শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আইয়ূব বিন মঈন : লেখক গড়ার নিপুণ কারিগর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইলিয়াস সারোয়ার

যে কোন বিষয়ে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের পূর্ব শর্ত হল, সে বিষয়ে ব্যক্তির অদম্য আগ্রহ অার প্রবল স্পৃহা ৷ যে বিষয়ে যার আগ্রহ যত বেশি, সে ওই বিষয়ে তত বেশি যোগ্যতা অর্জন করতে পারে৷ ব্যক্তির আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষার সামনে সকল বাধা আর প্রতিকূলতাই তুচ্ছ হতে বাধ্য৷

আগ্রহী ব্যক্তির কাছে উদ্দিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান কখন কীভাবে এসে ধরা দেয়, অনেক সময় সে নিজেও তা টের পায় না৷ অবশেষে একদিন সে ভাবতে বাধ্য হয়- 'আশ্চর্য! আমার মত লোকের পক্ষে এ কী করে সম্ভব হল'!

ব্যক্তির অদম্য আগ্রহ অার প্রবল স্পৃহা থেকেই সৃষ্টি হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার৷ আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাগুলোই যখন বৃষ্টির ফোঁটার মতো একত্রিত হয় একস্থানে, তখন তা শক্তিশালী বন্যার রূপ ধারণ করে৷ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিগুলো তখন ভাবতেই পারে- আরে! আমার মত এই তুচ্ছ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর মাধ্যমেই তো এই বিশাল বন্যার সৃষ্টি! যতটা ভেবেছিলাম, ততটা ছোট আমি নই দেখছি!'

হ্যাঁ! আজকের আলোচনা তেমনই এক ব্যক্তি ও তার কর্মকে কেন্দ্র করে, যিনি তাঁর অদম্য আগ্রহ, প্রবল স্পৃহা আর নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে আজ বটবৃক্ষের আকার ধারণ করে অনেক নবীন-তরুণকে ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷

ছড়া-কবিতা, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রম্য ও ব্যঙ্গ রচনা, আরবি-উর্দু-ফার্সি থেকে অনুবাদ; প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তাঁর সদর্প বিচরণ ৷ স্বীয় নামযুক্ত রচনাসংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও মানের বিচারে তাঁকে একধাপ এগিয়ে রাখতে হবে নির্দ্বিধায়৷

সৃজনশীলতা তাঁর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য৷ এদিক-সেদিক থেকে কিছু লেখা বাছাই করে সংকলনধর্মী 'রচনার' মত সাধারণ কাজে তিনি নিজেকে জড়াননি৷ নিজের জন্য এমন কাজই বেছে নিয়েছেন, যা সাধারণত অন্যরা করেন না বা করতে পারেন না৷ তিনি সবার প্রিয় লেখক মাদরাসা দারুর রাশাদের সাবেক শিক্ষক আইয়ুব বিন মঈন

বগুড়া জেলার শেরপুর থানাধীন বিশালপুর ইউনিয়নের বিরাপৈর গ্রামে তাঁর জন্ম (১৯৭০ ইং) ও বেড়ে ওঠা৷ অঁজপাড়া এই গায়ে পাঠোপকরণ পাওয়ার চিন্তাই করা যায় না তখন৷ একটি বই সংগ্রহ করতে তাঁকে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হত৷

দৈনিক বা মাসিক পত্রিকা তো মোটেই পেতেন না৷ হাট শেষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লাযুক্ত টুকরো কাগজগুলো কুড়িয়ে পরিষ্কার করে ওগুলো পড়তেন তিনি৷ পড়তেন দর্জির কাছ থেকে পাওয়া নতুন লুঙ্গির ভেতর থাকা পুরনো পত্রিকাগুলি৷

এমনই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিল তার প্রচেষ্টগুলো৷ আর এগুলোর সমষ্টিতেই আজ তিনি নামে-বেনামে-অন্যের নামে (?) মানোত্তীর্ণ প্রায় ৫০ টি গ্রন্থের লেখক ৷

ছড়া-কবিতা দিয়েই তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি৷ এখন খুব কম লিখলেও যারা তাঁর আগের ছড়া-কবিতাগুলো দেখেছেন, তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, আইয়ূব বিন মঈনের অন্যান্য লেখার তুলনায় কবিতাপ্রতিভা বেশি শক্তিশালী৷

যতদূর জানি, কওমি অঙ্গনের কোন লেখকের লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ অদ্যাবধি কোন পাঠ্যপুস্তকে স্থান পায়নি৷ আইয়ূব বিন মঈন এখানেও অনন্য৷ 'উপদেশ' শিরোনামে তাঁর একটি কবিতা দুই দু'টি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের ৫ম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে স্থান করে নিয়েছে৷

এক. স্বনামধন্য নাদিয়াতুল কুরআন বোর্ড৷ দুই. বাংলাদেশের সবচে' বেশি প্রায় ১২০০ মাদরাসা নিয়ে গঠিত উত্তরবঙ্গের বোর্ড- তানজিম৷

লেখকের সফলতা-ব্যর্থতা বিচার করতে হয় তার কালের নিরিখে৷ 'সত্যের বিজয়' আইয়ুব বিন মঈনের পাঠকপ্রিয় একটি উপন্যাস৷ এটি যখন প্রকাশ হয়, বাজারে তখন অনেক উপন্যাস পাওয়া যেত, যেগুলোতে শুধু শাব্দিক ইসলাম বিদ্যমান বটে, কিন্তু চরিত্র ছিল ইসলাম বিরোধী৷

এগুলোর লেখকেরা উপন্যাসের নায়িকাকে বোরকা পড়ায় বটে, সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ প্রেমসহ অশ্লীলতায়ও লিপ্ত করে দেয়৷ ধার্মিক পরিবারের বাস্তব চিত্র সেগুলোতে ফুটে ওঠে না৷ বইয়ের কাটতি বাড়াতে বাস্তবতার পাশাপাশি কল্পনার মিশেলে তারা কলূষিত জীবন উপস্থাপন করে৷

আইয়ুব বিন মঈন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷ শরীয়তের গণ্ডির ভেতরে থেকে পাঠককে ধরে রাখার এক জাদুময় আকর্ষণ আছে তাঁর 'সত্যের বিজয়ে'৷ একটু পড়লে পুরো কাহিনী শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের আর নিস্তার নেই৷

সর্বোপরি বলতে হয়, এই ধাঁচের কোনো উপন্যাস তখন বাজারে ছিল না৷ এর মাধ্যমে তিনি নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেছেন৷

অনেকে মনে করেন, ইসলামের গণ্ডির ভেতরে থেকে কোনো উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা কামনা করা বোকামি ৷ কিন্তু আইয়ূব বিন মঈন তাঁর 'সত্যের বিজয়ের' মাধ্যমে তাদেরই বোকা বানিয়ে দিলেন৷ তাঁর 'মুহাম্মদ বিন কাসিম' ও 'মগের মুল্লুক' উপন্যাস দুটিও এর ব্যতিক্রম নয়৷

মাসিক আদর্শ নারীতে তাঁর ধারাবাহিক রচনা 'শয়তানের সংসদ' পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল৷

বাস্তবতার ভিত্তিতে কল্পনার মিশেলে তৈরি তাঁর এ রচনায় ইতিহাসের পাশাপাশি উঠে এসেছে তখনকার প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সুস্পষ্ট চিত্রাবলী৷

এ জাতীয় রচনায় চরিত্রের ভেতর দিয়ে অনেক সময় এমন অনেক কথা বলে ফেলা যায়, যা কোন প্রবন্ধ কিংবা কলামে বলা যায় না৷ এ সুযোগের দারুণ সদ্ব্যবহার করেছেন আইয়ূব বিন মঈন৷

বর্তমান সময় থেকে প্রায় ১ যুগ আগে মাসিক রহমতে তাঁর ধারাবাহিক শিক্ষামূলক রচনা ছিল 'ভাষা শিক্ষার আসর'৷ বাংলা ব্যাকরণের দুর্বোধ্য নিয়মাবলী এত আকর্ষণীয় ও সহজভাবে দ্বিতীয় কেউ উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি৷ অভাবনীয় পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছেন তিনি এই 'ভাষা শিক্ষার আসরের' মাধ্যমে৷

ভাষা শিক্ষা বিষয়ক কোন বিভাগও কোন মাসিক পত্রিকায় ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি৷ এমনকি কেউ হয়ত কল্পনাও করেনি, এমন একটা বিভাগ থাকলে পত্রিকার কাটতিও বাড়বে! তাই বলাই যায়, এই ধারারও প্রবর্তক আইয়ূব বিন মঈন৷

পরে অবশ্য এটি বই আকারেও ছেপে এসেছে৷ সেই সময় থেকে অদ্যাবধি হাজার-হাজার নবীন-তরুণ এ থেকে উপকৃত হয়েছে, হচ্ছে এবং সুদূর ভবিষ্যতেও হতে থাকবে৷ কেননা এত সহজে ব্যাকরণের সুকঠিন নিয়মাবলী আত্মস্থ করতে 'ভাষা শিক্ষার আসরের' কোন বিকল্প নেই৷

মাসিক আল-আমানাহ পত্রিকায় 'ভিন্ন ধারা' নামে তিনি লিখেছেন আরও একটি নতুন ধারার ধারাবাহিক লেখা৷ অতি সাধারণ আর তুচ্ছ বিষয়কে কল্পনার মিশেলে কী করে তিনি একটি মনোরম গল্প উপস্থাপন করতেন, তা কেবল তিনিই জানতেন! এমনকি কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, এই সাধারণ একটি কথা বা শব্দ থেকে তৈরি হয়ে যেতে পারে দারুণ এক গল্প৷

শুধু গল্প বললেও ভুল হবে৷ এগুলো যে সত্য ঘটিত ঘটনাও! ভিন্নধারার গল্পের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- কেউ চাইলে এ গল্পগুলোকে লেখকের আত্মজীবনীও বলতে পারেন৷ কেননা প্রতিটি গল্পই আবার তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ৷ এই গল্পগুলো পাঠককে যেমন প্রিয় লেখক সম্পর্কে জানতে পারা ও নির্মল সাহিত্যের আনন্দ দিয়েছে, তেমনি আবার কখনও তাঁর অনাকাংক্ষিত কষ্টের বর্ণনায় অশ্রুতে চোখও ভিজিয়েছে পাঠক৷ আইয়ূব বিন মঈনের স্বার্থকতা এখানেই৷

মাসিক রাহমানী পয়গামের নিয়মিত একটি বিভাগ ছিল 'কলমের পয়গাম'৷ এ বিভাগে পাঠক সাহিত্য সংশ্লিষ্ট নানান প্রশ্ন করতেন৷ আইয়ূব বিন মঈন এসবের দিকনির্দেশনামূলক সন্তোষজনক জবাব দিয়ে এসেছেন দীর্ঘ দিন৷

এছাড়া উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত মাসিক ফুলদানিতে 'ঘষামাজা' আর পাক্ষিক আমাদের মুক্ত আওয়াজে 'ফিরে দেখা' নামে ধারাবাহিক লিখতেন তিনি৷ দুটোরই বিষয় ছিল এক৷ বিগত মাসের/পক্ষের প্রকাশিত পত্রিকার বিভিন্ন লেখার উপর দারুণ পর্যালোচনা পেশ করতেন তিনি৷

কেবল সমালোচনা বা নিছক ভুল ধরা নয়, সঙ্গে সযত্নে তিনি উল্লেখ করতেন এ লেখাটি এভাবে না লিখে কীভাবে লিখলে আরও ভাল, আরও স্বার্থক, আরও সুন্দর হত৷ এ থেকেও নবীন-তরুণরা লেখালেখি শেখার মত দারুণ খোরাক পেত৷

দুঃখের বিষয় হল- পত্রিকা দু'টির একটিও এখন আর প্রকাশিত হচ্ছে না৷ পত্রিকার পাঠক এখন অনেকটাই অনলাইনমুখী হয়ে গেছে৷ যে টাকা দিয়ে তারা আগে মাসিক পত্রিকা কিনত, সেই টাকা দিয়ে এখন তারা ইন্টারনেটের প্যাকেজ কিনে৷ সাহিত্যের খোরাকটাও অনলাইনেই পেতে চায়৷

কিন্তু সেখানে যে আইয়ূব বিন মঈনরা নেই!  সেই খোরাক মিলবে কীভাবে! তিনি যদি অনলাইনে সক্রিয় হতেন কিংবা তাঁর লেখাগুলো অনলাইনে পাওয়া যেত তবে অনলাইন প্রজন্মও অনেক লাভবান হত৷ নতুন অনেক প্রতিভাবান লেখক সৃষ্টি হত৷

কিন্তু সমস্যা হল, আইয়ূব বিন মঈন ব্যক্তিগতভাবে নিভৃতচারী৷ লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে চান বলে সমসাময়িক অন্যান্যদের মত অত সভা-সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেন না৷ করলে হয়ত জনপ্রিয়তায় অন্য অনেককে ছাড়িয়েও যেতে পারতেন৷

আইয়ূব বিন মঈনের আরেকটি দুর্বলতা হল- তার অধিকাংশ লেখাই কল্পনা নির্ভর৷ একজন ভাল আলেম হওয়া সত্ত্বেও তার কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ভিত্তিক লেখা খুব একটা চোখে পড়ে না৷ হয়ত মনগড়া তাফসির/ব্যাখ্যা হয়ে যাওয়ার ভয়েই এসব এড়িয়ে চলেন তিনি৷ কিন্তু এখানেও যে অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে!

আইয়ূব বিন মঈন মূলত লেখালেখি করেছেন কিছু মিশনকে সামনে রেখে এবং সেই মিশনে সফলও হয়েছেন৷ তাঁর অন্যতম প্রধান মিশন ছিল, নতুন লেখক তৈরি করা, লেখকদের আরও সচেতন করা৷ ইসলামি বলয়ে ক'দিন আগেও লেখক সংকট ছিল প্রবল৷ আর এখন অসংখ্য লেখক৷ এরা যে দু' চারজনের হাতে গড়ে ওঠেছেন, আইয়ূব বিন মঈন তাঁদেরই অন্যতম৷

কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আইয়ূব বিন মঈন পেয়েছেন কিছু সম্মাননাও৷ মাসিক রাহমানী পয়গামের পক্ষ থেকে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) 'র উদ্যোগে সারাদেশের ৩০০ লেখক থেকে বাছাইপূর্বক মাত্র ৫ জনকে দেয়া হয়েছিল এই সম্মাননা ৷

১. মাসুদ মজুমদার ২. দেওয়ান আজিজুর রহমান ৩. আবুল হাসান শামসাবাদী ৪. আইয়ূব বিন মঈন ৫. লাবীব আব্দুল্লাহ ৷ এছাড়া মাসিক আদর্শ নারীর পক্ষ থেকেও সারা দেশের বাছাইকৃত ২০ জন লেখককে দেয়া হয়েছিল সম্মাননা ক্রেস্ট ৷ তন্মধ্যে আইয়ূব বিন মঈনের অবস্থান ছিল ৩য় ৷ ১ম মাসুদ মজুমদার আর ২য় ছিলেন ড. গোলাম রব্বানী ৷

আনন্দের বিষয় হল, দীর্ঘ দিন পরে হলেও মহান এ ব্যক্তি অনলাইনে সক্রিয় হয়েছেন৷ সামাজিক যোগাযোগের সবচে শক্তিশালী মাধ্যম ফেইসবুকে 'ঘষামাজা' নামে গ্রুপ খুলে শিক্ষনীয় বিষয়াদি তুলে ধরছেন নিয়মিত ৷ তাঁর এই নেয়ামতকে আমাদের গনিমত মনে করা উচিৎ৷

নবীন-তরুণদের লেখালেখি শুদ্ধির যে প্রচেষ্টা আবিম (এ নামেও তিনি পরিচিত) চালিয়ে যাচ্ছেন, সেটি অব্যাহত থাকুক! তাঁর প্রতি রইল আন্তরিক শুভকামনা ৷

লেখক: মারকাযুল খিদমাহ আল-ইসলামিয়্যাহ হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ

আরআর


সম্পর্কিত খবর