বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


রক্তনদী পেরিয়ে কুরআন পাঠ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তাজুল ফাত্তাহ

মক্তব পড়া শেষ হলে আমার এক উস্তাদ বললেন, তুই কিতাব খানায় পড়, ভালো আলেম হবি।

আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি তো হাফেজ হব। হেফজ খানায় পড়ব।

তিনি বললেন, তুই হাফেজ হতে পারবি না।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, কে বলেছে পারব না? আমাদের এলাকার মিরাজ আলীর এক পা নেই লেংরা। সে হাফেজ হয়েছে। তাকে মাদরাসার মাহফিলে পাগড়ি দিল। দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। তখন থেকে আমার আগ্রহ আমিও হাফেজ হব- হাফেজ হলে আমাকেও পাগড়ি দিবে। আমাকেও মানুষ কত আদর করবে। ওই ছেলের পা নেই সে হাফেজ হয়েছে। আমার তো পা আছে আমি হাফেজ হতে পারব না কেন?

হুজুর আমার কথা শুনে হাসলেন- এইটা তুই বুঝবি না।

আমি দেরি না করে সরাসরি হেফজখানার হুজুরের সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভরসা দিলেন- তুমি পারবে।

পরদিন মিষ্টি নিয়ে গিয়ে বিপুল উৎসাহে হেফজ পড়তে শুরু করি ওই হুজুরের কাছে।

নেত্রকোনার কেন্দুয়ার এক মাদরসা। সাল ১৯৯৬। আমার এতো উৎসাহ থাকলে কি হবে- গ্রামের মাদরাসা হওয়ায় পড়াশুনা নেই। নেই কোন নিয়ম-কানুনও। কিছুদিন পর বাধ্য হয়েই মাদরাসা পাল্টাই। নতুন প্রতিষ্ঠান-নাজিরপুর মাদরাসা। এখানেও কিছু দিন থাকার পর বুঝলাম, এটাও সেই আগের মতই। পড়ার পরিবেশ সামান্য। এখানে থেকে দশ বছরেও হাফেজ হতে পারব না।

মাদরাসা যে রকমই হোক উস্তাদের কথার ওপর আমার আস্থা ছিল অবিশ্বাস্য। উস্তাদজি বলেছিলেন, লজিং বাড়ির কখনো বদনাম করতে নেই। ভাল হাফেজ হতে পারবি না তাহলে। এই কথা সব সময়ই আমার মাথায় থাকত। সমস্যা হল, যে বাড়িতে আমাকে লজিং দেওয়া হয় ওই বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। দিন আনে দিন খায়। অতি সামান্য উপার্জন। একজন লোক। সদস্য অনেক বেশি- আটজন।

প্রথম দিন আমাকে দেওয়া হল শুকনো আটার রুটি। সঙ্গে কী ছিল ঠিক মনে নেই। আমি সামান্য মুখে তুলেই বুঝতে পারলাম অতি অখাদ্য। বিস্বাদ। কোন রকম খাবার সামনে নিয়ে হাজিরা দিই।

প্রতিদিন তিন বেলা লজিং বাড়ি যাই, মাদরাসায় আসি। কিন্তু পেটে কিছুই পরে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমি অস্থির। এক দিন দুই দিন তিন দিন। তৃতীয় দিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় হঠাৎ নামাজের ভেতর অজ্ঞান হয়ে পরি। সবাই আমাকে ধরে মাথায় পানি ঢালে। ভাবে, কঠিন কোন রোগ হয়েছে আমার। মৃগি ব্যারাম কিংবা জ্বিন ভূতের আছর। বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাকে।

বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে যাই আমি। মা আমার অভুক্ত থাকার বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন- তুমি কি এতোদিন না খেয়ে ছিলা?

মায়ের চাপাচাপিতে তার কাছে সব খুলে বলি। তিনি আমার কথা শুনে হতভম্ব। থাক, তোকে আর মাদরাসায় যেতে হবে না।

তখন একজন বললেন, চল তোকে ঢাকার মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেই। যাত্রাবাড়ী মাদরাসা। চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবি না কত বড় মাদরাসা। ইয়া বড় বড় দালান।

আমি যেন হাতে আকশের চাঁদ পেয়ে গেলাম। খুশিতে লাফ দিয়ে উঠি। চিৎকার করে বলি, মা আমি ঢাকা যাব। হাফেজ হব।

Image may contain: text

মা বাবা আমাকে ঢাকায় দিতে রাজি না হলেও বিপুল উৎসাহে আমি তার হাত ধরি। যদি হাফেজ হতে পারি!
যাত্রাবাড়ী মাদরাসার পাশেই কুতুবখালী এলাকাতে তার ছিল স্টীল নিকেল করার কারখানা। সারা দিন মেশিনের গড়গড় শব্দ। যেন কোন দানব গুংগাচ্ছে। সেই নিকেল কারখানা দেখে আমি অবাক- এটা আবার কী?

গ্রাম থেকে এসে ওই নিকেল কারখানায় উঠি। একদিন বিকেলে সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে এসে বলে, এবার তো যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ভর্তি শেষ রে, কি করি বল তো?

তখন তিনিই সিদ্ধান্ত দিলেন, এই বছর তুই কারখানায় কাজ কর আর আমার কাছেই পড়। সামনের বছর ভর্তি করিয়ে দেব। আর খবরদার বাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করলে কারখানার কথা বলবি না। বলবি মাদরাসায় পড়ছি।

আমি ঘাড় কাত করে রাজির কথা জানালাম। মনে মনে ভয় করলাম, আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে আগামী বছর যদি না আসতে পারি! এর চেয়ে একটা বছর কারখানায় পড়লেই তো হয়, কয়টা দিন আর। দেখতে দেখতেই চলে যাবে।

আমার বয়স তখন তের। নিজে কিছুই বুঝি না। ঐ হুজুর যা বলেন তাই আমার বুঝ।

সারা দিন কারখানায় কাজ করি। মেশিনের গড়গড় শব্দ। ময়লা কালিতে একাকার শরীর। শরীরজুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি। রাতে সামান্য কুরআন শরীফ নিয়ে হাজিরা দেওয়া। এভাবেই চলল আমার দিন। পুরোটা বছর।

বাড়ি থেকে আমার খরচের জন্য ওই কারখানার মালিকের কাছে নিয়মিত টাকা পয়সা পাঠাত। তখন ডাক বিভাগ বেশ শক্তিশালী। সেই টাকা আমার কাছে আসত না। সে-ই মহা আনন্দে ভাঙত। একদিকে আমাকে ফ্রি খাটাত, আরেক দিকে আমার বাড়ি থেকে পাঠানো চকচকে টাকা গুনত।

তার দিনকালে স্বর্গের ছোঁয়া লাগলেও সারা বছর আমার একটা চকলেট কিনে খাওয়ার স্বপ্নও পূরণ হয়নি। কোথায় পাব একটা চকলেট কেনার পয়সা?

দ্বিতীয় বছর ঈদের পর পর ভর্তির জন্য তার বাড়ি যাই। লোকটা আমাকে নিয়ে ঢাকা আসব আসব করে আসল না। আমাকে তার বাড়িতে রেখে দুই সপ্তাহ অযথা দেরি করিয়ে ফেলল।

দুই সপ্তাহ পর ঢাকা এসে আবারো ওঠলাম ওই নিকেল কারখানায়। কয়েক দিন পর ভনিতা করতে করতে সে বলে ওই পুরনো কথা- এ বছর ভর্তি শেষ। কি করি বল তো?

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বলে কি লোকটা? আরেক বছর কি আবার ফাও খাটাবে!
তখন আমি গোপনে একা একাই যাই যাত্রাবাড়ী মাদরাসায়।

মাদরাসার ভেতরে ঢুকে আমার চোখ ছানাবড়া। কত বিশাল মাদরাসা। সারি সারি বিল্ডিং। শত শত ছাত্র। কাউকে চিনি না। কত ব্যস্ততা তাদের! খোঁজ নিয়ে জানলাম আসলেই ভর্তি শেষ। কোটাও পূরণ হয়ে গেছে, জায়গা নেই। আবার আমার হাতেও নেই একটা পয়সা। মহা সাগরে পরে হাবুডুবু খেতে থাকি আমি।

এক ছাত্রকে হেফজ খানায় ভর্তি হওয়ার কথা জানালে সে পরামর্শ দিল, ওখান থেকে দশ টাকা দিয়ে ফরম কিনে ওই চার তলায় যান। হাফেজ আবদুস সাত্তার সাহেব আছেন। তিনিই ভর্তির কাজ করেন।

আমি চিন্তায় পরে গেলাম। ভর্তির দশ টাকা পাব কই? আমার হাতে তো এক টাকাও নেই।

কারখানায় কাজ করার সময় যে বাড়িতে খেতাম ওই বাড়ির খালাম্মার কাছে ছুটে যাই। খালাম্মাকে বলি- আমাকে দশটা টাকা দেন, ভর্তি হব। জানেনই তো লোকটা আমাকে ভর্তি করাতে চায় না। বাড়ি থেকে টাকা এলে আপনাকে দিয়ে দেব।

খালাম্মা খুশিমনে টাকা দেন। ভর্তির ফরম কিনি। কিতাব বিভাগের এক বড় ভাইকে ধরে সেটা পূরণ করি। আল্লাহর নাম নিতে নিতে উঠি চার তলায়, হাফেজ আবদুস সাত্তার সাহেবের কাছে, হিফজ খানায়।

চার তলায় উঠে দেখি হেফজ খানার সবগুলো দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে কোরআন তিলাওয়াতের গুমগুম আওয়াজ আসছে। শত শত ছাত্র একসঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত করছে। আমার মনের মধ্যে সেটা এক ধরনের ভয় তৈরি করল।

কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেই দেখি এক ছাত্র কি এক প্রয়োজনে বাইরে বেড়িয়ে এল। এই সুযোগে ভেতরে ঢুকে পড়ি। সরাসরি হাফেজ আবদুস সাত্তার সাহেবের কাছে। হাতে ফরম।

হুজুর আমার হাতে ফরম দেখেই গরম চোখে জিজ্ঞেস করলেন- কেন এসেছিস?
হুজুরকে খুশি করার জন্য মুখে হাসি টেনে বললাম- ভর্তি হব হুজুর।

আমার কথা শুনেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। যা বের হ। সাত ছবক শুনছি, বিরক্ত করবি না খবরদার। বেত নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি।

আমাকে দেখে হুজুরের রাগ করার তিনটি কারণ ছিল। প্রথম কারণ হচ্ছে, ভর্তির জন্য তার সাথে আগে কথা বলতে হয়, অনুমতি হলে ফরম কেনা। আমি কথা না বলেই ফরম কিনে ফেলেছি। শুধু তাই নয়, পূরণও করে নিয়ে এসেছি।

দ্বিতীয় কারণ, এখন ভর্তির সময় শেষ। কোটা পূরণ হয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে ছাত্র। বড়ই বিলম্ব করে ফেলেছি। তৃতীয় কারণ, এটা আবার সম্পূর্ণ পড়ার সময়। ডান বাম তাকানোর সময় নেই। চরম বিরক্ত তো হবেনই তিনি।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়লাম দুই রাকাত। দীর্ঘ মোনাজাত করলাম। আল্লাহ পথ দেখাও। সাহায্য কর।

পরদিন সকালে আবার যাই হুজুরের কাছে। যদি হুজুরের মন গলাতে পারি। তিনি কোন কথাই শুনলেন না আমার। আগের চেয়ে আরো বেশি রেগে গেলেন। আবারো ধমকে বের করে দিলেন আমাকে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদি। মসজিদে নফল পড়ি। আল্লাহ গো, হুজুরের মনটা গলিয়ে দাও।

আমি নিরাশ হইনি। তৃতীয় দিন আবার যাই। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। হুজুর রেগে গেলেন। বেত নিয়ে বের করে দিলেন। আমি হিফজখানার বারন্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। হঠাৎ কি প্রয়োজনে সেদিন হাফেজ এমদাদ সাহেব বের হয়ে এলেন। উঁচা লম্বা সুন্দর। অতি সুপুরুষ। দেহের মত মনটাও ছিল বিশাল। এই হুজুরের আরেকটি গুণ আছে, তিনি বইয়ের ভাষায় কথা বলেন। অতি শুদ্ধ বাংলায়। শুদ্ধ উচ্চারণে।

আমাকে কাঁদতে দেখে বললেন, কিরে বাপু! কাঁদছিস কেন?

হুজুরের এই প্রশ্নে আমি যেন মহা সুযোগ পেয়ে গেলাম। হু হু করে আরো জোরে কেঁদে উঠলাম। ভর্তির আবেদন করলাম তার কাছে।

Image may contain: text

তিনি বললেন- এই বিষয়টি সম্পূর্ণ হাফেজ আবদুস সাত্তার সাহেব হুজুরের হাতে। হেফজ খানার প্রধান শিক্ষক তিনি। এই হুজুর না চাইলে আমি হাজার বার বলেও লাভ নেই।

কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, এক কাজ কর- জোহর নামাজের পর আস। দেখি বড় হুজুরকে বলে কি করা যায়।
জোহর নামাজের পর যেয়ে দেখি হুজুরের পাশে এক মুরুব্বি বসা। গ্রাম থেকে এসেছেন। হুজুরের চাচা।

হুজুর ধমক দিতেই আমি আবারো কেঁদে ফেলি।

তখন হুজুরের চাচা জানতে চাইলেন- কি ব্যাপার আবদুস সাত্তার, ছেলেটি কাঁদছে কেন?

আর বলবেন না, গত তিন দিন ধরে এখানে আসে আর কাঁদে। খালি বলে ‘ভর্তি হব’।

ভর্তি নিয়ে নিলেই তো হয়। হুজুরের চাচা বললেন।

যাদের ভর্তি নিয়েছি তাদেরই তো আমি থাকার সিট দিতে পারছি না। বারান্দায়ও থাকার জায়গা নাই। এতো দিন পর কোত্থেকে না কোত্থেকে এসেছে, একে ভর্তি করি কেমনে?

চাচা আবার বললেন, যা হবার হয়েছে, ভর্তি নিয়ে নাও।

হুজুর বললেন, কয় পাড়া পড়েছিস?

ছাব্বিশ পাড়া।

পড় দেখি।

আমি বিসমিল্লাহ বলে গ্রাম্য সুরে পড়া শুরু করলাম। পড়লাম না তো গরম তেলে বেগুন ছুড়ে দিলাম।

পড়া শুনে ভয়ঙ্করভাবে রেগে গেলেন হুজুর।

ফাজিল, তুই মক্তবে ভর্তি হ। হেফজ খানায় তোকে কে আসতে বলেছে? আগে কুরআন শুদ্ধ কর। কুরআন শরীফই তো শুদ্ধ করে পড়তে পারস না। হেফজখানায় পড়বি কেমনে? যা এখান থেকে- আমার সময় নষ্ট করবি না খবরদার।

আরো কিছুক্ষণ ধমকিয়ে হুজুর এস্তেঞ্জা করতে উঠে চলে যান।

হুজুর বাইরে যাওয়ার সুযোগটি আমি কাজে লাগালাম। কেঁদে কেঁদে হুজুরের চাচার পায়ে ধরে ভালো করে বললাম- আপনি বললে আমাকে হুজুর ভর্তি করবে। আপনি দয়া করে একটু বলে দিন। আমি কয়েক দিনেই পড়া ঠিক করে ফেলব। আপনি না বললে আমি পা ছাড়ব না।

চাচার অনুরোধে হুজুর ভর্তির ফরমে স্বাক্ষর করলেন। তবে কঠিন কঠিন সব শর্ত দিলেন। সারা বছর বারান্দায় থাকতে হবে। শীতকালেও। কখনো খানা ফ্রী হবে না। কিনে খেতে হবে পুরো বছর। দুই দিন পর যদি বলিস টাকা নেই, খানা ফ্রী করেন। তখন কিন্তু পিটিয়ে মাদরাসা থেকে বের করে দেব।

আমি সব শর্ত মেনে নিয়ে বললাম- জী হুজুর, আমি রাজি।

মুখে মুখে রাজি হলেও দুশ্চিন্তায় তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, পকেটে আমার একটা টাকাও নেই। কীভাবে ব্যবস্থা করব তাও জানি না।

আমি ভেবেছিলাম দশ টাকা দিয়ে ফরম কিনেছি এটা দিয়েই আমার ভর্তির কাজ হয়ে যাবে। আর টাকা লাগবে না। কিন্তু ফরম জমা দিতে গিয়ে দেখি সবার হাতে হাতে টাকা।

টাকা কিসের? এক ছাত্রের কাছে জানতে চাই।

কেন ভর্তির জন্য। না থাকলে জলদি চারশ’ টাকা আনেন। বোর্ডিং এ খেলে আরো চারশ’ লাগবে।
হায় হায় এত টাকা আমি পাব কই?

আবারো ছুটে যাই সেই খালাম্মার কাছে। অনুনয় করে বলি- আমাকে আটশ’ টাকা দেন। আগামী মাসে বাড়ি গিয়ে আপনার টাকা এনে দেব। আমার অসহায়ের কথা চিন্তা করে খালাম্মার দয়া হলো। ছয়শ’ টাকা যোগাড় করে দিলেন। নিজের কাছে কিছু ছিল, আর কিছু ধার করে দিলেন। চারশ’ টাকা দিয়ে ভর্তি হই। দুইশ’ টাকা দেই বোর্ডিংএ। পনের দিনের খাবার।

আল্লাহর নামে ঠিক মত ক্লাস শুরু করলাম। বোর্ডিং থেকে খানা তুলি, খাই। আর সারাক্ষণ কুরআন পড়ি।
এভাবে ঠিক পনের দিন চলল। তারপর খাবার বন্ধ।

এখন কী করি? টাকা নাই, খানা বন্ধ। একথা হুজুর যেন না জানে। জানলে জানে মেরে ফেলবে। বের করে দিবে মাদরাসা থেকে।

হুজুর জেনে যাওয়ার ভয়ে বিষয়টি কাউকে বলি না। সামান্য কয় দিনে কারো সঙ্গে তেমন পরিচয়ও গড়ে উঠেনি। সকালে নাস্তার ছুটি হলে চার তলা থেকে নিচে নামি। হাউজ থেকে হাতের তালু ভরে পানি খাই। মসজিদে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে মিনতি করি। বাঁচাও আল্লাহ। মাফ করো আল্লাহ।

দুপুরে খাবারের সময় হলেও সেই একই কাজ করি। হাউজ থেকে কয়েক চউল পানি খাই। নামাজ পড়ি। বাঁচাও আল্লাহ।

রাতেও একই কাজ।

এভাবে না খেয়ে পুরোপুরি একদিন কাটল। দ্বিতীয় দিনও কাটল না খেয়ে। আট চল্লিশ ঘন্টা। তৃতীয় দিনও একই নিয়মে গেল। চতুর্থ দিন আর টিকতে পারছিলাম না।

প্রথম দিনটা ভালো কাটলেও দ্বিতীয় দিন থেকেই চোখ মুখে অন্ধকার দেখছি। চতুর্থ দিনে সেটা আরো ভয়াবহ মাত্রায় দাঁড়াল। যে কোন সময় মাথা ঘুড়িয়ে পরে যাব। পানি খেতে নিচে যাওয়ার শক্তিটুকু নেই। সামান্য সময় সিঁড়িতে বসে থেকে কিছুটা আগে আগে ক্লাসে বসে গেলাম। হাফেজ আবদুস সাত্তার সাহবে খাচ্ছিলেন। দূর থেকে আমাকে বসতে দেখেই তার কি যেন মনে হল। ডাক দিলেন- এই আবু বকর, এ দিকে আয়।

আস্তে আস্তে পা ঘঁষে ঘঁষে হুজুরের কাছে যাই।
কি হয়েছে রে তোর? হুজুরের প্রশ্ন।

আমি উত্তর দিই না। ভয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে।

আবার জানতে চান- কোন অসুখ হয়েছে?

আমি চুপ।

ভাত খেয়েছিস?

আমি হু হু করে কেঁদে উঠি। কাঁদারও শক্তি নাই। শুধু মাথা নাড়িয়ে বললাম- না।

হুজুর খাবার প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে অবাক হয়ে জানেত চাইলেন- কেন?

খানা বন্ধ।

কয় দিন খাস না।

চার দিন।

আমার উত্তর শোনার সঙ্গে সঙ্গে হুজুর যেন হাত পা ছেড়ে দিলেন। এক পাশে কাত হয়ে গেলেন। বলিস কি?
পাশেই ছিলেন হাফেজ এমদাদ সাহেব। তিনি এতোটাই রেগে গেলেন যে আমাকে শুধু ‘বেকুব বেকুব’ বকতে লাগলেন। আর কিছুই বলতে পারলেন না। রাগে তার হাত পা কাঁপছিল। চার দিন হল না খেয়ে আছিস, আমাদের বললি না কেন?

তখন বড় হুজুর হাফেজ এমদাদ সাহেবকে থামালেন। হুজুর, কারণ আছে। ভর্তির সময় ওকে শর্ত দিয়েছিলাম- খাবার কখনো ফ্রি হবে না। ফ্রি খানা চাইলে মাদরাসা থেকে বের করে দেব। এই ভয়ে কিছু বলেনি।

এখন থেকে তুই আমার সাথে খাবি। যা প্লেট নিয়ে আয়- আমার মৃত আত্মায় প্রাণ ফিরে পাওয়া হুজুরের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মধুময় বাণী।

যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে ওই লোকটা আমাকে অনবরত হুমকি দিতে থাকল। এখান থেকে চলে যা, নইলে কিন্তু তোর নামে হুজুরের কাছে মেয়েলি চিঠি পাঠাব। তখন দেখবি, হুজুর তোকে কেমনে ঝুলিয়ে পিটায়। মুখে আমি তার কথা পাত্তা না দিলেও ভেতর আমার কেঁপে উঠত। সত্যিই যদি এমন কিছু করে ফেলে, শয়তানটা তো সবই পারে!

ঠিকই একদিন সন্ধ্যায় আবদুস সাত্তার সাহেব হুজুর আমাকে ডাকলেন। আমি হুজুরের চোখ দেখেই বুঝে ফেললাম বিপদের কথা। কেঁদে উঠলাম- হুজুর, আপনার কাছে মনে হয় কোন চিঠি এসেছে?
হুজুর ধমকে উঠলেন- ও ঘটনা তাহলে সত্য, না?

আমি অনেক অনুনয় করে বললাম- যে লোক আমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিল সে ষড়যন্ত্র করে এই চিঠি দিয়েছে, বিশ্বাস করেন হুজুর।

হুজুর বললেন- না, আমি তোর কথা বিশ্বাস করি না। তুই খারাপ।

আমি বললাম, ওই লোকের কারখানার খাতার লেখা আর চিঠির লেখা যদি এক হয় তাহলে তো আপনি বিশ্বাস করবেন! আমি তার হিসাবের খাতা এনে দেব। হুজুর আমার কথা মানলেন। খাতা আনতে বললেন।

ওইদিনই আমি গোপনে কারখানায় যাই। যখন সে থাকে না। কিন্তু বরাত মন্দ। খাতা নাই। বাসায় নিয়ে গেছে। পরদিন যাই তাও পাই না। খাতা না আনতে পারায় হুজুরের সন্দেহ আমার ওপর আরো তীব্র হয়ে দাঁড়াল। সত্য কথা বের করার জন্য আমাকে বারবার জেরা করতে লাগলেন। এখনও সময় আছে, সত্যি কথা ক। চিঠিতে মগবাজারের যে ঠিকানা আছে আমি কিন্তু তা যাচাই করব। তখন কইলাম তোর রক্ষা নাই।

পরদিন সকাল সকাল হাফেজ আবদুস সাত্তার ও শামসুল ইসলাম হুজুর চিঠির ঠিকানায় বেড়িয়ে পড়লেন। যাবার সময় আমাকে সাত আট জনের বিশেষ পাহাড়ায় রেখে গেলেন। যেন পালাতে না পারি সে জন্যই এই ব্যবস্থা।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুরো মগবাজার চষে ফেললেন তারা দু’জন। কোথাও পাওয়া গেল না ওই চিঠির মেয়েকে। ভুল ঠিকানা। সন্ধ্যার পর দু’জনই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে ফিরলেন মাদরাসায়। ক্লান্তিতে পা উঁচু করতে পারছিলেন না। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল সারা দিন কি ধকলটাই না গেছে।

তারা ফেরার সামান্য পরই হঠাৎ কারখানার লোকটা এসে হাজির। সরাসরি বড় হুজুরের সামনে। হাতে আরেকটা চিঠি। আবু বকর নামে আপনাদের এখানে কোন ছেলে আছে?

বড় হুজুর বললেন- হ্যাঁ, আছে। কেন, কী হয়েছে!

লোকটা বলল, আমি তার মামা।

হুজুর অবাক। আপনি তার মামা, ভর্তির সময় তো আপনাকে দেখলাম না! কই ছিলেন তখন?

সে বলল, ছেলেটার একটু সমস্যা আছে। বাড়ি যেতে হবে।

হুজুর জানতে চাইলেন- কী সমস্যা?

সে উত্তর দিল- এটা না বলা ভাল।

হুজুর বললেন, সে আমাদের ছাত্র, আপনি তার ছুটি নিতে এসেছেন। বলবেন না কী সমস্যা?

লোকটা বলল, বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে। তার বাবা পাঠিয়েছে।

হুজুর জানতে চাইলেন, কী চিঠি?

লোকটা বলল, এটা মেয়েলি সম্পর্ক। না বলাই উত্তম।

হুজুর নাছোড়বান্দা। না বুঝার ভান করে বললেন, কী মেয়েীল সম্পর্ক। ভেঙে বলেন শুনি?

লোকটা বলল, সে এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। ওই মেয়ে এখন বাড়িতে উঠেছে। সামাজিকভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। তার বাবা আমার কাছে চিঠি লিখেছে- তুই এতো খারাপ। পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছি আর তুই মেয়ের সাথে এই কি করলি? আমাকে বলেছে আমি যেন তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যাই, বাড়িতে অনেক বিপদ।

হুজুর জানতে চাইলেন চিঠিটা কই?

সে বলল, আমার কাছে আছে।

হুজুর বললেন, চিঠিটা দেন।

সঙ্গে সঙ্গে আবদুস সাত্তার সাহেব সব হুজুরকে ডাকলেন। আগের চিঠিটাও বের করলেন সবার সামনে। দেখেন তো সবাই এই চিঠি দু’টি এক হাতের লেখা কিনা? সবাই এক পলক দেখেই বললেন, অবশ্যই একই ব্যক্তির লেখা।
বড় হুজুর প্রশ্ন করলেন- মেয়ের হাতের লেখা আর আবু বকরের বাবার হাতের লেখা এক হল কেমনে?

বড় হুজুরের চৌকান্নায় লোকটা ধরা পড়ে গেল। বসে থাকা হুজুররা সবাই রাগে ফেটে পড়ছিলেন তখন।

হাফেজ এমদাদ সাহেব পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বেত নিলেন হাতে। ফাজিল তুই কায়েকটা মাস ধরে আমাদের ভোগাচ্ছিস। আর একটা অসহায় মাসুম ছেলের জীবন নিয়ে ছিনিমিন খেলছিস। জীবনটাই নষ্ট করে ফেলেছিস তার। তোকে আজ ছাড়ছি না!

কুরআন পাঠের এ গল্প উপন্যাসকেউ হার মানায়। মজার ব্যাপার হলো কওমি মাদরাসাগুলোতে এরকম বহু ছাত্র রয়েছে, যারা হাজারও প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে পড়ালেখা করছে। আল্লাহ তাদের সহিহ দীনি ইলম শিক্ষা দিন। আমিন।

তাজুল ফাত্তাহ: সম্পাদক, মহিলাকণ্ঠ

দেশের প্রথম উভচর যান তৈরি হচ্ছে আলেম বিজ্ঞানীর হাতে

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ