আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
সাহিত্য সম্পাদক
সুখানুভূতি, দুঃখবোধ, চাওয়া-পাওয়া, জন্ম-মৃত্যুসহ যা কিছু মিশে আছে মানুষের পার্থিবজীবনের অস্তিত্বে, সাহিত্য হচ্ছে সেই অস্তিত্বেরই এক রূপরেখার নাম। আর ফার্সি সাহিত্য হচ্ছে, আধ্যাত্মিক মনন চেতনা, ঐশ্বরিক পথ নির্দেশনের উপস্থাপন।
এ সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ সাধিত হয় ইরানে। তবে তা ইরানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তুরস্ক ও উত্তর ভারতেও এর চর্চা ছড়িয়ে পড়েছিল।
ফার্সি সাহিত্যকে এমন সমৃদ্ধ ও বেগবান করেছেন যে সব অমর সাহিত্যিক, তাঁদের পাঁচজনকে নিয়ে এই আয়োজন।
হাকিম আবুল কাশেম ফেরদৌসি, ‘ফেরদৌসি নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ইরানের জাতীয় কবি। ৯৩৫ সালে খোরাসান প্রদেশের তুস নামক এক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
কবির শৈশব কেটেছে বাবা ‘মুহাম্মাদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ’ এর সাথে বাগানে ঘুরে ঘুরে। বাগানের লীলাবৈচিত্র্য তাঁর হৃদয়কে দোলায়িত করতো। তারপর সেই দোলায়িত হৃদয় থেকেই বেরিয়ে আসতো কবিতার ঢেউ।
কবি ফেরদৌসি যখন গজনিতে যান, তখন কবিতা পাঠের মাধ্যমে সুলতান মাহমুদ গজনবির সাথে পরিচয় হয়। সুলতান তাঁর কবিতা শুনে মুগ্ধ হন। বলেন- ‘এয় ফেরদৌসি তু দরবারে ম্যা রা’ ফেরদৌস কারদি’।
অর্থাৎ, হে ফেরদৌসি! তুমি আজ আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।
এ ঘটনা থেকেই আবুল কাশেমের নাম হয়ে গেল ফেরদৌসি। সুলতান ফেরদৌসিকে রাজকবি হিসেবে মনোনীত করলেন।
এতে ঈর্ষান্বিত হয় অন্যান্য কবিরা। তারা ফেরদৌসিকে রাজদরবার থেকে বের করে দেয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। সেই ষড়যন্ত্রেরই একটি হলো, শাহনামার নির্ধারিত মূল্য স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে সুলতানকে রৌপমুদ্রা দেয়ার প্ররোচনা।
এতে সুলতান ও কবির মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এবং এক পর্যায়ে কবি আত্মমর্যাদায় অপমানিত বোধ করেন। ক্রমে এই আঘাত অধিকতর হলে তিনি তা আর সহ্য করতে পারেননি।
পরে যখন সুলতান নিজের ভুল বুঝতে পারেন, তখন তিনি স্বর্ণমুদ্রা পাঠান। কিন্তু ততোদিনে কবি ইহজগৎ ছেড়ে পরকালের অধিবাসী হয়ে যান। ১০২০ সালে তিনি জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে ইন্তেকাল করেন।
ফরিদ উদ্দিন আত্তার এর বাংলা অর্থ হচ্ছে, গন্ধদ্রব্য ব্যবসায়ী। তিনি একজন বড় আতর ব্যবসায়ী ছিলেন। সেখান থেকেই এই নাম।
কোনো এক রহস্যময়ী ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি সেই ব্যবসা ত্যাগ করে সুফিবাদ গ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন একজন উঁচু মাপের ফার্সি কবি। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ অধিক। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মানতিকে তাইয়ার’ অর্থাৎ ‘পাখির সমাবেশ’। এটি একটি প্রতিকী কাহিনী। যা সুফিগণের কাছে আধ্যাত্মিক রহস্যের খনি হিসেবে পরিগণিত।
সেই খনিরই দুইটি লাইন তুলে ধরছি-
‘ওয়ায় কাশিশ উদিত রবেশ গুম গর্দদত/ গর বুয়াদ য়্যক কাতরা কুলযুম গর্দদত’
অর্থাৎ, যদি আকর্ষণে পড়ে যাও, ভুলে যাবে পথ/যদি হও এক ফোটা হবে সমুদ্রবৎ।
কবি ফরিদ উদ্দিন মূলতই একজন আধ্যাত্মিক কবি। তাঁর রচিত কবিতা রুমিসহ প্রখ্যাত কবিগণকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
তিনি একাধারে একজন কবি, চিকিৎসক এবং দার্সনিক ছিলেন। দীর্ঘ দিন তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
ফরিদ উদ্দিন- আত্তার নামে পরিচিত হলেও ওনার আসল নাম, আবু হামিদ বিন আবু বাকর ইব্রাহিম। মহান এই কবি ইরানের নিশাপুরে ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২২০ খ্রিস্টাব্দে দস্যুদের হাতে প্রাণত্যাগ করেন।
পুরো নাম আবুল হাসান ইয়ামিন উদ-দিন খসরু। ফার্সি ও হিন্দি, উভয় ভাষাই ছিল তার নখদর্পে। তিনি ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক শিষ্য।
সুফি কবি নামে পরিচিত এই কবি শুধু কবিই নন, একই সাথে গায়কও। তিনিই সর্ব প্রথম ভারত ও পাকিস্তানে গজলের প্রথা চালু করেন। এ জন্য তাঁকে ‘কাওয়ালির জনক’ বলে ডাকা হয়। তাঁর অমর কীর্তি ‘খালিক-ই-বারি’।
১২৫৩ সালে ভারতের পাতিয়ালা অলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবির বাবা ছিলেন একজন তুর্কি। নাম আমির সাইফ উদ-দিন মাহমুদ। আর মা ছিলেন এক রাজপুত কন্যা।
মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবি শৈশবেই মা আর দাদিকে হারালে তার কাব্য প্রতিভায় বিভীষিকা আছড়ে পরে। তখন তিনি সুলতান বলবনের সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
পরে অবশ্য রয়েল কোর্টেরর বিধানসভার আশ্রয়ে কবিতায় মনোযোগ দেন। বলবনপুত্র বুঘ্র খান তাঁর কবিতা ও গানে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রায় পুরস্কৃত করেন।
সুলতান জালালুদ্দিন খিলজি ক্ষমতায় এলে তঁকে ‘আমারত’উপাধিতে ভূষিত করেন। এখান থেকেই তিনি ‘আমির খসরু’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর লেখা কবিতার দুইটি লাইন পড়লেই বুঝা যায় তিনি কতোটা গভীরের ছিলেন। তিনি লিখেছেন-
‘যে হাল-এ- মিসকিন মাকুন তাগফুল দুরায়ে নায়না বানায়ে বাতিয়াঁ
কি তাব-এ- হিজরা নাদারাম আয় জান না লেহু কাহে লাগায়ে ছাতিয়া’।
অর্থাৎ, এ দৈন্যদশা করো না হেলা চোখের পলকে গেঁথে রচনায়
সয়না বিরহ, ও নিঠুর প্রাণ! কেন রাখো না লাগিয়ে ছিনায়’।
১৩২৫ খ্রিস্টব্দে দিল্লিতে এই মহান কবির ইন্তেকাল হয়।
মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব পুরো নাম হলেও, ‘গালিব’ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। গালিব অর্থ সর্বোচ্চ এবং আসাদ অর্থ সিংহ। নামের স্বার্থকতা ফুটে ওঠে তাঁর কর্মের কাব্যপ্রতিভায়।
মির্জা গালিব মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিককার একজন শ্রেষ্ঠ ফার্সি কবি। একই সাথে তিনি একজন উর্দু কবিও। তাঁর কবিতায় ফুঠে উঠতো শাসনের নামে ব্রিটিশদের শোষণের ভয়াল চিত্র।
মহাবিদ্রোহের সময়ে তাঁর লেখা ‘দাস্তাম্বু’ মজলুমদের দারুণ আলোড়িত করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস যোগায়।
তিনি ১৭৯৭ সালে আগ্রায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মির্জা গালিবের শৈশবশিক্ষক ছিলেন, আগ্রার খ্যাতিমান পণ্ডিত শেখ মোয়াজ্জেম। যুক্তিবিদ্য, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তাঁর ঝোঁক ছিল, ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি।
বিশেষত ফার্সি ভাষার প্রতি। তাই শিষ্যত্ব নেয় তৎসময়ের ফার্সি কবি আব্দুস সামাদের। মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই গালিব ফার্সি কবিতা লিখতে শুরু করেন।
আজীবন তিনি ফার্সিকেই প্রাধাণ্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ফার্সি তাঁর প্রথম প্রেম। গালিবের আরেক উপমা, তিনি বিরহের কবি। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই অতৃপ্তি আর বিরহ ফুঠে উঠেছে। তেমনই দু’টি বিরহ লাইন তুলে ধরছি-
‘দিল মেরা সোজ-এ নিহাঁ সে বেমুজবা জ্বল গ্যয়া
আতিশ- এ খামোশ কে মানিন্দ গোত্রআ জ্বল গ্যয়া’।
অর্থাৎ, প্রেমের লুকানো তাপ কী নিদারুণ আহা হৃদয় পোড়াল
যেন ধিকিধিকি জ্বলন্ত আগুন ছাই হয়ে নিভে গেল।
১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মির্জা গালিব দেহত্যাগ করেন।
আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ছিলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের একজন উঁচুমাপের ফার্সি ও উর্দু মুসলিম কবি। একই সাথে দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদও।
তিনি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। তাঁর এই সৃজনসীলতার জন্য তিনি ফার্সি সাহিত্যের রাজধানী ইরানেও সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইরানে তিনি ‘ইকবাল-ই- লাহোরি’ নামে পরিচিত। আল্লামা ইকবালের বাবা শেখ নুর মুহাম্মদ ছিলেন শিয়ালকোটের নামকরা দর্জি। দর্জি হলেও তৎসময়ের সুফিদের সাথে ওনার ছিল নিবিড় সম্পর্ক।
আর মা ইমাম বিবিও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। মা-বাবার সংস্পর্শ শিশু ইকবালকে দারুণ আলোড়িত করে।
কবি ১৮৯২ সালে স্কটিশ মিশন কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবিকে বিয়ে করেন। তার পর ১৯ ১৬ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
মাঝখানে ১৮৮৫ সালে তিনি লাহোর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্রখর মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেন স্বর্ণপদক। তারপর ১৮৯৯ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
ততোদিনে অবশ্য তিনি সাহিত্য অঙ্গনে আলোচিত এক ব্যক্তি। আল্লামা ইকবাল অমর হয়ে আছেন যেসব কবিতার জন্য, তন্মেধ্যে কয়েকটি হলো ‘আসরার ই খুদি’ ‘শিকওয়া ও জবাবে শিকওয়া’, ‘দ্য রিকনস্ট্রাককশন অব রিলিজিয়াস খট ইন ইসলাম’, ‘জাভেদ নামা’ ইত্যাদি।
তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত এক প্রাণ। তিনি লিখেছেন-
‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তান হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতান হ্যায়, সারা জাহা হামারা’।
অর্থাৎ, চীন আমার, আরব আমার, ভরতও আমার নয়কো পর
জগতজোড়ে মুসলিম আমি সারাটি জাহান বেঁধেছি ঘর।
অসম্ভব এই সাহসী কবির প্রাণবিয়োগ হয় ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল।
নবীজিকে স্বপ্নে দেখা ৩ অধ্যাপকের কথা