শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


এরদোয়ান কি এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সিরিয়ার মানবিজ শহরে হামলা চালানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি কড়া সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তুর্কি সীমান্ত থেকে মানজিব ৪০ কিলোমিটার এবং দেশটির পূর্বাঞ্চল আফরিন থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই আফরিনেই কুর্দি মিলিশিয়াদের হয়ে অভিযান চালাচ্ছে মার্কিন বাহিনী।

তিনি বলেছেন, ‘লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন ওলিভ ব্রাঞ্চ চলবে। সন্ত্রাসীদের (কুর্দি যোদ্ধা) হাত থেকে আমরা মানজিব মুক্ত করব। ইরাক সীমান্তে একজন সন্ত্রাসীও থাকা পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চলবে।’

মূল বিষয় হলো- আফরিনের মতো মানজিব শুধু কুর্দি অধ্যুষিত নয়। বরং সেখানে জাতিগত (যেমন-আরব, সারকাসিয়ান ও চেক) বৈচিত্র্যতা রয়েছে। ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বাঞ্চলে সিরিয়া সীমান্তে কুর্দিদের সাথে মার্কিন বাহিনী কী উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করছে, সিরিয়ার মানজিব শহরে তুরস্ক একটি হামলা চালালেই সে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। অঞ্চলটি আরবরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেখানে রয়েছে শক্তিশালী জাতিগত বন্ধন।

মধ্যযুগ ও সুলতান সালাহ-আল-দীনের সময়ের ওপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলের কুর্দিদের ঐতিহাসিকভাবে কুর্দি বলে পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে বৃহৎ আরব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুর্দিদের একীভূত হওয়ার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না।

মানবিজে কুর্দিরা যেটুকু সফলতা অর্জন করেছে তা নস্যাৎ করা তুরস্কের জন্য যে তেমন কঠিন হবে না এবং তা করতে গেলে মার্কিন বাহিনী যে সংঘর্ষে জড়িয়ে যাবে তা সহজেই বলা যায়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে।

আফরিনের দখল নেওয়া তুরস্কের উদ্দেশ্য নয়। বরং আঙ্কারার উদ্দেশ্য হলো-কুর্দিরা পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে রজোভা প্রদেশ পর্যন্ত যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তা ভণ্ডুল করে দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফরিনে তুর্কি অফিযান কষ্টসাধ্য হবে। আর তুরস্কও বুঝতে পারছে, আফরিন দখল করে তাদের লাভ নেই। কারণ এটি অনিরাপদ পার্বত্যাঞ্চল, সেইসঙ্গে কুর্দি বিদ্রোহী অধ্যুষিত।

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত ক্যাভুতোগ্লু শুক্রবার বলেছেন, ‘কুর্দিদের হঠানোর পর আমরা ওই অঞ্চলকে তাদের প্রকৃত মালিক তথা সিরিয়ার কাছে হস্তান্তর করব। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি আরবদের বুঝিয়েছেন।

রাশিয়ার পরিকল্পিত খেলা এখানে ব্যাপক কাজ দিচ্ছে। বিশেষ করে, বন্ধুত্বের পরিভাষা অনুযায়ী তুরস্ক, আফরিনের কুর্দি ও দামেস্কের কাছে একক অবস্থানে রয়েছে মস্কো। রাশিয়া সম্ভবত এটাই চাচ্ছে যে, তুর্কি বাহিনী আফরিনে তাদের অভিযান সফল করে মানবিজের দিকে অগ্রসর হোক, এর ফলে সিরিয়া সরকারের জন্য ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সহজ হবে।

তুরস্ক ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যদি তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তারা তা করবে। তুরস্কের উপ-প্রধানমন্ত্রী বেকির বোজদাগ, যিনি সরকারের মুখপাত্রও, মার্কিন প্রশাসন পেন্টাগনকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘যারা সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন করবে তারা এই অভিযানে টার্গেটে পরিণত হবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’

তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিন আলী ইলদিরিমও এ ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বড় দেশের বড় বাহিনী ও সম্ভাবনা আছে, তাদের কি সন্ত্রাসী সংগঠন দরকার আছে? এটি স্পষ্ট বৈরিতা। এর পেছনে যেই থাকুক, তার শক্তি যত বেশিই হোক কিংবা তার নাম যাই হোক তুরস্ক এটি মেনে নিবে না।’

এটা নিশ্চিত যে, ওয়াশিংটনের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে আঙ্কারা এবং কোনো প্রকার ছলনার সুযোগ দিচ্ছে না। আর ট্রাম্প প্রশাসনও ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার তুর্কি প্রেসিডেন্টের ‍মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিনের সঙ্গে শুক্রবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। আলোচনায় তিনি তুরস্কের এই অভিযানকে ‘বৈধ স্বার্থ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং সিরিয়ার কুর্দিদের আর কোনো অস্ত্র সরবরাহ না করার কথা বলেছেন।

শুক্রবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র ফোনালাপের পর এ ধরনের প্রস্তাব দিলেন ম্যাকমাস্টার। কুর্দি সমস্যায় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের ইতিহাস রয়েছে। এর ১০ দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এক বিতর্কিত বক্তেব্যে বলেন, সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত থাকবে এবং তুর্কি সীমান্তে ৩০ হাজার সদস্যের কুর্দি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে পেন্টাগন। টিলারসনের এই বক্তব্যই মূলত থেরেসাকে এরদোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহিত করে।

তবে এই পর্যায়ে, যখন তুর্কি বাহিনী স্থল যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, এসে কোনো ধরনের সমঝোতা তত্ত্বে যাওয়া এরদোয়ানের জন্য খুব সামান্য ও বিলম্বিত হবে। কারণ কুর্দিরা কোনো ধরনের বাঁধা ছাড়াই তুরস্কে রকেট ছুড়ছে। তাছাড়া পিকেকে (মার্কসপন্থী কুর্দি যোদ্ধা) যোদ্ধারা সরাসরি মার্কিন কমান্ডের অধীন নয়। অবশ্য এরদোয়ান ম্যাকমাস্টারের আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং অভিযোগ করে বলেছেন, কুর্দি যোদ্ধাদের হাতে হাতে এখনও মার্কিন অস্ত্র রয়েছে।

এদিকে, শনিবার তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মানজিব থেকে অনতিবিলম্বে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা উচিত।

এখন তুরস্কের এই দাবি যদি যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেয় তাহলে তা হবে পেন্টাগনের জন্য খুবই অপমানের। আর তা না করে উপায়ই বা কী?

লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে ইতোমধ্যে একটি চুক্তি করে ফেলেছেন এরদোয়ান। কুর্দিদের দুর্বল করতে তুরস্ক যে অভিযান চালাচ্ছে, মস্কো অনানুষ্ঠানিকভাবে তা মেনে নিয়েছে। মস্কো ও আঙ্কারা দুইয়ের জন্যই এটি লাভজনক।

রাশিয়া মনে করছে, তুর্কি বাহিনী যদি মার্কিন মিত্র কুর্দিদের পতন ঘটাতে পারে তাহলে সিরিয়ায় যে মার্কিন পলিসি কাজ করছে তা কানাগলিতে গিয়ে ঠেকবে। তাছাড়া রাশিয়ার মেইমিম ঘাঁটিতে গত ৫ জানুয়ারি হামলার ব্যাপারে ওয়াশিংটনকে যে মূলহোতা হিসেবে মনে করছে মস্কো, সেক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ওই ঘটনার ব্যাপারে বলেছেনও যে, মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্ক নষ্ট করতে পরিকল্পিতভাবেই ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

২০১৫ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয় তখন থেকেই ‍তুকি-মার্কিন সম্পর্কে আস্থাহীনতা শুরু হয়। তারপরও সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় তুর্কি সীমান্তে আমেরিকান সেনাদের উপস্থিতি সহ্য করেছে আঙ্কারা। অবশ্য এত কিছুর পরও সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহারের স্পষ্ট দাবি তুরস্ক করতে পারবে না, কারণ দেশটি ন্যাটোর সদস্য।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কুর্দিদের সঙ্গে মিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থ হয় কিংবা উত্তর সিরিয়ায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে (ইরানের অব্যাহত অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে) না পারে অথবা আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর নীতির কারণে স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর অনির্দিষ্টকালের উপস্থিতির কি যৌক্তিকতা আছে?

অর্থাৎ কুর্দি যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ এবং তাদেরকে দেওয়া মার্কিন সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে এরদোয়ান এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন। আর পুতিনও সেটা আঁচ করতে পারছেন।

এদিকে, তেহরান ও দামেস্কের কাছে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে উঠেছে, যাতে সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতি দিতে এরদোয়ানকে এগিয়ে নেয় পুতিন। সূত্র: এশিয়া টাইমস/ পরিবর্তন ডটকম।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ