বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


‘আউট বই পড়ার অপরাধে শাস্তির বদলে হুজুর একটি উপন্যাস ধরিয়ে দিলেন’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান
নির্বাহী সম্পাদক

খ্যাতিমান লেখক, শিক্ষক ও লেখক তৈরির কারিগর আইয়ুব বিন মঈন। তরুণ লেখকদের কাছে একটি পরিচিত নাম। ভাষা ও বানানের দক্ষতায় যিনি সবার কাছে পরিচিত মুখ। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ১০ এমন বইয়ের নাম যা আপনার প্রিয় এবং অন্যকে সব সময় পড়তে বলবেন।

আইয়ুব বিন মঈন জানালেন, প্রিয় শব্দটি আপেক্ষিক। যেহেতু স্থান কাল পাত্র বয়স ভেদে রুচির ভিন্নতা চলে আসে। তাই প্রিয় অপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রেও পরির্তন আসা স্বাভাবিক। তারপরও কিছু কিছু বই সবসময় প্রিয় থেকে যায়।

প্রিয় বই কোনগুলো? এর জবাবে অনেক বইয়ের নামই বলা যায় এবং বলতে হয়। আর প্রিয় বই কোনগুলো বলে যদি কোন ধরনের বই বুঝাতে চান তাহলে বলব এখন বাস্তবধর্মী আত্মজীবনীমূলক এবং শুদ্ধ সাহিত্য ও ভাষা বিষয়ক বইগুলো আমকে বেশি টানে।

অন্যকে পড়তে বলতে পারি এমন আমার প্রিয় দশটি বই-

১. লা মিযারেবল- ভিক্টর হুগো। ২. চিলড্রেন অব দ্যা নিউ ফরেস্ট- ফ্রেডরিক ম্যারিয়্যাট। ৩. নীল আকাশ- রোমেনা আফাজ। ৪. মার্জিনে মন্তব্য- সৈয়দ শামসুল হক। ৫. বাংলা লেখার নিয়ম কানুন- ড. হায়াৎ মামুদ।

৬. বাংলা বানানের নিয়ম- ড.মাহবুবুল হক। ৭. আত্মকথা- আবুল মনসুর আহমদ। ৮ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না-  হুমায়ুন আজাদ। ৯. শব্দ সাংস্কৃতির ছোবল- জহুরী। ও ১০. প্যারাডক্সিকেল সাজিদ- আরিফ আজাদ।

তার কাছে ফের জানতে চেয়েছিলাম বই পড়ার ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা যা এখনো স্মৃতিপটে রয়ে গেছে। ভুলতে পারেন না।

একুশে বইমেলায় প্রকাশিত সব বই দেখতে ও কিনতে ক্লিক করুন

তিনি বললেন, যেহেতু আমাদের সেই সময় ছাত্রজীবনের পরিবেশটা ছিল একদম আলাদা। তাছাড়া আমি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি তা ছিল সম্পূর্ণ প্রতিকূল । তাই আমার জীবনে বাংলা বই পড়া কেন্দ্রিক এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলোর কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে এবং চোখ পানি চলে আসে।

তখন আমি বগুড়া জামিল মাদরাসায় পড়ি ১৯৮৬/৮৭ সনের কথা অন্যান্য মাদরাসার মতো সেখানেও বাংলা ভাষার কোনো বই পড়াটাই (তা যত সুন্দর বিষয়ের হোক না কেন?) ছিল অমার্জনীয় অপরাধ।

এমনকি কারো কাছে বাংলাভাষার কোনো বই-পুস্তক পত্র-পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পাওয়া গেলে তা পুড়িয়ে ফেলা হতো এবং সেই ছাত্রকে বড় ধরনের শাস্তিও ভোগ করতে হত। ক্ষেত্র বিশেষ কাউকে আবার মাদরাসা থেকে বহিষ্কারও করা হত।

এতোকিছুর মাঝেও কিছু কিছু ছাত্র নানা উপায়ে বাংলা বই সংগ্রহ করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ত। যেহেতু মাঝে মাঝেই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের ট্রাঙ্ক, ব্যাগ, বেডিং ইত্যাদিতে তল্লাশি করা হত। তাই ছত্ররা বইগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে তোশকের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখত। যাতে ধরা খেতে না হয়।

তো বই সংগ্রহের কাজ যারা করত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লুৎফুর রহমান। আমার তিন জামাত নিচে পড়লেও বই পড়ার প্রতি ছিল তার ভীষণ নেশা।

সে প্রতি সপ্তাহে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী উডবার্ন লাইব্রেরি থেকে এবং বিভিন্ন পাঠাগার থেকে বই ধার নিয়ে আসত। এমনকি বিখ্যাত দস্যু বনহুর সিরিজের লেখিকা রোমেনা আফাজের বাসা (কাছ) থেকেও সে বই নিয়ে আসত মাঝে মধ্যে। আমি তার কাছ থেকেই বই নিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে পড়তাম।

‘লোকে বলে চোরের দশদিন, গৃহস্তের একদিন’। সে সময় বাংলা বই উদ্ধারের তুমুল অভিযান চলছিল। নাজেমে তালিমাত অফিসের সামনে বই পুড়ে ফেলার (দাউ দাউ করে আগুন জ্বলার ) দৃশ্য এখনও আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে।

যদিও আমি কখনো বইসহ হাতে নাতে ধরা পড়িনি, কিন্তু জানতেপারি আমার নামটিও বাংলা পড়া ছেলেদের তালিকায় জমা পড়ে গেছে।

ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ

ওইসময় আমাদের নাজেমে দারুল একামা ছিলেন মাওলানা আবদুল হক হক্কানি। তিনি ছিলেন যেমন এলেমের মাহের তেমন বিশালদেহী। থাকতেন আমাদের ভবনের একদম দক্ষিণ পাশের রূমে এবং এখনো থাকেন।

তার চোখ দেখলে আর ‘এই গাধা’ বলে ডাক শুনলে সবার পিলে চমকে যেত।

হঠাৎ আমর ডাক পড়ে যায় তার রুমে। এতে কয়েকজন ছাত্র বেশ খুশি। তারা বলতে থাকে- ‘আজ আর রক্ষে নেই। শাস্তি একটা হবেই আচ্ছামত। এখন থেকে চুরি করে বাংল পড়ার সাধ মিটে যবে। মিটে যাবে কবি হওয়ার---’।

(যদিও অবসর সময় ছাড়া কখনই নিয়ম অমান্য করে বই পড়িনি তবুও গত দিনের পড়ুয়া ছাত্রদের শাস্তি ভোগ আর বই পুড়তে দেখার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকায় আমার ভেতরটা একদম শুকিয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আসতে সালাম দিয়ে হুজুরের রুমে ঢুকি।

হুজুর তার স্বভাব সুলভ অনেক কথা বলেন। কথার একপর্যায়ে বললেন, তুইযে লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলা বই পুস্তক পড়িস আর লেখলেখি করিস তা এখনো হাতেনাতে ধরা পড়িস না বলে কি মনে করিস আমি ওসব জানি না? গতকালের কথা মনে আছে? ওদের কেমন শাস্তি হয়েছে দেখিসনি?বল তুই কি শাস্তি নিবি?

আমি যেন একদম মরে গেছি। মুখ দিয়ে কিছু বের হতে চাচ্ছে না। তবুও মাথা নিচু করেই আস্তে করে বলি, আপনি যে শাস্তিই দিবেন তা-ই মাথা পেতে নেব। তখন তিনি আচ্ছা দাঁড়া বলে উঠে দাঁড়াতেই আমার অবস্থা কাহিল। ভাবছি, এই বুঝি শেষ ।

ইফোর্ট: টি শার্টে আধুনিকতা ও শালীনতার সমন্বয়

কিন্তু তিনি উঠে বেত হতে না নিয়ে এগিয়ে যান তার আলমারির (বুক সেলফের) দিকে। একটু নাড়া চাড়া করে সেখান থেকে একটি বই বের করে এনে আমার সামনে এগিয়ে ধরে মমতা ভরে বলেন, এই গাধা! খুব ভয় পেয়েছিস বুঝি? নে, এটাই তোর শাস্তি। অবসর সময়ে এটি পড়বি, পড়া শেষে এটি জমা দিয়ে আবার অন্য বই নিয়ে যাবি। কিন্তু, খুব এহতিয়াতের সঙ্গে পড়বি।

আর শোন! অন্যদের কাছ থেকে বাংলা বই নিয়ে পুড়ে ফেলা হচ্ছে আর তোকে আমি নিজে বই সরবরাহ করছি এর কারণ অবশ্যই বুঝতে হবে। অবশ তুই বুঝবি বলেই আমি দিচ্ছি। সেই মুহূর্তে আমার অবস্থা যে কেমন হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশের নয়। হ্যা, সেই বইটি ছিল নাসিম হেজাজির ‘হেজাজের কাফেলা’।

ইদানিং মানুষ বড্ড নেটমুখী। পড়তে চায় না। মানুষকে বইমুখী করা যায় কীভাবে? তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্নটির জবাবে আইয়ুব বিন মঈন বললেন-

মানুষ নেটমুখী, তা ঠিক এবং তারা পড়তে চায় না, একথা বহুলাংশে ঠিক। কিন্তু এই মানুষেরা নেটমুখী হওয়ার আগেও তো পড়তে চাইত না। তবে যেসব মানুষ ‘পাঠক’ তারা কিন্তু নেটমুখী হয়েও ঠিকই পড়ে চলেছে।

ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় প্রকৃত পাঠকরা মুদ্রিত বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। যদিও এখন নেটের সয়লাব চলছে। তবে আমি মনে করি এটা সাময়িক জোয়ার মাত্র। কিছুদিন পর তাতে অবশ্যই ভাটার টান আসবে।

প্রবাদ আছে- كُلٌّ شَئٍ يرَجِعُ إِلَى اَصْلِه “সবকিছুই তার মূলের দিকে ফিরে আসে”

সবাই ফিরে না এলেও মুদ্রিত মানসম্পন্ন বইয়ের পাঠকরা ঠিকই ফিরে আসবে। এক সময় কিন্তু মনে করা হচ্ছিল, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কারণে প্রিন্ট মিডিয়া গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। পাঠক শূন্যতা দেখা দিবে।

তবে বাস্তবে কিন্তু এমনটি ঘটেনি। বরং এখন সেগুলোর সংখ্যা ও সার্কুলেশন দুটিই বেড়েছে। এমনকি প্রায় প্রতিটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থাকা এবং সেগুলোর মিনিটে মিনিটে আপডেট দেওয়া সত্ত্বেও তার মুদ্রিত সংখ্যার একটুও কমতি হচ্ছে না।

তেমনি মুদ্রিত ভালোমানের বইগুলোর অনলাইন সংস্করণ থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদা বেড়ে চলছে। নতুন নতুন প্রকাশনীও আত্মপ্রকাশ করে চলছে।

তবে যারা মার খাচ্ছে তারা ভিন্ন কারণে খাচ্ছে । যেমন- কিছু নিরিহ মানুষের অন্তরের ধোঁয়ার দাগ...। পাশাপাশি তাদের আদর্শ ও সততা না থাকার কারণে।

এরপরও কিছু সংখ্যক মানুষ যদি মুদ্রিত বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে তবে তা সঙ্গত কারণেই। সেকারণগুলোও পরিষ্কার এবং তিক্তসত্য। কিন্তু সেই সত্যগুলো আমি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।

প্রকৃত লেখকের ভালোমানের বই ছাপানোর দিকে গুরুত্ব দিলে, মানসম্মত বই করে পরিকল্পিত বিপনন ব্যবস্থা গড়ে তুললে আপনার ভাষায় ‘মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পাঠকরাও’ ফিরে আসবে।

তাছাড়া এ বিষয়ে আরো কিছু করণীয় আছে যা সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে গেলে বেশ সময়ের দরকার, আবার কিছু না বলাই ভালো।

নবীজিকে স্বপ্নে দেখা ৩ অধ্যাপকের কথা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ