ্ট্র, এগুলা... আসলে ছিচল্লিশ বছরের গবেষণায় আমি সব ভুলে গেছি। এজন্য আমার প্রথম বইটির নাম ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’।

এইযে গণযোদ্ধারা, এইযে আমজনতা, এইযে ভূমিসংলগ্ন মানুষ তাদের বিনিময়ের দরকার নেই। তাদের তো স্বীকৃতিটাই নেই।

পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কালব্যাপী, পুরো একাত্তরের ছাত্রহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যেসব শিক্ষক-অধ্যাপকরা সেই সময়টাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি বাসভবনে অবস্থান করল, বেতন তুলল।

পাকিস্তানিদের কাছ থেকে...?

হ্যাঁ, একজাক্টলি। এবং একাত্তরের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানিদের রোলিং আপ শুরু হলো। তাদের পশ্চাদপসরণ শুরু হলো। আমরা বুঝতে পারছি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, ঠিক কয়দিন লাগবে সেটা হিসাব করছি; তারা, শিক্ষকরা, চৌদ্দ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে, সরকারি বাসভবনে রয়ে গেল। সরকারের সব সুবিধা নিয়ে।

চৌদ্দ ডিসেম্বর যখন তাদেরকে মেরে ফেলা হলো। তখন বলা হলো, এরা শহিদ বুদ্ধিজীবি। জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই বলা হলো এমনটি। আমার যারা গেরস্ত কামলা, আমার যে আমজনতা, যারা সম্মুখসমরে বুক চিতিয়ে গুলি নিল তার অবদানকে স্বীকারই করা হচ্ছে না।

এখানে বিরাট রাস্তা করা হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীরা সেখানে ফুলের মালা দেন। আর আমাদের শহিদরা শহিদ হিসেবে বিবেচিতই হচ্ছে না। আমি বারবার বলছি, একটা শহিদ দিবস করা হোক। চৌদ্দ ডিসেম্বর নয়। বুদ্ধিজীবি দিবস নয়।

আজকে বুদ্ধিজীবিদের জন্য আলাদা কবরস্থান করা হয়েছে। আমার শহিদ কৃষকদের কোনো কবরস্থান নেই। শহিদ ছাত্রদের কবরস্থান নেই। যারা সম্মুখ সমরে প্রাণ দিল, তাদের কোনো কবরস্থান নেই।

যারা চৌদ্দ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরি করে পাকিস্তানিদের হাতে মারা গেল তাদের জন্য কবরস্থান। তারা মৃত্যুর পরও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে থাকবে না। তাদের মৃত্যুর পর জীবিত বুদ্ধিজীবিরা বলল, যারা তিনটা ডক্টরেট নিয়ে মারা গেছে তারা কি করে আমজনতার সঙ্গে থাকবে কবরে। এটা কি সম্ভব? তাদের জন্য আলাদা কবরস্থান করেন।

অথচ আমার ছেলেরা কোথায় শুয়ে আছে? বাংলাদেশের কোন প্রান্তে তাদের কবর, তাদের সৌধ। কোনো খবর নেই। কোনো উদ্যোগও নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে তিন ধরনের সরকার ছিল। একটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। একটা সামরিক সরকার। আরেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কোনো সরকার উদ্যোগ নেয়নি যে, শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা করি।

আচ্ছা তালিকাটা কিভাবে করবে? আমি তোমাদের বলছি, একসময় অনেক ভুয়া ভোটার কার্ড ছিল। একটা সময় তত্ত্বাবধায় সরকার সেনাবাহিনিকে বলল, তোমরা সঠিক ভোটার তালিকা করে দাও। সেনাবাহিনি সেটা করল। এখন তো কারও কোনো সন্দেহ নেই।

আর্মিরা ভুয়া ভোটারতালিকা করেছে, এমন সন্দেহ কেউ করে না। তার মানে, নির্দেশনা যদি সঠিক হয়, উদ্দেশ্য যদি ভালো হয়; তাহলে করার লোক আছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত, আমাদের উদ্দেশ্য দলগত।

আমরা যদি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় উদ্দেশ্য সামনে রাখি তাহলে কাজ করে দেয়ার লোক আছে।

একাত্তরে আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং যেসব জনযোদ্ধারা নিজেদের বুক উঁচিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারা তো তখন কোনো প্রত্যাশা বা প্ল্যান করেননি যে, তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় উঠবে বা তারা স্বীকৃতি পাবে।

সেটা তাদের লক্ষ্যও ছিল না। কিন্তু আপনি কি মনে করেন? বা আপনার কাছে কি এমন কোনও ফর্মূলা আছে যাতে সঠিকভাবে প্রকৃত শহিদ বা জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা যাবে?

ফর্মূলা তো থাকে না! এটা তোমাদের বুঝতে হবে, আমরা যেটাকে জনযুদ্ধ বলছি, পিপলস ওয়ার, অতীতে অন্যান্য অনেক রাষ্ট্র ছিল, যারা দাবি করে, আমাদেরটাও পিপলস ওয়ার। কিন্তু তাদের সেই মুক্তিযুদ্ধগুলো পিপলস ওয়ার নয়।

পৃথিবীতে কেবলমাত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেই প্রকৃত পিপলস ওয়ার বলা যাবে। যেমন চীন। তারা বলবে পিপলস ওয়ার। মাওসেতুং কমিউনিজমের কথা বলল। তারা বলল, চীনে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হবে। যারা এটার বিরোধিতা করল তারা তাদের সঙ্গে লড়াই করল।

আর স্বভাবতই কিছু ছিল নিরপেক্ষ লোক। আমরা এটাতেও নই, ওটাতেও নই। কমিউনিস্টরা বলল, ঠিক আছে, তোমরা আমদের বিরোধিতাও করোনি বা ওদের সহযোগিতাও করোনি।

ছেলে যুদ্ধে গেল। ফিরল না। হারিয়ে গেল। মা কাঁদবে না। কাঁদবে কে? তুই?এই হচ্ছে কল্পনার মুক্তিযুদ্ধ। তবে আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা আমি ছোট করে দেখছি না। তাদের গান কবিতা চরমপত্র সবই দেশের মানুষকে অনেক উদ্দীপনা যুগিয়েছে। কিন্তু সম্মুখসমরে যুদ্ধ করে প্রণ দেয়া, রক্ত দেয়ার মতো নয় এগুলো। হতেও পারে না কখনও।

তাই চাকরি, ব্যবসা সবক্ষেত্রে তোমাদের সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু নীতি নির্ধারক মহলে থাকবে কমিউনিস্টরা। তাহলে যারা ননকমিউনিস্ট তারাও তো অন্তর্ভুক্ত? সেখানে জনযুদ্ধ হলো না কিন্তু? কিউবা, ভিয়েতনাম সবখানে একই ঘটনা।

আমাদের দেশে সর্বশ্রেণিপেশার মানুষ একই সমতটে নেমে আসল। একই উদ্দেশ্য ছিল তাদের, এই বিদেশি বর্বরদের সহাবস্থানে আমরা থাকব না। তাই জনযুদ্ধ বলতে হলে আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেই বলতে হবে।

আমাদের জনযুদ্ধের শহিদ ও জীবিত গণযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও তাদের অধিকার আদায়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণদের সামনে কাটছাঁট করে উপস্থাপিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

না, কাটছাঁট করে উপস্থান করা হচ্ছে বিষয়টা ঠিক এরকমও নয়। আসলে তারা জানতেই চাচ্ছে না। আর উপস্থাপনও করছে যরা মুক্তিয্দ্ধু সম্পর্কে কিছু জানেই না। যারা জানে তারা বলতে পারছে না।

কম শিক্ষিত, মূর্খ মুক্তিযোদ্ধা, সে তো গ্রামে থাকে। সে কী করে আমাদের শিক্ষিত রুচিবান ছেলেমেয়েদের সামনে তার কথাগুলো তুলে ধরবে। মিডিয়াও তাদের সামনে আনার প্রয়োজন মনে করছে না বা গেঁয়ো আনপড় লোকদের দিয়ে ইতিহাস বলিয়ে নিজেদের পাবলিসিটি কমাতে চাচ্ছে না।

ওকে ভাড়া দিয়ে আনতে হবে। তাকে খাওয়া পরা দিয়ে রাখতে হবে দুদিন। সে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে না। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। দর্শক আকর্ষিত হবে না। মানুষ তাদের কথা শুনবে না।

আর পত্রিকা তাদের কথাগুলো ছাপাবে? তারা তো বুদ্ধিজীবিদের কথা ছাপাবে। এদের কথা কেন ছাপাবে? সুতরাং তাদের তো আনার প্রয়োজনই নেই।

তুমি বলছ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বিশ লাখ। আমি বলছি ত্রিশ লাখ। সে বলছে চল্লিশ লাখ। যে যেটা বলবে প্রমাণ করার দায়িত্ব তার! যদি ত্রিশ লাখ ধরা হয় তাহলে তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাতকোটি। সাড়ে সাতকোটিকে ত্রিশলাখ দিয়ে ভাগ দিলে ভাগফল আসবে পঁচিশ। তাহলে প্রতি পঁচিশজনে একজন করে মেরেছে পাকিস্তানীরা। তোমার কাছের কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করো, বিষয়টা এমন ছিল কিনা?

আমি কামরুল হাসান ভূঁইয়া ইন্টার পড়েছিলাম বলে আজ দুকলম লিখতে পারি। লিখতে পারার কারণে মানুষ আমাকে চেনে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়েছে আমায়। স্বীকৃতি দিয়েছে।

কিন্তু আমি আসলে কে? আমি তো তাদেরই একজন! আমার চেয়েও তো আরও অনেক সাহসী, অনেক কুশলী যোদ্ধারা ছিলেন। তারা আজ অজপাড়া গাঁয়ে পড়ে আছে। কেউ তাদের চেনেই না।

ক্যামেরা পাঠাতে বললে কয়েকটা ছেলেপেলে গিয়ে লুঙ্গিপরা বিষণ্ন দুয়েকটা ছবি নিয়ে চলে আসে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোথায়? তাদের ইতিহাস কোথায়?

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানাজন নানাকিছু লিখেছে। কেউ গল্প লিখেছে। কেউ উপন্যাস লিখেছে। কেউ সত্য ঘটনা লিখেছে। কেউ কল্পনা মিশিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের কি আদৌ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার অধিকার আছে? যদি না থাকে তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর গবেষণাধারা কিভাবে অব্যাহত থাকবে?

কেঁদো নাকো মা! /তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে...

ছেলে যুদ্ধে গেল। ফিরল না। হারিয়ে গেল। মা কাঁদবে না। কাঁদবে কে? তুই?

এই হচ্ছে কল্পনার মুক্তিযুদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা আমি ছোট করে দেখছি না। তাদের গান কবিতা চরমপত্র সবই দেশের মানুষকে অনেক উদ্দীপনা যুগিয়েছে। কিন্তু সম্মুখসমরে যুদ্ধ করে প্রণ দেয়া, রক্ত দেয়ার মতো নয় এগুলো। হতেও পারে না কখনও।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গান কবিতা গল্প উপন্যাস লেখা আর খ্যাত অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের এনে চ্যানেল আইয়ের স্টেজে তোলা এক কথা নয়। আমি যাদের স্টেজে তুলেছি তারা সবাই যুদ্ধের ময়দানে রক্ত দেয়া মানুষ। যারা আমাদের জন্য এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তারাই এদেশের রাজা। তাদের কোনো সমতুল্য নেই।

তথ্যপ্রযুক্তির এই উত্তরাধুনিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা বা বিকৃতি থেকে বাঁচানোর ব্যাপারে আপনার কোনোপরামর্শ আছে কি?

তুমি যে ইতিহাসের কথা বলছ? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোথায় আছে? মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাসই তো নেই। ইতিহাস থাকলে তো সংরক্ষণ করবে বা বিকৃতির হাত থেকে মুক্তি দেবে।

ইতিহাস বিকৃতি অনেক বড় একটা অপরাধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই যেখানে নেই সেখানে তা সংরক্ষণ করা বা বিকৃতির হাত থেকে বাঁচানোর প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা আছে সব মুক্তিযুদ্ধের দলিল।

যেখানে যেসব দলিল পেয়েছে সেগুলো এনে একত্রিত করেছে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংসদ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নামে কিছু নথিভুক্ত করেছে? যদি করত তাহলে সেগুলোর বিকৃতির কথা উঠত। বিকৃতিকারীর শাস্তির কথা উঠত।

তুমি বলছ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বিশ লাখ। আমি বলছি ত্রিশ লাখ। সে বলছে চল্লিশ লাখ। যে যেটা বলবে প্রমাণ করার দায়িত্ব তার! যদি ত্রিশ লাখ ধরা হয় তাহলে তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাতকোটি। সাড়ে সাতকোটিকে ত্রিশলাখ দিয়ে ভাগ দিলে ভাগফল আসবে পঁচিশ। তাহলে প্রতি পঁচিশজনে একজন করে মেরেছে পাকিস্তানিরা?

তোমার কাছের কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করো, বিষয়টা এমন ছিল কিনা?

অথবা পঁচিশে মার্চ ও ষোলো ডিসেম্বরকে যদি অন্তর্ভুক্ত করে হিসেব করা হয় তাহলে পুরো মুক্তিযুদ্ধ ছিল দুশ ছিষট্টি দিন। ত্রিশলাখকে দুশ ছিষট্টি দিয়ে ভাগ দিলে দাঁড়াবে এগার হাজার দুশ ছিয়ান্নব্বই জন। তাহলে গড়ে পাকিস্তানিরা প্রতিদিন এগার হাজার দুশ ছিয়ানব্বই জনকে হত্যা করেছে। সেটা সত্যি কিনা কোনো জরিপ হয়েছে?

বিভিন্ন প্রকার অনুদান আর ডোনেশন পাওয়ার জন্য আমরা ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছি। আমাদের মতো যে কোনো অনুন্নত জাতি এটিই করবে। আজ যখন আমরা অর্ধশতাব্দীর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি তখন আমাদের সত্যের কাছাকাছি যাওয়াও উচিত? কিন্তু এ নিয়ে তো কোনো প্রয়াস, কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

তাহলে ফাইনালি আপনি বলতে চাচ্ছেন, আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস লেখাই হয়নি?

হয়নি তো! হয়েছে নাকি? সবার ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ইতিহাস লেখা চাই। যেটা সবার পক্ষ থেকে স্বীকৃত হবে। সংসদে পাস হবে। আমরা এখনও অপেক্ষা করছি একটি বস্তুনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাসের।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাকেও ধন্যবাদ।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ