মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর ১০ম মজলিসে উমুমী সভা অনুষ্ঠিত হলো সোমবার। দেশের কওমী মাদরাসাসমূহের সর্ববৃহৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এই উমুমী সভা বা কাউন্সিল ঘিরে আগে থেকেই আলেম– ছাত্রসহ সর্বশ্রেণীর ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্যপক আগ্রহ ছিল।
কাউন্সিলে বেফাকের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ২৭ জন সহ সভাপতি, ৯জন সহকারী মহাসচিব ও ১৫জন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ মোট সদস্য সংখ্যা ১১৬।
কমিটিতে শীর্ষ পর্যায়ে যারা স্থান পেয়েছেন তাদের বুজুর্গি, যোগ্যতা ও আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু যুগযুগ ধরে দেশের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার উৎস যদি এক কেন্দ্রেই নির্ধারিত হয়ে যায় তাহলে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে কিনা এই সন্দেহ অনেকের।
এছাড়াও কাউন্সিলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলছে নানা পর্যালোচনা–সমালোচনা। সেগুলোর ভালোমন্দের বিশ্লেষণে না গিয়ে একজন ক্ষুদ্র তালিবে ইলম হিসাবে নিজের কিছু উপলব্ধি শেয়ার করতে চাই-
এক. ‘শিক্ষাবোর্ডের’ শিক্ষাসচিব নেই
বেফাকের মূল কার্যক্রম যেহেতু শিক্ষাসংক্রান্ত, তাই প্রত্যাশা ছিল এখানে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন ‘শিক্ষাসচিব’' নির্বাচিত হবেন, যিনি দক্ষ জনবল নিয়ে শুধু এ কাজের জন্যই সময় দিবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাবিভাগ সংক্রান্ত কোন পদই আলাদাভাবে ঘোষিত হয়নি।
বস্তুত বেফাক নামে একটি শিক্ষাবোর্ড হলেও গতানুগতিক কোনো বোর্ড নয়। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ কওমি মাদরাসা এই বোর্ডের অধীনে। দল-মত নির্বিশেষে শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই আছেন এই বোর্ডের সঙ্গে।
তাই বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃতি, দেশ–সমাজ, জনসংখ্যার আলোকে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে বেফাকের যে ভূমিকা থাকা দরকার ছিল বিগত সময়ে তা হয়নি।
গত ২০ বছর যাবত কওমী সনদের স্বীকৃতি আদায়ে বেফাক যে পরিমাণ সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছে, শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে তার সিকিভাগও ব্যয় হয়নি। এই সময়ে বেফাকভুক্ত মাদরাসার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। কেন্দ্রীভাবে পরীক্ষাও হচ্ছে প্রতি বছর।
কিন্তু বেফাক প্রণিত অভিন্ন সিলেবাস মানা হয় না অনেক মাদরাসায়। বেফাকের প্রকাশিত টেক্সটবুকগুলোর মান নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে।
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্লিখন সংক্রান্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোন কমিটি আছে কিনা জানি না। দেশীয়–আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বেফাক বড় বড় সম্মেলন করেছে। কিন্তু মাদরাসার মুহতামিম ও বেফাক সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বাইরে দেশ–বিদেশের শিক্ষাবিদদের নিয়ে ‘শিক্ষা সেমিনার’ আয়োজন করেছে বলে কখনো শুনিনি।
বর্তমানে বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিশুর বয়স, মেধা, শারিরিক–মানসিক গঠনের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উসুলুদ্দীন ও উলুমুশ শারিয়াহর শিক্ষাদান পদ্ধতি কী হওয়া উচিৎ তার স্পষ্ট রূপরেখা সম্বলিত কোন বই নেই।
ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ
হয়ত ছোট মুখে বড় কথা, কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও এগুলো না হওয়া বেফাকের মোটা দাগের ব্যর্থতা। যার আশু সমাধানে নতুন দায়িত্বশীলদের ভাবা দরকার।
দুই. পরীক্ষার কেন্দ্রীয়করণ
গত কাউন্সিলে নতুন করে নাজেরা, কাফিয়া জামাত ও ইফতা বিভাগের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে প্রশংসনীয় হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী তা আরো ভাবা দরকার।
প্রাইমারি, সেকেন্ডারি পর্যায়ে পরীক্ষার কেন্দ্রীয়করণ অনেক দেশেই আছে। কিন্তু ‘তাখাসসুস’ পর্যায়ে এই ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও আছে বলে জনা নেই।
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ক্লাস এইট থেকেই প্রাথমিক তাখাসসুস শুরু হয়ে যায়। মানবিক, ব্যবসায়, বিজ্ঞান বিভাগ। উচ্চমাধ্যমিকের পর পথ হয় আরো উন্মুক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোন একটি সাবজেক্টে অনার্স, আরো গভীরতা অর্জনে মাস্টার্স করা। এমফিল–পিএইচডি পর্যায়ে আসে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জনে গবেষণা করা।
এই বিশেষ পাণ্ডিত্য ও বুৎপত্তি ব্যক্তিবিশেষে পার্থক্য হয়ে থাকে। তাই এখানে লিখিত পরীক্ষার বাইরেও ভাইবা-টেস্ট আরো বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসৃত হয়। পাশ–ফেল–সিরিয়ালের বাইরে এখানে ব্যক্তির যোগ্যতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার দক্ষতা যাচাইই মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে।
বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাগুলোতে দাওরার আগ পর্যন্ত তাখাসসুসের কোন সুযোগ নেই। এখানে বিভিন্ন মারহালায় কেন্দ্রীয় পরীক্ষা হয়। বোর্ডভুক্ত জামাতগুলোতে বিশেষ নেগরানি চলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য।
এটি একটি ইতিবাচক দিক হলেও বর্তমানে পরীক্ষামুখী পড়াশোনা শাস্ত্রীয় দক্ষতা অর্জনের পথে অনেক ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে নোট–গাইড বাণিজ্য পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে নিয়ে গেছে।
দাওরার পর নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে তাখাসসুস বিভাগ রয়েছে। তাফসির, হাদিস, ইফতা, আদব, দাওয়াহ। কিন্তু এই পাঁচটি শিরোনামের অধীনে যে অসংখ্য অধ্যায় রয়েছে তার প্রতিটির জন্য আলাদা শিক্ষক–ছাত্র–বিভাগ প্রয়োজন। প্রয়োজন ভিন্নভিন্ন সিলেবাস ও পরীক্ষা।
তাখাসসুস বিভাগগুলোর পরীক্ষা পদ্ধতিতেও ব্যাপক সংস্কার আনা দরকার। এসব বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপের বদলে অন্যান্য জামাতের মত শুধু পরীক্ষার কেন্দ্রীয়করণ কতটা সুফল দিবে তা জানি না। কালক্রমে এখানেও নোট–গাইড বাণিজ্য শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শেষ কথা, উসুলুদ্দিন ও উলুমুশ শারিয়াহ অপরিবর্তিত। কিন্তু যুগে যুগে এগুলোর পাঠদান পদ্ধতিতে ব্যপক সংস্কার এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। আর শিক্ষার প্রধান বয়স যেহেতু শিশুকাল, তাই ‘শিশুর বয়স, মেধা, শারিরিক–মানসিক গঠনের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন অপরিহার্য দাবী।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ومما ينبغي أن يعتمد : حال الصبي وما هو مستعد له من الأعمال ومهيأ له منها ، فيعلم أنه مخلوق له : فلا يحمله على غيره ، ما كان مأذوناً فيه شرعاً ؛ فإنه إن حمله على غير ما هو مستعد له : لم يفلح فيه ، وفاته ما هو مهيأ له
অর্থাৎ, শিশুর তারবিয়াত ও প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তার ‘অবস্থা ও কোন কাজের জন্য সে প্রস্তুত’ তা বিবেচনা করা। তখন বুঝা যাবে সে এটার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাই তাকে অন্য কাজে না লাগানো। যদি তা শরীয়তসিদ্ধ হয়।
কারণ, যদি তাকে যে কাজের জন্য প্রস্তুত নয় তার উপর জোর করা হয় তাহলে সেখানে ব্যর্থ হবে, আর নিজের সামর্থ্যও হারাবে।
বিদআত, শুবুহাত, ইলহাদ মহামারির রূপ নিয়েছে, তার পরিবর্তে সর্বস্তরের মানুষের জন্য কর্মমুখী আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি ঘোষণার পর এই প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে।
বেফাক ও আল হাইয়াতুল উলয়ার কর্ণধারগণ এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন এই প্রত্যাশাই করি।
লেখকঃ এমফিল গবেষক, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর