বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে কি গুণগত শিক্ষা সম্ভব?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনাও করা যায় না। আর জাতীয় উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। একটা ভালো বীজ থেকেই সম্ভব একটা গাছ মহীরূহ হয়ে ওঠা, তেমনি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মৌলিক জীবনধারণের উপকরণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ১৭ (ক), (খ) ও (গ) অনুচ্ছেদে বালক-বালিকাদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাসহ নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে।

এ জন্য ১৯৯২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সরকার প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তিসহ নানা ধরনের উৎসাহমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করে। এ ছাড়া শিক্ষাকে এখন প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের সংগঠনসহ বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

এবার আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে, একজন আদর্শ শিক্ষক পারেন গোটা জাতিকেই পরিবর্তন করতে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে সেই আদর্শ শিক্ষকই যেন আজ সোনার হরিণ। গোটা সমাজ খুঁজে ক’জন সত্যিকারের আদর্শ শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যাবে?

প্রসঙ্গত, আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকবেন, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ ও দায়িত্বশীল হবেন, পড়ানোর পূর্বে পাঠ সম্পর্কে অবগত হবেন, পাঠ্যের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে যার পড়াশোনা থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান চিত্র যে প্রায় বিপরীত।

মনে রাখা চাই- মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরিতে প্রাথমিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি দুর্বল রেখে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র।

প্রাথমিক শিক্ষার মান কীভাবে আরও উন্নত এবং একই সঙ্গে একে প্রাইভেট টিউশনমুক্ত করা যায়, তার কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। এ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

সরকারি প্রচেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে শিক্ষার্থীর তুলনায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করায় শিক্ষার গুণগত মান সেভাবে বাড়েনি। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেও অনেক সময় শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণই হতে পারে এ থেকে মুক্তির অন্যতম পথ। অধিকাংশ শিক্ষক স্বল্প বেতনে কাজ করেন বলে তাদের মধ্যে বাড়তি আয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।

এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান উন্নত করা ব্যতীত এক্ষেত্রে সুফল মিলবে কি?

তবে, শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে। এ স্তরে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু আমরা হতে পারে ভুলতে বসেছি যে, ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার। আর এখানে আমাদের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে কখনই গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এটা নীতিনির্ধারকদেরও অজানা নয়। শিক্ষকদের তাই প্রশিক্ষণের আওতায় আনছে সরকার। তার পরও বড় অংশ এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) সর্বশেষ বিদ্যালয় শুমারির তথ্য বলছে, ৩০ শতাংশের বেশি অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। এটি নৈপুণ্যপূর্ণ পাঠদানের অন্তরায় নয় কি?

অবশ্য শ্রেণীকক্ষে পরিকল্পিত পাঠদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য রয়েছে শিক্ষক সংস্করণ, সহায়িকা ও নির্দেশিকা। এর প্রধান লক্ষ্য শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম সহজীকরণ ও শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন।

পাঠদানের ক্ষেত্রে এ নির্দেশিকা অনুসরণে শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া আছে। কিন্তু সরকার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের ৬৪ শতাংশই পাঠদানের ক্ষেত্রে এ নির্দেশিকা অনুসরণ করতে পারছেন না।

তাহলে কি বলা যায় না- প্রশিক্ষণের অভাবেই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষকরা? এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রশিক্ষণ জরুরি। মনে রাখা চাই, প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের পাঠদানে বিস্তর তফাৎ।

প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পাঠদান সহজবোধ্য হলেও প্রশিক্ষণের অভাবে একজন শিক্ষকের পাঠদান শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বোধ্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কাজেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে নূন্যতম শিথিলতাও প্রত্যাশিত নয়।

বলতে হয়, প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠদান সহজবোধ্য করা যাচ্ছে না। এতে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থা দীর্ঘতর হলে শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকবে।

সুতরাং বিষয়টি আমলে নিয়ে শতভাগ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া আজ সময়ের দাবি। তবেই গুণগত পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

২৪.০২.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ