সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
বাংলা ভাষায় বানানের ক্ষেত্রে আজকাল পরিবর্তন ও ভুলের যে ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে, তা এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। একেক জায়গায় একেক ধরনের বানান লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির বানান অভিধান থাকলেও পরিস্থিতি উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অবশ্য বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, পুরানো প্রতিষ্ঠিত বানান বাতিল করে আনন্দবাজার পত্রিকার বানানবিধির আলোকে নতুন বানান চাপিয়ে দিয়ে বাংলা একাডেমি ভাষা-ব্যবহারকারীদের বিশেষ বানান সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত করছে। যে কারণে তাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কোনটি ‘শুদ্ধ’ এবং কোনটি ‘অশুদ্ধ’ বানান।
অনেকেই ছোটবেলা থেকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যে বানানে বাংলা লেখা শিখে এসেছে, বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতিতে তার কিছু পরিবর্তন এসেছে। অথচ এর সঙ্গে পরিচিত নয় অনেকেই, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রান্তি।
প্রকৃতঅর্থে, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে একটি সুনির্দিষ্ট ভাষানীতি অনুসরণ করা না হলে এই বিভ্রান্তি থেকেই যাবে। বলতে চাচ্ছি, স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলা একাডেমি এবং সরকার যদি বলে- এই হচ্ছে আমাদের বানানরীতি এবং স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই রীতিই চলবে, তাহলেই এই বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব হতে পারে।
এক্ষেত্রে মনে রাখা চাই, ভাষার রীতিনীতি যাই থাকুক না কেন সাধারণ মানুষ ভাষা এবং বানান শেখে মূলত চর্চার মাধ্যমে। আর সেখানেই ঘাটতি থেকে গেলে সেটি থেকে উত্তরণও কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলা একাডেমি এবং বিশেষজ্ঞরাও একমত, বাংলা বানান নিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে সেটিকে ঠেকাতে উপযুক্ত শিক্ষা এবং সরকারি উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই।
‘ঈদ’ বানান কী? ‘ঈদ’ না-কি ‘ইদ’- তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি তুমুল কথার লড়াই হয়ে গেল। বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ‘ঈদ’ শব্দটির ভুক্তি রয়েছে দুটি। এর মধ্যে একটি লেখা হয়েছে ‘ঈ’ ব্যবহার করে, অন্যটি ‘ই’ ব্যবহার করে।
তবে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ঈদের বিকল্প বানান ‘ইদ’ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এক সময় হয়তো ‘ইদ’ বানানটিই সবাই মেনে নেবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদের ‘ঈ’-কে ‘ই’ করার কী দরকার ছিল? আবহমানকাল থেকেই ঈদকে ‘ঈ’ দিয়ে লেখা হচ্ছে। তাছাড়া ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক কি ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক?
এবার বানান-সমস্যার ক্ষেত্রে প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রতিবর্ণীকরণের সঙ্গে বানান-বিধিকে গুলিয়ে ফেলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ঈদ ও নবী বলব, না-কি ইদ ও নবি বলব এ সমস্যার জন্ম সেখানেই। উদাহরণ হিসেবে ইংরেজি শব্দের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিবর্ণ উল্লেখ করছি- s = স; sh = শ; sion = শ; tion = শ।
এক ‘শ’-কে কতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে! তবে আমি মনে করি, বাংলা বানানের মূল সমস্যাগুলো হলো ই, ঈ, উ, ঊ-কার যুক্ত শব্দগুলোকে নিয়ে, ক্রিয়ার কিছু কথ্য রূপ নিয়ে, ‘ঙ’ এবং অনুস্বারের ‘ং’ ব্যবহার নিয়ে, শব্দের শেষে বিসর্গের ‘ঃ’ প্রয়োগ নিয়ে, দন্ত্যন মূর্ধণ্য নিয়ে, ও-কারের প্রয়োগ নিয়ে, বিদেশি শব্দের বাংলা রূপ নিয়ে।
যেমন- বাড়ি পাখি লিখব, না বাড়ী পাখী? কি অথবা কী? পুজো ধুলো লিখব না পূজো ধূলো? ‘হইত’ বোঝাতে কী লেখা উচিত- হত, হতো, না হোত? করলাম খেলাম গেলাম, না করলুম খেলুম গেলুম, অথবা করলেম খেলেম গেলেম? বাংলা লিখব, না বাঙলা? বাঙালি, না বাঙ্গালি?
এবার বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান রীতি ও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি। প্রাণী, ঈ কার দিয়ে লেখা হচ্ছে; কিন্তু প্রাণিবিদ্যা, ই-কার দিয়ে লেখা হচ্ছে। আবার, শ্রেণি লিখতে প্রথম ভুক্তিতে লিখেছে শ্রেণি। ২য় ভুক্তিতে লিখেছে শ্রেণী। এভাবে, শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণীসংগ্রাম। ‘প্রাণী’ বানানে ঈ-কার লেখা গেলে ‘শ্রেণি’ বানানে ই-কার কেন? ঈ-কার লেখা যাবে না কেন?
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ করে হয়েছে, ‘সকল অতৎসম শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের চিহ্ন ব্যবহৃত হবে। যেমন : বাঙালি, ইংরেজি, উনিশ, আরবি। তবে কোনও কোনও স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।’
কিন্তু ‘রানি’ বানানের ভুক্তিতে প্রথমেই আছে রানি, তারপরে আছে রানী। এক্ষেত্রে ‘রানি’ বানানটিকে অধিকতর প্রমিত বলে ধরা হলে, ‘কোনও কোনও স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী’- এই নিয়মের কোনও যৌক্তিকতা থাকে কি?
প্রমিত বানানের নিয়মে উল্লেখ আছে, ‘তৎসম শব্দে ট, ঠ, বর্ণের পূর্বে ‘ষ’ হয়। যেমন- বৃষ্টি, দৃষ্টি, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশি শব্দে এই ক্ষেত্রে ‘স’ হবে। যেমন- স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিও, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট।’
‘কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ‘ষ্ট’ দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে।’ বিপরীতে, অভিধানে উল্লেখ আছে ‘খ্রিস্ট’। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে ‘পাঠ্যপুস্তকের বানানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকায় বানানটিকে অপরিবর্তনীয় রাখা হয়েছে।’
প্রশ্ন হলো, ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ বাংলা একাডেমিকে অনুসরণ করবে না-কি বাংলা একাডেমি ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’-কে অনুসরণ করবে? নিয়ম যদি ‘খ্রিষ্ট’ হয় তবে অভিধানে ‘খ্রিস্ট’ লেখার আদৌ দরকার আছে কি? ব্যবহারিক অভিধানে নামায, আযান, রমযান, ওযু, যোহর শব্দগুলো লেখা হয়েছে নামাজ, আজান, রমজান, অজু, জোহর।
প্রশ্ন হচ্ছে, নিয়ম অনুযায়ী ‘য’ ব্যবহার করার কথা থাকলেও ‘জ’ ব্যবহার করা হয়েছে কেন? অভিধানে দেখানো হয়েছে ‘জাদু’ ও ‘যাদু’ শব্দ দুটি ফারসি শব্দ হতে আগত। তাদের অর্থও একই। যেমন- কুহক, মায়া, তন্ত্রমন্ত্র, আকর্ষণ; উপভুক্তি হলো- জাদুকর ও যাদুকর, জাদুবিদ্যা ও যাদুবিদ্যা। কিন্তু ‘জাদুগর’ থাকলেও ‘যাদুগর’ উপভুক্তি নেই কেন? জাদুঘর আছে কিন্তু যাদুঘর নেই কেন?
আবার, বিদেশি শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে ‘অ্যা’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : অ্যান্ড (and), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, অ্যাটর্নি, অ্যাকাউন্ট। তাহলে, ‘একাডেমি’ উচ্চারণ কেন অ্যাকাডেমি হলো না? নিয়মে যাই বলা হোক না কেন অভিধানে অ্যাকাডেমি ও একাডেমি শব্দ দুটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে কি বিভ্রান্তি বাড়েনি? (১৮তম সংস্করণ, ৭৭ পৃষ্ঠা)
বাংলা একাডেমি তার ‘পরিমার্জিত সংস্করণের মুখবন্ধ ও ব্যবহারবিধি’ মোতাবেক কোনও শব্দের একাধিক বানান থাকলে সুপ্রচলিত ও নির্বাচিত বানানবিশিষ্ট শব্দটি সর্বপ্রথম এবং অন্যান্য বানানবিশিষ্ট শব্দগুলো উক্ত মানানুযায়ী পরস্পর কমাসহ লিখতে হবে। যদি তাই হয়- বাংলা একাডেমি তার অষ্টাদশ সংস্করণের ১০৬০ পাতায় কেন উল্লেখ করেছে- ‘লেঠা, ল্যাঠা, লেটা’; অর্থাৎ প্রথম ভুক্তি হলো লেঠা। প্রশ্ন, নিয়মে ‘ল্যাঠা’ থাকলে অভিধানে কেন ‘লেঠা’ থাকবে? প্রথমেই ‘লেঠা’ উল্লেখ করে বাংলা একাডেমি ‘ল্যাঠা’ বানানের নিয়মকে অগ্রাহ্য করেনি? একইভাবে এসেছে চ্যাং, চেঙ, চ্যাঙ। তাহলে কোনটি শুদ্ধ? ‘চ্যাঙ’ অধিকতর শুদ্ধ হলে তা ভুক্তিতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি কেন?
অপরদিকে, অতৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেননি। একটি মতে বলা হয়েছে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা।অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট, ন্ঠ, ন্ড, ন্ড হবে। যথা : ঘণ্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ডভন্ড।
উল্লেখ্য, ঘণ্টা, লণ্ডভণ্ড শব্দগুলো সংস্কৃত শব্দ হলেও কীভাবে অ-তৎসম শব্দের বানানে অন্তর্ভুক্ত হলো? ‘অঙ্গ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত অঙ্গ থেকে। {স. অঙ্গ+অ (অচ)}। ‘অঙ্গন’ শব্দটিও এসেছে সংস্কৃত অঙ্গ থেকে। {স. অঙ্গ +অন (ল্যুট)}। আবার, ‘বঙ্গ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত বঙ্গ থেকে। {স.বঙ্গ}। উভয় ক্ষেত্রে মূল সংস্কৃত শব্দ (অঙ্গ ও বঙ্গ)। উভয় ক্ষেত্রেই ‘ঙ্গ’ আছে।
তাই, অঙ্গ ও বঙ্গ বানানটি এভাবেই এসেছে। কিন্তু ব্যবহারিক অভিধানে ‘আঙ্গিনা’ শব্দটি এভাবে উল্লেখ আছে; আঙ্গিনা, আঙিনা, আঙ্গন। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত অঙ্গন থেকে {স. অঙ্গন>}। অর্থাৎ অঙ্গ+ন = অঙ্গন। অপরদিকে, বাঙালি শব্দটির ভুক্তিতে উল্লেখ আছে ‘বাঙালি, বাঙালী’। উৎস সংস্কৃত {স. বঙ্গ > + আলি/আলী}।
আবার, ব্যবহারিক অভিধানের কোথাও ‘হইত’ (চলিত রূপ ‘হতো’) পাওয়া যায়নি। যেমন : পরিশ্রম করা হইত, অর্থ প্রদান করা হইত ইত্যাদি বাক্যগুলোকে চলিত ভাষায় লেখা যায় এভাবে পরিশ্রম করা হত, অর্থ প্রদান করা হত। কিন্তু, এক্ষেত্রে সমস্যা হলো ‘হত’ শব্দের অর্থ নিহত, মৃত, বধপ্রাপ্ত, ব্যাহত, লুপ্ত ইত্যাদি।
এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য হইত অর্থে ‘হতো’ লেখা অধিকতর যুক্তিযুক্ত নয় কি? যেমন : পরিশ্রম করা হতো, অর্থ প্রদান করা হতো ইত্যাদি। বাংলা একাডেমি আমাদের এরকম আরও উদ্ভট নিয়ম ও বিভ্রান্তিতে রেখেছে। আর সময়ের প্রয়োজনেই এসবের একটা ইতি টানা উচিত।
শুধু কয়েকটি অভিধান রচনা আর সাময়িকী প্রকাশ করে দায়িত্ব শেষ করা যেতে পারে না। বরং বাংলা ভাষা ও বানানে চলমান নৈরাজ্য বন্ধ করতে প্রয়োজন পরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং সমন্বয়করণ; প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও ভাষার ব্যবহারে সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাংলা বানান ও উচ্চারণে। লেখার ক্ষেত্রে বানানের ভুলভ্রান্তি অনেকটা আশঙ্কাজনক।
কথ্য ভাষায় উচ্চারণ এবং বিকৃতি নিয়ে যেমন বিতর্ক রয়েছে, তেমনি বানানের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিও ব্যাপক। চারদিকে যেন চলছে বাংলা ভাষা বিকৃতির উৎসব। পথে নেমে কান পাতলেই শোনা যায় বিকৃত বাংলা উচ্চারণের কথোপকথন। আর এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে বিকৃতির ফলে বাংলা ভাষা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
রাস্তার দু’পাশের সাইনবোর্ড, ব্যানার, দেওয়াল-লিখন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বাংলা লেখার হাল দেখলেই এই দুরবস্থা চোখে পড়বে।
তবে বানান নিয়ে সব ভুলভ্রান্তি যে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে তা-ই নয়। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডেও দেখা যায় ভুল বানানে লেখা। যেখানে বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বানানরীতি এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে না।
বাংলা একাডেমি এখন একাডেমি শব্দটি হ্রস-ই কার দিয়ে লিখলেও সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন শিশু একাডেমী কিংবা শিল্পকলা একাডেমী কিন্তু এখনও দীর্ঘ-ঈ কার দিয়েই বানান করে যাচ্ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু আইনগত জটিলতাও রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন দোকান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে, ফেস্টুনে কিংবা পোস্টারে অহরহই ভুল বানান দেখা যায়।
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ভুল বানানে লেখাগুলো হাস্যরসের খোরাক যোগাচ্ছে। এর কারণ কী? হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার প্রতি অবহেলা, বানান নিয়ে অসচতেনতা।
ভাষা ও বানানের শুদ্ধ চর্চার অভাব বলেই কোথায় ‘কি’ লিখব আর কোথায় ‘কী’ লিখব তা নিয়েও অনেকেই সন্দেহে ভোগেন। এক্ষেত্রে আমাদের চর্চা বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত, সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ রূপে স্বতন্ত্র পদ হিসেবে ব্যবহৃত হলে ঈ-কার বসবে। যেমন : কী আর বলব? (আর কোন কথাটি বলব)- সর্বনাম। ছবিটা কী রকম লাগল? (ছবিটা কেমন লাগল)- ক্রিয়া বিশেষণ। কী করে এ কথা বললে! (কেমন করে এ কথা বললে)- ক্রিয়া বিশেষণ।
অপরদিকে, অব্যয় পদরূপে ব্যবহৃত হলে ‘কি’ শব্দটি ই- কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? (প্রশ্নবোধক, উত্তর হবে হ্যাঁ/না বোধক) বেটা নবাব আর কি! (প্রায় তদ্রুপ অর্থে)। বলো কি! তার এ কাজ? (বিস্ময় প্রকাশক উক্তি)। কত কি দেখব কালে কালে! (বহু কিছু বা নানা কিছু অর্থে)। আবার, কি না/ কিনা/ কি-না- এসবের ব্যবহারেও অনেকে ভুল করেন।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ‘কি-না’ : অশুদ্ধ। ব্যবহার করা যাবে না। ‘কি না’ : ১. সন্দেহসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : টাকা দেবে কি না জানি না। ২. বিতর্কসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমার লেখায়কোনও ভুল আছে কি না বলো? ৩. প্রশ্নবোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : তুমি যাবে কি না?
বর্তমানে তরুণদের বাংলা বানানে তেমন তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। বলা যায়, মোবাইলের এসএমএস, ফেসবুকসহ যোগাযোগের নানা মাধ্যমে বাংলাকে ইংরেজি বর্ণে লেখার যে প্রচলন চলছে, তা প্রমিত বাংলা ভাষার জন্য অশনি সংকেত।
অবশ্য বিটিভি এবং সরকারি বেতার এখনও অনেকটাই মান ধরে রাখলেও এফএম বেতারগুলো আঞ্চলিক ভাষার সুযোগ নিয়ে বিকৃত উচ্চারণে বাংলা ভাষার কবর রচনা করছে।
তবে একথাও সত্য যে, ১৯৯৯ পরবর্তী সময়ে দেশে বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতার এসে সেই মানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারল না। টেলিভিশন ও এফএম বেতার উভয়ক্ষেত্রেই বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে একটি ভাষা তৈরি হলো। এফএম রেডিও তাদের উপস্থাপকদের দিয়ে মিশ্র ভাষার ব্যবহার করতে থাকে। বাংলা এবং ইংরেজি কোনও ভাষাই যে তারা শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারছে তা নয়। তাদের উচ্চারণ ভঙ্গির জন্যকোনওকোনও শব্দ তার নিজস্ব অর্থ হারিয়ে ফেলে।
অনেকে মনে করেন, এফএম রেডিওর উপস্থাপকদের ভাষা-ভঙ্গি এক কথায় জঘন্য, আপত্তিকর। এখানে ভাষাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। এই বিষয় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি কিছুই। এটা পরিবর্তন করার মূল দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের। তারা যদি চায় যে আমরা অশুদ্ধ বা বিকৃত করে ভাষা ব্যবহার করব না, তাহলে এখানে যারা কাজ করছে তারা পরিবর্তন হতে বাধ্য।
সমস্যা আরও আছে। যেমন : ১. হিন্দি চ্যানেলগুলোর চটকদার অনুষ্ঠান (প্রধানত হিন্দিতে তর্জমাকৃত জাপানি কার্টুন ডোরেমন) দেখে দেখে শিশুরা হিন্দি বলা শিখে যাচ্ছে যদিও শুদ্ধ করে ইংরেজি বলতে- লিখতে পারছে না (হিন্দি শুদ্ধ করে বলছে কি না সে প্রশ্ন অবশ্য কেউ করছে না)।
২. বিশেষ কিছু নাট্যকার এবং নাটক-প্রযোজক-পরিচালকরা তাদের চরিত্রের মুখে ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ঢঙে উচ্চারিত, ইংরেজি শব্দ-মিশ্রিত বিকৃত ভাষা বসিয়ে দিচ্ছেন। পরিচালক-প্রযোজকেরা সেই সব নাটক চিত্রায়নের ব্যবস্থা করছেন।
৩. বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বাংলা শব্দের পরিবর্তে অনুষ্ঠানের নামকরণে ‘টক শো’, ‘মিউজিক শো’, ‘নিউজ আপডেট’, ‘নাইট শো’, ‘মেগা সিরিয়াল’, ‘প্রাইম নিউজ’, ‘হেলথ লাইন’ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে। আবার অনুষ্ঠান সঞ্চালকেরাও বাংলিশ ভাষায় কথা বলছে।
৪. কিছুসংখ্যক সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী আনন্দবাজার পত্রিকার বানানরীতি চালু করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে বাংলা শব্দের বানান লিখছেন যার ফলে শুদ্ধ আর অশুদ্ধ বানানের মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
৫. কয়েকটি পত্রিকা বাংলা ব্যাকরণকে বিকৃত করছে। যেমন, ১লা বৈশাখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি বা ৭ই মার্চ না লিখে এরা হিন্দির অনুকরণে যথাক্রমে ১ বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ৭ মার্চ লিখছে।
৬. বাংলা একাডেমি পুরানো প্রতিষ্ঠিত বানান বাতিল করে আনন্দবাজার পত্রিকার বানানবিধির আলোকে নতুন বানান চাপিয়ে দিচ্ছে। ৭. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হচ্ছে ইংরেজিতে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানোই হচ্ছে না। বাংলায় পাঠদানের সময় প্রমিত বাংলা বলেন না এমন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও বিরল নন। তাছাড়া সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় তরুণ প্রজন্মকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়ার ফলে তারা বাংলায় দুর্বল হয়ে গেছে। এরাই ইংরেজি ঢঙে ও ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে বাংলা বলছে।
৮. বাংলাদেশের সংসদে প্রমিত বাংলার চর্চা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ সদস্যের বাংলা উচ্চারণে আঞ্চলিকতা লক্ষ করা যেতে পারে। এক সংসদ সদস্যার বক্তৃতায় ‘চুদুর-বুদুর’ শব্দটির ব্যবহার সংসদে ব্যবহৃত ভাষায় আঞ্চলিক শব্দমিশ্রণের অন্যতম প্রমাণ।
৯. সরকারি প্রতিষ্ঠানেই মানা হয় না প্রমিত বানানরীতি। বাংলা একাডেমি, এনসিটিবি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলিয়ে সরকারিভাবে আছে তিন রকমের বানানরীতি। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের বানানরীতিও ওই তিন প্রতিষ্ঠান মানে না।
এর কারণ কী? বলা যায়, আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসহ আরও অনেক বিষয় সম্পৃক্ত এক্ষেত্রে। যেমন : একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে প্রকৃতিগতভাবেই অনেক কিছু শেখে। সমস্যা হয় যখন সে স্কুলে যায়।
অনেক শিক্ষক বাংলা শব্দ দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য শেষ করেন না। তারা বাক্যের মধ্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ শিক্ষকই এই প্রবণতায় আক্রান্ত। ফলে শিশুরা বিভ্রান্ত হয়।
বাংলা ভাষার এই বিকৃতি থেকে পরিত্রাণ পেতে শিক্ষক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করি। বলতে চাচ্ছি, একেবারে শুরু থেকেই আসতে হবে সব। বাচ্চাদের ইংরেজি বানান ভুল লিখলে যেমন শাসন করে শেখানো হয়, ঠিক তেমনি বাংলা বানান ভুল হলেও শাসন করে শেখানো উচিত। তাদের সুন্দর বাংলা বলা, লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করা উচিত। এ ব্যাপারে লেখকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। লেখকদের সুন্দর ভাষায়, সুন্দর বর্ণনায় লেখা বাঞ্ছনীয়।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালত ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে টেলিভিশনে বিকৃত উচ্চারণে এবং ভাষা ব্যঙ্গ করেকোনও ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করার নির্দেশ দেন।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান, সংস্কৃতি সচিব, তথ্য সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সব বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওর প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি এ অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করা হয়।
স্বপ্রণোদিতভাবে (সুয়োমটো) দেওয়া ওই আদেশে আদালত বলেন, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দ চয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে- সে বিষয়ে সুপারিশ দিতে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি করার আদেশ দেন আদালত।
কমিটি ২০১৩ সালের মাঝামাঝি একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে পাঠিয়েছে বলে জেনেছিলাম। তারপর? তার কি আর কোনও পর নেই?
উল্লেখ্য, গত মার্চে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বেসরকারি এফএম রেডিওতে ভাষার বিকৃত উচ্চারণ রোধকল্পে বাংলাদেশ বেতারের একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খুব একটা সুফল মিলছে না। আর এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।
ঢাবিতে আন্দোলন: দ্রুত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন
কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
এসএস/