শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘মেসবাহ কামালের বক্তব্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
বার্তা সম্পাদক

পূর্ব বাংলার মুসলিম শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশ সরকার প্রতিষ্ঠিত সরকারি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের আরও উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করা ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য।

এজন্য পুরো বাংলা অঞ্চলে মাদরাসাগুলো ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত। বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ অধিভূক্ত করতে পারতো মাত্র ৫ মাইল পর্যন্ত।

কিন্তু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। নানা অজুহাতে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে নানা সময়ে। আইনতভাবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বাধাগ্রস্থ করতে না পেরে অনেকেই টিভি-টকশো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ প্রকাশ করছেন প্রসঙ্গে ও অপ্রসঙ্গে।

তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।

গত ২৭ জানুয়ারি শনিবার প্রেসক্লাবে পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাদরাসা এডুকেশন ইন বাংলাদেশ শিরোনামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীরা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যারা সুযোগ পাচ্ছে তাদের ৬০ ভাগ মাদরাসা শিক্ষার্থী। কলেজ পড়ুয়ারা সেই হারে কলেজ শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না। এজন্য তিনি মাদরাসায় অধিক হারে নম্বর প্রদানকে দায়ী করেন।

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল আরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর মাদরাসায় পরিণত হয়েছে এবং এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এ হারে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলে এক সময় দেশ তাদের হাতে জিম্মি হতে পারে বলেও তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেন।

বক্তব্যে প্রফেসর মেসবাহ কামাল মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ইংরেজির জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার মতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ইংরেজির জ্ঞান ক্লাস ফোর-ফাইভ মানের। তাদের অংশগ্রহণের ফলে দেশের উচ্চ শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। প্রফেসর মেসবাহ কামালের এ বক্তব্যে আহত হয়েছেন দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদগণ। তারা মনে করছেন, মেসবাহ কামালের এ বক্তব্য সাম্প্রদায়িক ও উদ্দেশ্যপ্রসূত। এ বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রফেসর মেসবাহ কামাল যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাতে বিস্মিত হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিলো মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য। এ দেশের মুসলিম শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করতে। সেখানে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যদি অধিক পরিমাণ সুযোগ পায় সেটাই হবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বরং বিভিন্ন সময়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে যে বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে সেটা ছিলো অনৈতিক। কেননা সরকার মাদরাসাকে সমমান দিয়েছে এবং সাংবিধানিকভাবে শিক্ষার অধিকার সমান।’

একইভাবে তার উদ্বেগকে বিদ্বেষপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সহযোগী অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, প্রফেসর মেসবাহ কামালের বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটেছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উদ্বেগের কি আছে? তারা নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই তো ভর্তি হচ্ছে।

ড. খালিদ মনে করেন, মেসবাহ কামাল তার বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কেননা তার বক্তব্যে প্রমাণ হয় দেশের প্রচলিত শিক্ষার মান সমান নয়; এবং সরকার যে সমমান দিয়েছে তা যথার্থ নয়।

ড. আবুল কামাল আজাদও মনে করছেন, প্রফেসর মেসবাহ কামাল তার বক্তব্যের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে খাটো করেছেন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বোর্ডগুলোর পরীক্ষার উপর আস্থা না রেখে নিজেরা ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। তারা দাবি করছে তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি যথার্থ এবং এর মাধ্যমে মেধাবীদের নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু তার বক্তব্যে প্রমাণ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাবি সঠিক নয়। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়।

ড. খালিদ প্রফেসর মেসবাহ কামালকে প্রশ্ন করে বলেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নম্বর ৯০ থেকে শুরু হয় তা কোন পরিসংখ্যানে পেলেন? কিসের ভিত্তিতে এ কথা বললেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি নম্বর পায়। তাই বলে কি সেখানে ৯০ থেকে নম্বর শুরু হয়?

ড. আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ ইতিবাচক। কারণ, সরকার শিক্ষার দুটি লক্ষ্য ঘোষণা করেছে তাহলো, ক. নৈতিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা, খ. আধুনিক শিক্ষা বিস্তার করা। এ দুটি সমন্বয় রয়েছে মাদরাসায়। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা নৈতিক গুণসম্পন্ন বেশি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ড. আবুল কালাম আজাদ ও ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন উভয়ে মনে করেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা এ দেশেরই সন্তান। তাদেরকে পেছনে ফেলে দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। আর মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যে অধিক পরিমাণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাচ্ছে সেটা দেশের ব্যবস্থার উন্নতিরই ফল। সুতরাং উদ্বিগ্ন না হয়ে তাদের স্বাগত জানানো উচিৎ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ