শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


ফেলনা নয় প্লাস্টিক বর্জ্য!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

প্লাস্টিকের ব্যবহার এখন সর্বত্র। রেডিমেড গার্মেন্টের আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ (প্যাকেজিং উপাদান, হ্যাঙ্গার, ব্যাগ প্রভৃতি); গৃহস্থালির কাজ (টেবিল ক্লথ, বালতি, জগ, কনটেইনার, গ্লাস-প্লেট প্রভৃতি); আসবাবপত্র (চেয়ার, টোল-টেবিল, শো-পিস, কিচেন তাক প্রভৃতি); দালানসামগ্রী নির্মাণ (প্লাস্টিক পাইপ, দরজা, টয়লেট ফ্ল্যাশ প্রভৃতি); কৃষিসামগ্রী (সেচের পাইপ, প্লাস্টিক ফিল্ম প্রভৃতি); ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী (ইলেকট্রিক কেবল, ইলেকট্রিক সুইচ-বোর্ড, বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ প্রভৃতি); সব ধরনের ফুড-নন ফুড প্যাকেজিং; স্বাস্থ্যসেবা (টুথব্রাশ, সোপকেস, ব্লাডব্যাগ, স্যালাইন সেট, ওষুধের মোড়ক প্রভৃতি) এবং শিল্পসামগ্রীর নানামুখী কাজ প্লাস্টিক ছাড়া আজ কল্পনাও করা যায় না।

তবে এও সত্য, এর কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। যেমন, প্লাস্টিক কয়েকশ বছরেও পচে বিনষ্ট হয় না; প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম ইউজ বেশি; প্লাস্টিক অনবায়নযোগ্য। প্লাস্টিক জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ, এটি মাটির উর্বরতা বিনষ্ট করে এবং জলজ ও সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায়।

এমন বাস্তবতায় সুখবর হচ্ছে পুরোনো প্লাস্টিকের পাইপ, ওয়েস্টেজ প্লাস্টিক সামগ্রী এবং খালি প্লাস্টিকের বোতল এখন আর ফেলনা নয়। এসব সামগ্রীর এখন যথেষ্ট চাহিদা ও মূল্য রয়েছে।

এক্ষেত্রে পথশিশু বা টোকাইরা রাস্তাঘাট, নর্দমা ও আবর্জনার স্তূপ থেকে বোতল কুড়িয়ে নিয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে। ভাঙারি দোকানদাররা আবার একটু বড় দোকানে এসব বোতল বিক্রি করে। সেসব দোকানিরা কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি কারখানায় বোতল সরবরাহ করে।

আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা বোতল টুকরা করার কারখানায় এসব বোতল সরবরাহ করে থাকে।

প্রতি কেজি প্লাস্টিকের বোতলের দাম হিসেবে তারা পায় ৩০-৩৫ টাকা। নানা পর্যায়ে বেচাকেনা হওয়া প্লাস্টিকের এসব বর্জ্য যায় কোথায়? উত্তর হলো, এসব প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপ তৈরি হচ্ছে এবং প্লাস্টিকের বোতলের গুঁড়া রফতানি করা হচ্ছে বিদেশে।

বাংলাদেশ পিইটি ফ্লেকস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএফএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, এসব বোতলের বড় অংশেরই গন্তব্যস্থল চীন। তবে পুরো বোতল হিসেবে নয়, এগুলো যায় টুকরা হয়ে। আর বোতলকে টুকরা করে রফতানি করতে গিয়ে দেশে গড়ে উঠেছে একটি শিল্প খাত। দেশে এখন এ ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় দুই হাজার।

অবশ্য সরাসরি রফতানি করে মাত্র ৫০-৬০টি প্রতিষ্ঠান। অন্যগুলো বড় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রফতানি করে। এ শিল্প খাতে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে চিন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের এ গুঁড়া দিয়ে উন্নত মানের প্লাস্টিকের সুতা তৈরি করা হয়। এ সুতা আমাদের দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার জন্য আমদানি করা হচ্ছে।

দেশে প্রতিবছর এক থেকে দেড় হাজার টন প্লাস্টিকের গুঁড়া উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত প্লাস্টিকের গুঁড়া বিদেশে রফতানি করে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। একটি প্লাস্টিকের গুঁড়া কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চার-পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

বর্তমানে এই শিল্প উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিকগুলো রিসাইক্লিং করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার পাঁচেক কারখানা রয়েছে।

এর মধ্যে ছোট কারখানার সংখ্যা তিন হাজার ৫০০, মধ্যম এক হাজার ৪৮০ ও বড় আকারের ২০টি। জরুরি ভিত্তিতে মধ্যম কারখানার সংখ্যা আরও বাড়ানো যেতে পারে।

এদিকে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ থেকে জ্বালানি তেল তৈরি হবে বলেও জানা গেছে। এই জ্বালানি তেল উদ্ভাবন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের এক ছাত্র।

গত বছরের জুলাইয়ে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য পদার্থ থেকে জ্বালানি তৈরি উৎপাদনের এই ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় দৈনন্দিন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর আমেনাবাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোখলেসুর রহমান ইমন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছে সে। এ সময় তাকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তাকে সরকারি খরচে মালয়েশিয়াও পাঠানো হয়।

তবে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের ইমনের গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। আর এর বাস্তব রূপ পেলে পরিবেশের ভারসাম্যের পাশাপাশি মিটবে জ্বালানি চাহিদা।

এসবেই সুযোগ ও সম্ভাবনার শেষ নয়। প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার করে ভবন নির্মাণও সম্ভব!

সম্প্রতি কলম্বিয়ান স্থপতি অস্কার মেন্ডেজ প্লাস্টিকের বর্জ্যকে ফেলনা না ভেবে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভবন নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার এ উদ্যোগটি দেশটির গৃহহীন মানুষের জীবনে যোগ করেছে আশার আলো।

পুরোনো এসব প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে শহরতলিতে গৃহহীনদের জন্য ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন তিনি। এসব বাড়ি তৈরি করতে প্লাস্টিক বর্জ্যরে সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে একধরনের রাবার।

অসাধারণ এ কর্মযজ্ঞটি সম্পাদন করতে অস্কারের সঙ্গে কাজ করছে একটি বিশেষ দল, যারা কিনা পরিবেশদরদি। যে উদ্যোগ বাংলাদেশেও নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

যতদূর জানা গেছে, এ শিল্পে ব্যাপক লাভ না থাকলেও মোটামুটি লাভ হয়, কিন্তু এ শিল্পে বিরাজ করছে বিভিন্ন সমস্যা। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা তেমন বিত্তশালী নন। পুঁজির অভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারছেন না। দেশে কিছু ব্যবসায়ী প্লাস্টিকের (চিপস) ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছেন।

এসব কারখানা ব্যাপকভাবে গড়ে উঠলে বিদেশ থেকে আর প্লাস্টিকের চিপস আমদানি করতে হবে না। তাই এ খাতের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রয়োজন বলে মনে করি।

প্রসঙ্গত, ইকুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডের (ইইএফ) মাধ্যমে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কয়েকটি খাতকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। এ তহবিল থেকে বোতলের টুকরা শিল্প খাতকেও অর্থসহায়তা দেওয়া যেতে পারে।

অন্তত ১০ বছরের জন্য রিসাইক্লিং শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দিতে পারে সরকার। তাহলে প্লাস্টিক বর্জ্য আর আমাদের বোঝা হয়ে থাকবে না।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

২৭.০২.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ