বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


মানুষের নীতি ও নৈতিকতাবোধ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানব জীবনের সকল পর্যায়ে নৈতিকতার বিধানকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। নৈতিকতাই মানুষের জীবনের সব দিক ও বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানব জাতির সহজাত মৌলিক প্রবৃত্তি ও মনোবৃত্তিই হলো নিয়ম-কানুন।

একদিক থেকে মানুষ প্রকৃতির অংশ বা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। সুতরাং ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা বহাল রাখতে এবং মহৎ জীবনের অনুসন্ধান করতে হলে প্রাকৃতিক নিয়ম ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।

ধর্মীয় বিধি-বিধান বা নিয়ম-কানুন মেনে চলা ও রক্ষা করা থেকেই নীতি, মূলনীতি বা প্রণালী অর্থাৎ নিয়মের মূলতত্ত্ব ও উপাদানই নীতি। ইসলামের রীতিনীতির প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা।

অর্থাৎ নিয়ম থেকে নীতি, আর নীতি থেকে নৈতিকতা। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে নৈতিকতার বিধানগুলো সর্বাঙ্গীন সুন্দরভাবে বিধৃত আছে। মানুষকে যে ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে বিরত রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘তোমারই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আর্বিভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

মানুষের নৈতিক চেতনা বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামাজিক জীবন ও প্রতিষ্ঠানাদি যেমন, নৈতিক চেতনাও তেমনি ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। যেমন-শুরুতে আদিমানবের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি মূল্যবোধক চেতনা ছিল খুবই অস্পষ্ট।

এ পর্যায়ে যুক্তি বিচারের চেয়ে অন্ধ প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগ ছিল প্রবল; আর এ প্রবৃত্তি ও আবেগের বশবর্তী হয়েই মানুষ তখন যাবতীয় কাজ ও ভালো-মন্দের বাছ-বিচার সম্পন্ন করতো। এখানে নীতিবোধ ও মূল্যবোধের চেয়ে প্রয়োজন ও আত্মস্বার্থই মুখ্য ছিল। প্রকৃতির রাজ্যে যা কিছু আছে, এর সবগুলোতেই ব্যক্তি দাবি করতো অবাধ অধিকার।

এমন ভাবনা থেকেই সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে সচেষ্ট থাকতো। এ অবাধ প্রতিযোগিতা থেকে স্বাভাবিক কারণেই মানুষে মানুষে কলহ-বিবাদ ও হানাহানি শুরু হতো, যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে যেত। দুনিয়াতে অশান্ত যুদ্ধাবস্থা সার্বক্ষণিক চলতে থাকে; ফলে ক্রমশ সর্বত্র যে কারো আকস্মিক মৃত্যুর আশংকা ছড়িয়ে পড়ে।

এহেন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে সবল, দুর্বল কারো মধ্যেই ছিল না শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ। ফলে সকলের নিরাপত্তার স্বার্থেই সম্পাদিত হয় সামাজিক চুক্তি এবং প্রণীত হয় প্রয়োজনীয় সব নিয়ম-কানুন। এভাবে আদিম মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষার প্রয়োজনবোধ থেকেই সূত্রপাত ঘটে নৈতিক চেতনা। এ থেকেই ক্রমশ গড়ে ওঠে নীতিবিদ্যার মৌলিক বিধি-নিয়ম।

নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও গুণাবলির দর্শন অর্থাৎ জীবন দর্শন। মানবজীবনকে সুপথে ভালোকাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা একটি প্রশিক্ষণ। এটা শেখার জন্য ব্যবস্থা, অনুশীলন ও চর্চার প্রয়োজন।

মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, উদারতা, ন্যায়পরায়নতা, সভ্যতা, সাধুতা, অখন্ডতা, একত্রতা, পূর্ণতা সর্বোপরি সচ্ছতা, জবাবদিহিতা চরিত্র মহত্ত্ব ও আদর্শিক গুণাবলির সংমিশ্রিত আত্মশুদ্ধির ফসল হচ্ছে নৈতিকতা। জীবন চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি নৈতিকতা মানুষের জীবনের স্বচ্ছতার দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনে দেয়।

তাই মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণকেই নৈতিকতা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতামাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)

নৈতিকতা আত্মার অস্তিত্বের ও আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে নিবেদিত ও উৎস্বর্গীকৃত। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ও প্রধান অবলম্বন নৈতিকতা অর্জন। নৈতিকতা অর্জন ব্যতিরেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নির্মূল করা করা কখনও সম্ভব নয়। নৈতিকতা সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্মমতার আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সাহসী ও প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

নৈতিকতা হলো আত্মশুদ্ধি বা আত্মার মুক্তি ও শান্তি। মানবিক গুণাবলি বিকশিত হওয়ার একমাত্র পথ নৈতিকতা। মানুষের জীবন গড়ার মাধ্যম হলো নৈতিকতা। জাতির সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই নৈতিকতা। সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে রুচিশীল, নীতিবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে কাতারবদ্ধ হতে হবে।

মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অবক্ষয় রোধে রাসূলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষণা করেছেন, ‘আর অবশ্যই তোমরা মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকবে, কেননা মিথ্যা অবশ্যই অনৈতিক কাজের দিকে পরিচালিত করে, আর নিশ্চয়ই অনৈতিক কাজসমূহ জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় নৈতিকতা অনস্বীকার্য। কারণ ইসলাম হচ্ছে একটি বাস্তবসম্মত ধর্ম। সর্বক্ষেত্রে মানুষের নৈতিকতা চর্চার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইসলাম বিশ্বমানবতার কল্যাণে নৈতিকতার মানদন্ডস্বরূপ।

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, মানবজাতির নিয়ামত, সীমাহীন গুণে গুণান্বিত, অনুপম ও মহান চরিত্রের অধিকারী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ছিল মানবপ্রেমে ও নৈতিকতায় ভরপুর।

মানবতার সামনে নীতি ও নৈতিকতার উন্নত আদর্শ হিসেবে আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম আদর্শের প্রতীক হিসাবে আল্লাহর নবী যে আগমন করেছেন তা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমাকে উন্নত নৈতিকতার মর্যাদা সহকারে প্রেরণ করা হযেছে।’ (ইবনে মাজা)

কিন্তুু দুঃখের বিষয়, দেশে আজ সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে। নৈতিক সংকটের আবর্তে ক্লিষ্ট ভাগ্যাহত মানুষের জীবনের পরতে পরতে একটা সত্য অবিরত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায়, তা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণীর মধ্যে আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে গ্রহণ করতে পারলে পৃথিবীটা প্রকৃত সুখের ও শান্তিময় হয়ে উঠতো।

নৈতিকতা সেই তাগাদা ও মহান শিক্ষা নিয়ে আসে। তাই নৈতিকতা বিশ্বাসের, আত্মপ্রত্যয়ের ও আত্মোপলব্ধির চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি ও প্রতিশ্রুতি। মানুষ তার সমকালীন প্রথা প্রচলনকে নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ এবং যুক্তির আলোকে সংশোধন করতে পারে।

এভাবে প্রচলিত প্রথার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে মানবসভ্যতা। নবী করিম সা.  নৈতিকতার মহিমা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার কাছে অধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক থেকে অধিক নিকটবর্তী সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি)

মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয় পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। আর তাই নিজে বাঁচ, অন্যকে বাঁচতে দাও, দুষ্কর্ম ছেড়ে সদাচরণের পক্ষে এসো- এসব প্রাথমিক নীতির ভিত্তিতেই রচিত হয় আদিকালের নৈতিক মানদণ্ড।

দিকে দিকে বিশ্বায়নের যে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, এর একটা প্রভাব নৈতিকতার ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে নানারকম ভেদ-বিভেদের মধ্যেও অনেকেই বিশ্বজনীন নৈতিক চেতনার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের ঐক্য ও সদ্ভাব-সম্প্রীতির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

যারা পারস্পরিক সদ্ভাব, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা প্রদর্শন করেছে, তারাই প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে এবং তীব্র প্রতিযোগিতামূলক জীবন সংগ্রামে টিকে থেকেছে।

পরিবার ও গোত্রীয় পর্যায়ের নৈতিকতার মধ্য দিয়ে নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ অন্যান্য প্রাণীর প্রবৃত্তিমূলক নির্বিচার জীবনের পর্যায় অতিক্রম করে ক্রমশ অধিকতর সংহত নৈতিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছে।

নৈতিক মূল্যবোধ সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে প্রাণের পরশ জাগায়। সর্বক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয় চলছে; তাই নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই- ইসলাম এটাই শিক্ষা দেয়।

লেখক: পরিচালক, এশিয়ান ইনস্টিটিউট। সম্পাদক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি বার্তা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউট অব ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ। dr.munimkhan@yahoo.com

এসএস/


সম্পর্কিত খবর