শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


র‌্যাগিং মানে কি অসভ্যতা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

অবাক হতে হয় যখন শুনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে প্রথম পা রেখেই র‌্যাগিং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, শাহজালাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ে এ অবস্থা চরম নাজুক।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম র‌্যাগিং অত্যাচারের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিজানুর রাহমান মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বর্তমানে ওই শিক্ষার্থীর অবস্থা এতটাই খারাপ যে সে তার বাবা-মাকে পর্যন্ত চিনতে পারছে না! সভ্য সমাজে এ কী করে সম্ভব হতে পারে? দেশের শিক্ষাঙ্গনে কি কোনো আইন নেই এসব বন্ধ করার জন্য?

বলা যায়, দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‌্যাগিংয়ের নামে নীরব নিপীড়ন নির্যাতন চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কি-না ছাত্র রাজনীতির দাপটে কিছু করতে পারে না! প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য কি রাজনীতি না-কি শিক্ষা গ্রহণ?

ঘরে বসে একুশে বইমেলার সব বই পেতে অর্ডার করুন

গণমাধ্যমে প্রকাশ, রসিকতার নামে নীরব এই নির্যাতনে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত সরকারি কলেজগুলোও। র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী স্বপ্ন সিঁড়িতে পা রাখতেই হোঁচট খায়।

অনেকে ক্যাম্পাস পরিবর্তন করে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অভিযুক্তদের প্রতি কর্তৃপক্ষের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে অবিরাম চলছে এমন নির্মমতা ও নির্যাতন। এভাবে আমরা নতুন কোন সভ্যতা নির্মাণ করতে চাচ্ছি?

র‌্যাগিং শব্দটির প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ‘পরিচয় পর্ব’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা সেটাকে র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে যে র‌্যাগিং হচ্ছে তা এককথায় টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের মতো।

এতে পরিচয়ের নামে পুরনো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের হুকুম পালন করতে হয় নতুনদের। পালন না করলেই শুরু হয় মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। এর মধ্যে রয়েছে- ‘পুরনো শিক্ষার্থীরা তাদের থুথু মাটিতে ফেলে নতুনদের তা চাটতে বলে’। ‘কান ধরে উঠবস করতে বলে’। ‘বড় ভাইদের পা ধরে সালাম করার মাধ্যমে সম্মান করতে বলে।’

এসব না করলে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া হয় এবং নির্যাতন চালানো হয়।

যারা র‌্যাগিং করে, তারা এটাকে ঠাট্টা মনে করে। নতুন কোনো শিক্ষার্থীকে কষ্ট দিয়ে, তার মনকে সংকুচিত করে তারা আনন্দ পায়। হায় সভ্যতা! নবীনদের বরণ করতে, তাদের সঠিক জিনিসটি শিক্ষা দিতে অনেক ভালো ভালো পদ্ধতি থাকা শর্তে এমন প্রথা কেন? কাউকে কোনো কিছুতে বাধ্য করতে হবে, এটা কেমন নিয়ম?

অধিকাংশের মতে র‌্যাগিং সংস্কৃতি মূলত মিলিটারি থেকে এসেছে। যেখানে ‘চেইন অব কমান্ড’ মেনে চলতে হয়। আবার, অনেকের মতে, এর প্রথম শুরুটা হয়েছিল গ্রিক কালচারে। যাই হোক, ষাটের দশকে এই উপমহাদেশে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

প্রথম দিকে এটা নির্দোষ সিনিয়র-জুনিয়রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হতো। পরে দিন দিন র‌্যাগিংয়ের মানে পাল্টে যেতে থাকে; বরং এটা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা কিংবা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর জন্য বিভীষিকার রূপ নেয়। আশির দশকে ভারত, শ্রীলঙ্কায় এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও এর প্রচলন বাড়তে থাকে নব্বইয়ের দশকে।

র‌্যাগিংয়ের নামে আজ যারা শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছ- তারা কি ভুলে গেছে যে, একদিন তারাও নতুন শিক্ষার্থী ছিল। মফস্বল, অজপাড়াগাঁ, রাজধানী কিংবা অন্য কোনো শহর থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসেছিল।

তখন অপরিচিত, অর্ধপরিচিত বা পরিচিতদের মাঝে কেউ যদি তাকে রাতভর এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখত; যদি শরীরের কাপড়চোপড় খুলে নগ্ন হতে বাধ্য করা হতো- কেমন অনুভূতি হতো তবে? হাজার হাজার ভর্তিচ্ছুকে পেছনে ফেলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে, তাকে স্বাগত জানানো কিংবা উৎসাহিত করার পরিবর্তে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন কতটুকু শোভা পায়; তারা কি ভেবে দেখেছে?

যতটা জানি, ভারতসহ অন্যান্য দেশে র‌্যাগিং প্রতিরোধে আইন থাকলেও বাংলাদেশে সুস্পষ্ট র‌্যাগিং প্রতিরোধে কোনো আইন নেই।

আর সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব ও সুস্থধারার রাজনীতির অনুপস্থিতি এমন সামাজিক ব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। যা প্রতিরোধে সোচ্চার হতে হবে আমাদের। আমরা র‌্যাগিংয়ের নামে চলতে থাকা অসভ্যতা চাই না।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ