শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান ঢাকাস্থ চাঁদপুর ফোরামের সেতুবন্ধন সভা অনুষ্ঠিত অর্থবহ সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়: প্রিন্সিপাল মোসাদ্দেক বিল্লাহ

'মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব': একটি অভিজ্ঞান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ আল জামিল

ডক্টর মো. রিজাউল ইসলাম লিখিত 'মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব' ভিন্ন রকম গ্রন্থ। কতোটা ভিন্ন রকম, তা কোনো সাহিত্যাচার্যের মুখ থেকেই শুনা যাক। বইটির প্রিরিভিউ লিখেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ও বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর আবদুর রহীম।

অল্পকথায় ডক্টর এ রহিম বইটির চারিত্র তুলে ধরেছেন।

তার ভাষায়" প্রিজমের নানা কৌনিকতার আলো ফেলে একজন মুসা আল হাফিজকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন নৈষ্ঠিক গবেষক ড. মো. রিজাউল ইসলাম। মানুষ - প্রেম- প্রকৃতি,ভাণ্ড- ব্রক্ষ্মাণ্ড, কাল- মহাকাল ইত্যাদি কবির চেতনা সংক্রম উদঘাটনে মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব গ্রন্থটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে।"
আর দশটি বইয়ের মতো নয় এ বই- কোনোভাবেই।

দায়সারা কোনো আলোচনাও নয়।এখানে আলো ফেলা হয়েছে প্রিজমের নানা কোনে। উন্মোচন করা হয়েছে কবির মনের জগত।

সে উন্মোচন কতো শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে হয়েছে,তা বুঝতে হলে বইটির ভেতরে ডুব দিতে হবে। মুসা আল হাফিজের রহস্যময় কবিতারাজ্যের ভেতর পর্যটন চালানোর জন্য ডক্টর রিজাউল ইসলামকে আকাশচারী হতে হয়েছে আবার ডুবুরির কাজ করতে হয়েছে সাগরের তলায়।

পাশাপাশি মানুষের সমতলে বিচরণ করতে হয়েছে ছদ্মবেশে। কবির কবিতার মানুষ- প্রকৃতি,কাল- মহাকাল উন্মোচনে তিনি এতোই মগ্ন হন যে, তার ভাষায় " গ্রন্থ প্রণয়ন করতে গিয়ে পরিবারের জন্য বরাদ্ধ সময়টুকু নিষ্ঠুরভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।" মাসের পর মাস পরিশ্রম করে কবির মনোবিশ্ব তিনি আবিষ্কার করেন।

যদিও ডক্টর এ রহিম তার কাজটিতে ' ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়া'র সম্ভাবনা দেখছেন, কিন্তু রিজাউল ইসলাম কাজটিকে মোটেও পরিপূর্ণ ভাবতে রাজী নন। তার মতে ১৭০ পৃষ্ঠার বইটি মুসা আল হাফিজকে প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়।

বরং তার ভাষায় বইটি " কবির মননবিশ্বকে স্পর্শ করার প্রচেষ্টা মাত্র,পরিপূর্ণ উন্মোচন নয়।" মুসা আল হাফিজকে উন্মোচন প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হলো, তাকে " উন্মোচনের কাজ হয়তো হবে আরো বহু হাতের দ্বারা।"
প্রশ্ন হলো মুসা আল হাফিজকে উন্মোচন করা কেন এতো জরুরী? আর তার জগতে এমন কী আছে, যা স্পর্শ করার জন্য এতো দীর্ঘ সফর করতে হলো? কেনইবা তাকে উন্মোচনে আরো বহু হাতের প্রয়োজন? প্রশ্নগুলোর জবাব নিহিত আছে বইটির পাতায় পাতায়।

বইটিতে কী কী বিষয় এসেছে ? আলোচ্যসূচিতে একবার চোখ বুলানো যাক।
* মুক্তি আনন্দে আমিও হাসবো নরম রোদের ঘ্রাণ
* ঈভের হ্রদের মাছ মানব সভ্যতার অভিযাত্রা
* পরম সাঁতারঃ সীমা- অসীমার মেলবন্ধন
* মুসা আল হাফিজের কবিতা সবুজ,জ্যোৎস্না,চাঁদ,ইথারের ঝিল
* প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ সময়ের সাহসী উচ্চারণ
* দৃশ্যকাবে ফররুখ আহমদ চেতনার অনন্য উন্মীলন
স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ আলোচনা শিরোনামে আছে
* 'তুমি -আমি'র রহস্যন্মোচন
* পুরনো আকাশ ও প্রস্তাবিত পৃথিবী
*চিৎপ্রকর্ষের ঝলক ইত্যাদি

এক কথায় বইটির আলোচনাধাচ উল্লেখ করেছেন ডক্টর রিজাউল। লিখেছেন - " মূলত এ গ্রন্থে আলোচনা হয়েছে তার কবিতা নিয়ে।এতে তার পঙক্তিমালায় লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন অর্থময়তার সিড়ি চিহ্নিত হয়েছে।"
এ কাজ আসলেই দুরূহ।

কিন্তু সাহিত্যসমালোচনায় খুবই উপাদেয়। কাজটির জন্য বিজ্ঞ ও দক্ষ হাতেরই প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে ডক্টর রিজাউল ইসলামের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। এর আগে তিনি কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে।

লিখেছেন " রবীন্দ্র- নজরুল সাহিত্য এবং ( ২০১৬) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাশিল্পী শাহেদ আলীকে নিয়ে ঋদ্ধ ও উন্মোচক বইটি তার রচনা " শাহেদ আলীর কথাসাহিত্যে সমাজবাস্তবতার স্বরূপ ও শিল্পরূপ" ( ২০১৪) এ দেশে প্রগতিশীল সাহিত্যধারার নেতৃপুরুষ আহমদ শরীফকে নিয়ে তার অনবদ্য কাজ "আহমদ শরীফ: সাহিত্য সাধনা ও জীবনদর্শন" এর জন্য তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ২০০৫ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ গবেষক পুরষ্কার।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বাংলা বিভাগে।

এমন একজন যখন কোনো কবির কবিতার ভেতর লুকিয়ে থাকা অর্থ নিয়ে গ্রন্থ লিখেন, সে গ্রন্থ অন্যরকম হবেই।গোটা বাংলা কবিতার পরিসর মাথায় রেখে তিনি মুসা আল হাফিজকে ব্যাখ্যা করেন। দু' একটি নমুনা -

" পাঁচ অঙ্কে রচিত এ কবিতায় কবি একদিকে বিশ্বনাগরিক,অপরদিকে স্বদেশনিষ্ঠ। বার বার উচ্চারিত হয়েছে স্বদেশের সুর। মাইকেল মধুসুধন বলেছিলেন - দাঁড়াও পথিকবর,জন্ম যদি তব বঙ্গে', মুসা আল হাফিজ বলেছেন ভিন্নমাত্রিক অর্থে - এই মাটি খনিগর্ভ, এখানে দাঁড়াও! মাইকেল আপন শেকড় দেখেছিলেন কপোতাক্ষে- বাংলায়। মুসার শেকড় আবিষ্কার অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে-' ভূমির ভূমায় উপ্ত যে বন্ধন পেঁচিয়েছে মানচিত্রের প্রতিটি পিলার, সে আমার বৃক্ষের শেকড়।'( পৃষ্ঠা ৩৫)
'নদী' কবিতার আলোচনায় তার প্রখর উন্মোচন-

" দর্শনের হাতে বেদখল একটি কবিতা।দর্শন অধিকৃত হলেও বাইরে- ভেতরে এ আসলে কবিতাই।এক পথিক।দেখছে এক নদী।নদীটি গন্ধকের।শুরু ' উদয়ের চর' হতে।ছুটছে ' অফুরন্তের' দিকে। তরঙ্গে জল নয় সত্তার,কোটি কোটি 'সত্তার নিশ্বাস।' এ আবার কোন নদী? তার স্রোতে সাপের মতো ফুঁসফুঁস করছে ঘূর্ণিরা।

নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে যাত্রী। ঝড় বইছে,যে ঝড় আশা ভেঙ্গে দেয়।যাত্রী বেপরোয়া। ঝড়ের বিরুদ্ধে হয়ে উঠছে আশার সাঁতার। কখন থেকে সে সাঁতার কাটছে, জানে না।কতো কাল ধরে,কতো শতাব্দী ধরে।

এ রকম নদীর সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী'তে দেখেছি এক রকম। সেখানে পরিণত এক জীবনদৃষ্টি কাজ করেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ' খেয়াপারের তরণী' ভিন্ন এক নদী,খেয়া ও যাত্রীদলকে হাজির করে। জাতিয় জীবনের দুর্যোগমুহূর্ত সেখানে অঙ্কিত হয়েছিলো।মুসা আল হাফিজ স্পৃষ্ট হয়েছেন জীবনজিজ্ঞাসায়।

অস্তিত্ববাদ তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে।যাত্রাপথে যুগপৎ আশা ও নিরাশার বলিষ্ঠ উপস্থিতি। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে যাত্রা,এমনকি নদীস্বয়ংও! পুরো কবিতায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন আছড়ে পড়েছে।

আশার দিকে একটু হেলে কবিতাটি শেষ। কিন্তু এ সমাপ্তিও প্রশ্নচিহ্নের আওতায়।তাহলে কি জীবন দেখবে না প্রশ্নের সমাপ্তি? আসলেই দেখবে না।প্রশ্ন আসতেই থাকবে কিন্তু জীবনের যাত্রীদল তুফান উজিয়ে অনন্তের পথে এগুতে থাকবে।"
( পৃষ্ঠা ৩৭)

প্রায়ই আলোচনা প্রবেশ করেছে দার্শনিক এলাকায়। যেমন-
" প্রথম কবিতায় দেখি,আরেক পৃথিবীর গ্যালারি উন্মোচিত হচ্ছে।কবি প্রশ্ন তুলছেন - ' আমরা কোথায় আছি?' জবাব দিচ্ছেন - ' আছি,যেখানে থাকা নেই।' ' না থাকা' ' থাকা' এবং ' থাকা না থাকা'র জিজ্ঞাসা,অনিশ্চ
য়তা,এবং নিশ্চিতি দু'টি লাইনে জড়ো হয়েছে।

প্রশ্ন ও উত্তর আপাত নিরীহ,সরল।কিন্তু এর ভেতরে চিন্তার যে রহস্যময় স্রোত,ইঙ্গিতে কথা বলার যে সূক্ষ্মতা,তা আমাদের বিচারকে জটিল করে তুলে।

' আমরা কোথায় আছি' আমরা কেন জানবো না? কেন প্রশ্ন উঠছে? আমরা কি জানি না 'আমরা কোথায় আছি?' যখন ' কোথায় আছি' তা অজ্ঞাত,তখন কি আমরা স্বাভাবিক জগতে আছি? না আমরা স্বাভাবিক? তখন আমরা কি নিজেদের চিরচেনা পরিমণ্ডলে না এর বাইরে? না- কি আমরা নিজেদের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অচেতন,অজ্ঞ? প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে পরিবেশ- পরিপার্শ্ব যখন অধিকতর পরিচিত হচ্ছে,মানুষ অজানাকে অধিক মাত্রায় জানছে,তখন এ প্রশ্ন কেন? তবে কি এ উন্মোচন ও অবগতির আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর অন্ধকার, ভারি অজ্ঞতা?

কবির কৌতুহল হয়তো এসব জিজ্ঞাসাকে ধারণ করছে কিংবা হয়তো ধারণ করছে কোনো অতিলৌকিক সম্ভাবনা। বস্তুবিশ্ব অতিক্রমী কোনো অবস্থানের ইশারা কি নিহিত আছে এ প্রশ্নে? সমস্ত কিছুই একটি তরঙ্গিত মোহনায় মিলিত হয়,যখন তিনি বলেন- ' আছি,যেখানে থাকা নেই'। হ্যাঁ, নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি,আমরা, মুসলিম উম্মাহ কিংবা মানবসমষ্টি কি যথার্থ ' থাকা'র মধ্যে আছি?

'থাকা'র তাৎপর্যকে অন্যভাবেও ভাবা যায়।হতে পারে আমাদের যাপিত জীবনে,আমাদেরই জগতে গোপনতম অন্তর্গত বিচারে এই 'থাকা'র নিগূঢ়তা ব্যাপক। অস্তিত্বের সত্যে সত্তার স্থিতি হতে পারে 'থাকা'র উদ্দেশ্য।

সেই 'থাকা' হতে পারে আমাদের অন্তরলোকের নিবিড়তম কোনো অনুভবলোকে।অথবা 'থাকা'টা হতে পারে নিজেদের ছাড়িয়ে গিয়ে শাশ্বত আনন্দলোকে নিজেদের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।

সেই 'থাকা' ও তার পর্যায় এবং স্থান- কালের একক কোনো অর্থ উন্মোচন আসলেই দুরূহ- অস্তিত্ব যেখানে গিয়ে বলে - ' আছি,যেখানে থাকা নেই'।
নিজেকে জানার কতো ধাপ পেরুলে ' থাকা নেই' এ 'থাকা' যায়?
( পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)
প্রতিটি কবিতার আত্মা নিয়ে নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক। বইটি সমকালীন সমালোচনাসাহিত্য
ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
মুসা আল হাফিজের মননবিশ্ব
মো. রিজাউল ইসলাম
প্রচ্ছদ: শ ই মামুন
পৃষ্ঠা ১৭০
দাম: ২৬০
পায়রা প্রকাশ
৩১০, রঙমহল টাওয়ার,৩য় তলা,বন্দর বাজার সিলেট।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ