শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘কওমি মাদরাসাকে কওমি বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলে মানুষের ধারণা ভিন্ন দিকে চলে যাবে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতির খসড়া আইন চূড়ান্ত করা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলছে। এর আইনি ভিত্তি ও আইনি কাঠামো কী হবে তা নিয়ে চলছে সেটি নিয়েও আলোচনা আছে। স্বীকৃতি স্বতন্ত্র কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হবে নাকি কর্তৃপক্ষ আইনে সে বিষয়ে অভ্যন্তরিন আলোচনা এখন তুঙ্গে।

বিষয়টি নিয়ে আগামী ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে এক জরুরি বৈঠকে বসছেন হাইআতুল উলয়ার সদস্যগণ। স্বীকৃতির চলমান এসব বিষয় নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন হাইআতুল উলয়ার সদস্য, বেফাকুল মাদারিসিদ দিনিয়ার মহাসচিব ও আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলূম ঢাকার (আফতাবনগর মাদরাসা) মুহতামিম মুফতী মোহাম্মদ আলী

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক কাওসার লাবীব

আওয়ার ইসলাম : ৬ বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত ‘আল-হাইআতুল উলিয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া’। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচয়টা কী? এটি কোনো সংস্থা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়?

মুফতী মোহাম্মদ আলী : এ বিষয়ে আমার বক্তব্য স্পষ্ট। মাদরাসা বলতে মানুষ একটা অর্থ বোঝে আবার ইউনিভার্সিটি বলতে মানুষ আরেকটা জিনিস বোঝে।যেমন সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বানাতে চাই তাহলে তাকে ভার্সিটি যেতে হবো। আর আলেম বানাতে হলে মাদরাসায় যেতে হবে।

এখন যদি এর অন্য কোনো নাম দেয়া হয়, কওমি বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয় তাহলে মানুষের ধারণা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। মানুষ যে ধারণা থেকে সন্তানকে কওমি মাদরাসায় দেয় ইউনিভার্সিটি হলে এটা আর থাকেবে না।

দারুল উলুম দেওবন্দের স্থপতি মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. এর উদ্দেশ্য ছিল এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যা সরকার থেকে দূরে থেকে নিজের স্বকীয়তাটা বজায় রাখবে। কেননা কামেস নানুতুবী রহ. বুঝতে পেরেছিলেন মাদরাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে, আমল আখলাক ও নিষ্কলুষ শিক্ষা ব্যহত হবে। তিনি আট মূলনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপকে ক্ষতিকর বলেছেন।

হাইআতুল উলয়াকে ইউ জি সি-ও বলা যাবে না, কেননা তারা অভিন্ন প্রশ্নে আলাদাভাবে আমাদের মতো পরীক্ষা নেয় না। আবার ইউনিভার্সিটিও বলা যাবে না, কেননা ইউনিভার্সিটি বললে আলাদা অস্তিত্ব বোঝায় । কিন্তু এ দুইটার কোনো টাইতো আমরা না।

কওমি মাদরাসা হলো সম্পূর্ণ আলাদা যা সাধারণ জনগণের টাকায় চলে এবং প্রধানমন্ত্রীই আমাদের বলেছেন আল-হাইয়াতুল উলিয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, আর এটাকেই সরকার মান দিবে।

সরকার আমাদের কথা শুনছে, সরকার সেটা মেনে নিয়েছে, আইনি খসড়া তৈরি করেছে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে এবং এটা ফাইনাল হয়েছে । এখন এ প্রশ্নই আসার কথা না ইউনিভার্সিটি নাকি অথরিটি?

আওয়ার ইসলাম : তার মানে ইউনিভার্সিটি নয়, আলাদা একটা সংস্থার মাধ্যমেই স্বীকৃতি নেওয়া হতে পারে?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: হ্যা, তাই।

আওয়ার ইসলাম : যদি বেসরকারি সংস্থার অধীনে সনদ দেয়া হয় তাহলে এর আইনি ভিত্তি কী হবে? মঞ্জুরি কমিশন বাংলাদেশের স্বাভাবিক শিক্ষানীতিমালা ও শিক্ষা আইনের সঙ্গে এ সংস্থা সাংঘর্ষ হবে কিনা?

মুফতী মোহাম্মদ আলী: কোনোভাবেই সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই । সংঘর্ষ হওয়ার কথাও না। কেননা সংসদে বিল পাশ করে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে আমরা স্বীকৃতি নিচ্ছি। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়ে স্বীকৃতি নিলেই সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে।

কেননা আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিবো, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন তা মেনে চলতে হবে। অথচ আমরা এতে সবসময় দ্বিমত। নাম দিবো বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম অনুযায়ী চলবো না। তখন সংঘর্ষের সম্ভাবনা।

আমি বলতে চাচ্ছি, বেসরকারি সংস্থার অধীনে নিলে এত কোনো সংঘর্ষ থাকবে না।

আওয়ার ইসলাম : যদি হাইআতুল উলয়াকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করা হয় তবে আইনি ভিত্তি শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকগণ। আর না হয় পরবর্তী কোনো সরকার এসে সংস্থার স্বীকৃতি বাতিল করে দিতে পারে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

মুফতী মোহাম্মদ আলী : সরকার আইন করে অনেক কিছু করতে পারে। তারা আইন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিকেও বাতিল করতে পারে। অতএব ওই ভয় পেয়ে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমরা যখন ইউনিভার্সিটির কোটায় চলে যাবো। তখন যে কোনো সরকার এক নির্দেশেই বন্ধ করতে পারবে। কেননা আমরা তাদের অনেক নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবো না।

আওয়ার ইসলাম : আপনি যে পদ্ধতির কথা বলাছেন, এমনটি হলে সরকারের সঙ্গে হাইয়াতুল উলয়ার দাপ্তরিক সম্পর্ক কী হবে?

মুফতী মোহাম্মদ আলী : এখানে কথা হলো সরকারের কাছে আমরা কতটুকু চাই। ইউনভার্সিটি থেকে পাশ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়। এখন আমরা যদি এসবই হতে চাই, তাহলে ইউনিভার্সিটি করা উচিৎ।

কিন্তু মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. কওমি মাদরাসাকে সব চায়গায় যাওয়ার জন্য বানান নি। তিনি চেয়েছেন এমন একদল মানুষ তৈরি করতে যারা দায়ি হবে, মানুষকে মানুষ বানাবে। আমাদের সব অঙ্গনে ভূমিকা রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না।

আর আপনার একথার সবচেয়ে উত্তম উত্তর হলো সাইদ আহমাদ পালনপুরীর একটি ঘটনা। তিনি একবার মিশর গিয়েছিলেন। তখন একজন প্রফেসরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় । তখন ওই প্রফেসর তাকে প্রশ্ন করেন, আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে প্রায় ১১শ বছর আগে, ছাত্র প্রায় শোয়া লক্ষ। আর দেওবন্দ মাদরাসা হয়েছে মাত্র দেড়শ বছর, এর ছাত্রের সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার । কিন্তু পৃথিবীর যেখানেই যাই, সেখানেই দেওবন্দের শিষ্য। এর কারণ কী?

তখন আল্লামা পালনপুরী বলেন, এর কারণ চিন্তাচেতনার ভিন্নতা। আজহার থেকে যারা বের হয় তারা বের হওয়ার আগেই চিন্তা করে দেশে গিয়ে একটা চাকরি করবো। আর না হয় এখানেই থেকে যাবো। কিন্তু দেওবন্দ থেকে এক হাজার ছাত্র বের হলে, তাদের সবাইকে বলা হয়, তোমরা যেভাবে এখন থেকে দীন শিখেছ, সেভাবে তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিবে। তারা নিজ এলাকায় গিয়ে তাই করে । এভাবে প্রত্যেক বছর বিশ্বে দেওবন্দের অনুসরণে হাজার হাজর মাদরাসা গড়ে ওঠছে।

আওয়ার ইসলাম : জানতে পেরেছি, ৬ তারিখে হাটহাজারী মাদরাসায় হাইয়াতুল উলিয়ার মিটিং ডাকা হয়েছে। সেখানে কী সিদ্ধান্ত হতে পারে?

মুফতী মোহাম্মদ আলী : আমাকে বলা হয়েছে সেখানে আইনী খসড়া নিয়ে আলোচনা হবে। ইতিপূর্বে কোনও মিটিংয়ে যেহেতু ইউনিভার্সিটি প্রসঙ্গ আসেনি, আমি আশা করি এখনও এ প্রসঙ্গ আসবে না। কেননা ৬ বোর্ডের পাঁচ বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে । বেফাকের অধিকাংশরাই এর বিপক্ষে। আর আমার ধারণা আল্লামা শাহ আহমাদ শফীও এর বিপক্ষেই থাকবেন।

তবে যদি কথা ওঠে তাহলে আমি প্রাণ খুলে আমার সবকথা হুজুরকে বলবো। হুজুর উদার মনের মানুষ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। তাই আমি মনে করি হুজুর আমার বিস্তারিত কথা শুনবেন এবং ইউনিভার্সিটির বিপক্ষেই থাকবেন।

আওয়ার ইসলাম : যারা ইউনিভার্সিটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

মুফতী মোহাম্মদ আলী: তাদের আমি বলবো আপনারা একটু ভাবুন। দেওবন্দের আট মূলনীতির দিকে তাকান।
এছাড়া আমরা আগে স্বীকৃতি নেই। তারপর দেখেন, যদি এর দ্বারা কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমরা ভিন্ন পথে হাঁটবো। আমাদের এ অবস্থা থেকে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া সহজ । কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে গেলে তা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন।

আওয়ার ইসলাম :  সব মিলিয়ে আল-হাইয়াতুল উলিয়ার ভবিষ্যত আপনি কেমন দেখছেন?

মুফতী মোহাম্মদ আলী : আলহামদুলিল্লাহ খুবই ভালো। আমরা বর্তমানে যেপথে আছি, এর ফলে আমাদের স্বীকৃতিও আসবে স্বকীয়তাও থাকবে। আর আমাদের ছেলেরা ছুঁতে পারবে সফলতা।

আওয়ার ইসলাম : আওয়ার ইসলামকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মুফতী মোহাম্মদ আলী : আপনাকেও ধন্যবাদ।


সম্পর্কিত খবর