শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মাওলানা সাদকে নিয়ে দেওবন্দের শঙ্কার ব্যাখ্যা দিলেন ৩ আলেম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু: তাবলিগ জামাতের অন্যতম মুরব্বি ও দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে ঘিরে চলমান সংকটের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।  এতে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ, তেমনি উদ্বেগ বাড়ছে উলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিমের মনে।

দারুল উলুম দেওবন্দসহ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের উলামায়ে কেরামের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাবলিগ জামাত নিয়ে উদ্বেগ দিনে দিনে উৎকণ্ঠায় পরিণত হচ্ছে। সমাধানের পরিবর্তে আরও জটিল হচ্ছে সমস্যা। ক্রমশ কঠোর অবস্থানের দিকে যাচ্ছেন উভয় পক্ষ।

একদিকে মাওলানা সাদের অনুসারীগণ যেমন ‘হজরতজিকে না মানলে দেওবন্দ মানি না’ বলার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, অন্যদিকে তাকে ঘিরে আরও বড় ধরনের ফেৎনার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কোনো কোনো উলামায়ে কেরাম।

গত ৩১ জানুয়ারি দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদ কান্ধলভির রুজুনামার ব্যাপারে যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাতে এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আমরা মনে করি, আকাবিরদের চিন্তা ও আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যূতিও তীব্র ক্ষতির কারণ। মাওলানাকে অবশ্যই নিজ বয়ানে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পূর্বসূরীদের পথ এড়িয়ে শরিয়তের ভাষ্য থেকে নিজস্ব (মতমতো) ইজতিহাদের এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে হবে। কেননা মাওলানার এই মূলচ্যূত ইজতিহাদ দেখে আমাদের মনে হচ্ছে, আল্লাহ না করুন! তিনি এমন একটি দলের সৃষ্টি করছেন, যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত; বিশেষত আমাদের পুণ্যাত্মা পূর্বসূরীদের মতাদর্শ বিরোধী হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আকাবির-আসলাফের পথের ওপর অবিচল রাখুন।’

দারুল উলুম দেওবন্দের এ ঘোষণা উলামায়ে কেরামের ভেতর নতুন ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামও এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বরাবরের মতো এবারও তারা দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, মাওলানা সাদ কান্ধলভির উচিৎ দীনি কাজের ব্যাপারে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে আকাবির ও আসলাফের পথে ফিরে আসা।

কাকরাইল শুরার অন্যতম উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ">মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের কাছে জানতে চেয়েছিলাম উলামায়ে কেরাম কেনো দারুল উলুম দেওবন্দের মতামতকেই অগ্রাধিকার দেন এবং তাদের কথার উপর বরাবর আস্থা রেখে যাচ্ছেন?

তার ভাষায় এর কারণ হলো, দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অবদান। দারুল উলুম উপমহাদেশের ইসলামি শিক্ষাকে পুনর্জীবন দান করেছিলো। বৃটিশদের হাতে মুসলিম শাসন অবসানের পর এদেশের ইসলাম, মুসলিম ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি রক্ষা পেয়েছে দারুল উলুম দেওবন্দের অবদানে।

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দারুল উলুম উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে আসছে এবং তা কুরআন-সুন্নাহ ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসৃত মূলনীতির আলোকেই। এজন্যই দারুল উলুম দেওবন্দের উপর উলামায়ে কেরামের এতো আস্থা।

তার কাছে আরও জানতে চেয়েছিলাম, দারুল উলুম দেওবন্দ কেনো এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলো? তিনি বলেন, এ আশঙ্কার কারণও দারুল উলুমের বিতৃতিতে আছে। তাহলো, বার বার রুজু করা এবং পুনরায় স্বমতে ফিরে আসা; এমনকি তা প্রচার করা।

দ্বিতীয়ত আকাবির ও আসলাফের অনুসৃত পদ্ধতি এড়িয়ে মুজতাহিদসুলভ কাজ করা।
দেশের প্রখ্যাত আলেম সাংবাদিক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, তাবলিগ জামাতের অন্যতম কেন্দ্রীয় মুরব্বি মাওলানা সাদ সাহেব কেন বড়দের সাথে মানিয়ে চলতে পারছেন না, এ প্রশ্ন আজ বিশ্বের সকল চিন্তাশীল আলেমের। তিনি যেভাবে চিন্তা করছেন সেটি কতটুকু সঠিক, এ ফায়সালা তিনি নিজে না নিয়ে বড়দের কাছে এর ভার ছেড়ে দিলেই ভালো করতেন।

সম্ভবত তিনি তার যে কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে এ কাজটি যথারীতি করতে পারেন নি।
মাওলানা নদভী মনে করেন, এসব তাফাররুদাত, একান্ত ব্যক্তিগত বক্তব্য বা পছন্দ হিসাবে কোনো ব্যক্তি ধারণ করতে পারে। কিন্তু যদি তিনি একটি বড় জামাতের চালিকাশক্তি হন তখন তাকে বড়দের পদ্ধতিই ধরে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, সাধারণ আহলে ইলমরা যে মত পোষণ করেন, যে ঐতিহ্য লালন করেন, যে ভাবধারা বিস্তার করেন এর বাইরে তার যাওয়া চলবে না। তাকে স্পষ্ট বলতে হবে, এসব আমার ব্যক্তিগত পছন্দ বা বক্তব্য। আমি শতবছরের চলমান ধারা বা ঐতিহ্য ভাঙার অধিকার রাখি না।

প্রাজ্ঞ এ আলেম ও সাংবাদিক আরও বলেন, নিজের উস্তাদ, মুরব্বি ও সমকালীন আহলে ইলমদের স্বাভাবিক আস্থাটুকু অর্জন ছাড়া এ কাজের দায়িত্ব এককভাবে নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়ার চিন্তা অন্তত দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ঝুঁকির কথাই দারুল ‍উলুমের বিবৃতিতে উঠে এসেছে।

দেশের শীর্ষ আলেম ও শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ মনে করেন দারুল উলুম দেওবন্দের পূর্বের ঘোষণা ও এবারের ঘোষণার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।

তাহলে আবার কেনো বিবৃতি দিতে হলো? ‘কারণ, আগেরটা এতো বেশি স্পষ্ট ছিলো না। ফলে কেউ কেউ প্রচার করছিলেন দারুল উলুম মাওলানা সাদ কান্ধলভির উপর আস্থা রেখেছেন। কিন্তু বিষয় তেমন নয়। এজন্য নতুন ঘোষণার প্রয়োজন হলো।’-বলেন মুফতি মিযান সাঈদ।

এ ঘোষণার নতুনত্বও তিনি তুলে ধরেন, ‘নতুন দিক হলো, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদা বিরোধী কোনো নতুন দলের তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ। এটিই উলামায়ে কেরামের ভয়ের মূল জায়গা।’

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ মনে করেন, যেহেতু আগের ও পরের ঘোষণার মর্ম এক। তাই বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর আলেমগণ পূর্বের অবস্থানেই থাকবেন। অর্থাৎ তারা সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা এবং মাওলানা সাদসহ তার মতাদর্শী আলেমদের বুঝিয়ে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করে যাবেন।

মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দারুল উলুম দেওবন্দের মতো মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে অনুরোধ করবো তিনি যেনো তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসেন এবং তাবলিগ জামাতে নতুন কোনো ফিরকায় পরিণত না করেন। সাথে সাথে কাকরাইল শুরার উপদেষ্টা আলেমদের কাছে আমার দরখাস্ত থাকবে তারা যেনো কাকরাইলের করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ উভয়ে জানিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে খুব শিগগির উলামায়ের একটি বৈঠক হতে পারে।

‘রুজুর পর পুনরায় ভুল করে বসেন মাওলানা সাদ’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ